গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
চেহারা অনেকটা তালশাঁসের মতো। ডাবও বলা চলে। অর্থাৎ, জলে পরিপূর্ণ। এত জল আমাদের চাঁদেও নেই!
তবে শুধু জলই নয়, সেই চাঁদে মিলল প্রাণধারণের যাবতীয় উপাদানের অস্তিত্বও। তার মধ্যে অন্যতম হল জৈব অণু। তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি উল্লসিত বিজ্ঞানীমহল। খুশি হওয়ার আরও কারণ আছে বইকি। এই চাঁদ আসলে পৃথিবীর ঘরের কাছেই রয়েছে। সে আমাদের সৌরসংসারেরই অংশ। সৌরমণ্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তে শনিকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সে। তাই একে শনির চাঁদ বলেই চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা। পোশাকি নাম ‘এনসেলাডাস’।
প্রায় ১৩ বছর ধরে (২০০৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত) শনি এবং তার উপগ্রহের চারপাশ প্রদক্ষিণ করেছিল নাসার মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’। সেই সময় সে বহু ছবি এবং তথ্য পাঠিয়েছিল পৃথিবীতে। তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, অ্যান্টার্কটিকার চেয়েও পুরু বরফের আস্তরণের নীচে বিশাল মহাসাগর রয়েছে শনির চাঁদে। একেবারে আদিগন্ত, অতলান্ত মহাসাগর। যার উপরটা পুরু এবং শক্তপোক্ত বরফের চাদর হলেও, নীচের জল একেবারে তরল অবস্থায় রয়েছে।
‘এনসেলাডাস’-এর দক্ষিণ মেরু থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসার ছবি তুলেছিল ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযান। দেখা গিয়েছিল, সেই জলীয় বাষ্প অনেকটা ‘জলের ফোয়ারা’র মতো উঠে আসছে। যার মধ্যে মিশে থাকতে দেখা গিয়েছে টুকরো টুকরো বরফের কণা। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জলের পাশাপাশি শনির চাঁদে শক্তির উৎস এবং কিছু সরল জৈব অণুরও অস্তিত্ব মিলেছে। অর্থাৎ জীবণধারণের সমস্ত রসদই রয়েছে এই উপগ্রহে।
‘এনসেলাডাস’-এর দক্ষিণ মেরুর পুরু বরফের চাদরে কিছুটা ফাটল লক্ষ করা গিয়েছে। তারই ফাঁক গলে যে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনেকের ধারণা, তা আসলে মিথেনের ধোঁয়া। ঘটনাচক্রে, পৃথিবীর মহাসাগরগুলির তলদেশে এই মিথেনই অসংখ্য অগণ্য অণুজীবের অস্তিত্বের প্রমাণ। অণুজীবই সেই মিথেন গ্যাস তৈরি করে মহাসাগরের তলদেশে।
বিজ্ঞানীমহলের একাংশ মনে করছে, এই মিথেনই এনসেলাডাসে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণের অন্যতম হাতিয়ার তাঁদের কাছে। শনির চাঁদে মিথেনের প্রাবল্য যখন এত বেশি, তখন সেখানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। হয়তো সেই প্রাণ বা অণুজীব এখনও টিকে রয়েছে এনসেলাডাসে।
তবে আরও একটি সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের অন্য একটি অংশের মত, এই মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসতে পারে মহাসাগরের তলদেশেরও নীচে থাকা বিশাল বিশাল ছিদ্রপথের (ভেন্ট) মাধ্যমে। পৃথিবীতেও এমনটাই ঘটে। ঘটেই চলে। মহাসাগরের একেবারে নীচের স্তরে রয়েছে কনকনে ঠান্ডা জল। তারও অনেক নীচে পৃথিবীর অন্দরে থাকে ম্যাগমা। সেই ম্যাগমার তাপে উষ্ণ হয়ে গিয়ে ওই সব ছিদ্র তৈরি হয়। সেই পথেই বেরিয়ে আসে ম্যাগমা। শনির চাঁদেও সেই প্রক্রিয়া ঘটে চলার সম্ভাবনা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জলীয় বাষ্পের ছবি দেখার আগেই অবশ্য এনসেলাডাসে জলের অস্তিত্বের আন্দাজ পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযানের পাঠানো ছবি থেকে দেখা গিয়েছিল, শনির চার দিকে তার উপগ্রহ ‘এনসেলাডাস’ চক্কর মারার সময় যেন একটু টাল খাচ্ছে। কখনও উপগ্রহটি একটু বেশি ঝুঁকে পড়ছে বাঁ দিকে। কখনও একটু ডান দিকে। ডিমের মতো দেখতে ‘এনসেলাডাস’-এর পিঠটা যেমন পুরু ও শক্ত বরফের চাদরে মোড়া, তার অন্তরে-অন্দরেও যদি ততটাই পুরু ও শক্ত বরফ থাকত, তা হলে শনির কক্ষপথে ঘোরার সময় তার উপগ্রহটি অমন টাল খেত না। একমাত্র জল যদি তরল অবস্থায় থাকে ‘এনসেলাডাস’-এর অন্দরে, তবেই শনির চার পাশে চক্কর মারার সময় সে অমন টাল খেতে পারে।
কিন্তু সঙ্গত প্রশ্ন হল, সূর্যের এত দূরে থেকেও, ‘এনসেলাডাস’-এর পিঠের পুরু ও লোহার মতো শক্তপোক্ত বরফের চাদরের তলায় দু’-এক ফোঁটা জল নয়, একেবারে সুবিশাল মহাসাগর রয়ে গিয়েছে কী ভাবে? আর সেই মহাসাগর কী ভাবেই বা লক্ষ-কোটি বছর ধরে তরল জলেই ভরে রয়েছে?
কারণটা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অনুমান করা হচ্ছে, শনির জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে তার অন্যতম উপগ্রহ ‘এনসেলাডাস’-এর মহাসাগরেও খুব জোরালো জোয়ার-ভাটা হয়। আর তা খুব নিয়মিতই হয়ে থাকে। এর ফলে, প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তির জন্ম হয় ‘এনসেলাডাস’-এর অন্তরে। ওই বাড়তি তাপই ভিতরের পুরু ও শক্ত বরফের চাদরকে গলিয়ে দেয়। আর তার নীচে থাকা মহাসাগরের জলকে ফের জমে গিয়ে বরফ হতে দেয় না। তাকে তরল অবস্থাতেই রেখে দেয়।
যদিও সব যুক্তির অকাট্য প্রমাণ এখনও মেলেনি। সেই প্রমাণের খোঁজেই এনসেলাডাস অভিযানের পরিকল্পনা করেছে ‘ইউরোপীয়ন স্পেস এজেন্সি’ (ইএসএ)। তাদের মহাকাশযানের অর্বিটারের কাজ হবে উপর থেকে খচাখচ উপগ্রহের মহাসাগর থেকে নির্গত জলীয় বাষ্পের ছবি তোলা। আর ল্যান্ডারের কাজ হবে এনসেলাডাসের দক্ষিণ মেরুতে নেমে সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করা।