কার না ‘অতিমানব’ বা ‘ট্রান্স-হিউম্যান’ হতে ইচ্ছে করে?
ইচ্ছে তো করেই। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর সেই মতো হয়ে ওঠে না সব কিছু।
‘ইচ্ছামৃত্যু’র বর পেয়েছিলেন পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর ‘ইচ্ছামৃত্যু’ই হয়েছিল। কিন্তু সে তো বর পেয়েছিলেন বলে!
জানেন কি, একেবারে ‘ইচ্ছামৃত্যু’ না হলেও, যা-চাইছি, তেমন ‘বর’ আমরাও পেতে পারি? হতে পারি ভীমের মতো অত্যন্ত শক্তিশালী! বা, অর্জুনের মতো তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টির মানুষ!
চাইলে, আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে পারি ইতিহাস থেকে অন্তত খাতায়-কলমে মুছে যাওয়া সেই ‘ক্রীতদাস প্রথা’! আবার রমরমিয়ে আমরা চালু করে দিতে পারি ‘ক্রীতদাসত্ব’!
গল্প নয়। সত্যি, নিখাদ সত্যি।
আরও সত্যিটা হল, তার প্রযুক্তিটা আধুনিক বিজ্ঞানের হাতে থাকলেও, বিজ্ঞান এটা করতে চাইছে না।
বিজ্ঞান যেটা চাইছে, সেটা কী রকম?
ধরা যাক, কোনও হবু বাবা-মা’র এক জনের বংশগত অন্ধত্বের সমস্যা রয়েছে। যাঁর সেই সমস্যা রয়েছে, তাঁর ‘জিনোম বিন্যাস’ (জিনোম সিকোয়েন্সিং) থেকে জানা গেল, তাঁর সবক’টি জিন ঠিক স্বাভাবিক নয়। সেগুলো একটু অন্য রকমের। ওই আলাদা রকমের জিনই তাঁর বংশগত অন্ধত্বের সমস্যার জন্য দায়ী। সেই হবু বাবা-মা তখন ঠিক করলেন, তাঁদের ভাবী শিশুর যাতে এই সমস্যা না হয়, তার জন্য জনন কোষে ওই জিনগুলোকেই তাঁরা বদলে ফেলবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। জনন কোষের ‘জিনোম’ কাটাকুটি করে গোলমেলে জিনগুলিকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় স্বাভাবিক জিনগুলি ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এর পর যখন তাঁদের নবজাতক জন্মালো, তার জিনে আর দৃষ্টিশক্তির কোনও সমস্যা থাকল না। এ রকম ঘটনা এখনও বাস্তবে ঘটেনি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলক ভাবে ইঁদুরের জিন এডিটিং করছেন বেশ কয়েক বছর ধরেই। একেবারে হালে বাঁদরের ভ্রূণে জিন এডিট করা হয়েছে। এমনকী, গত দু’বছরে চিনের বিজ্ঞানীরা মানুষের ভ্রূণেও জিন বদলাতে পেরেছেন। তবে সেই ভ্রূণ কয়েক দিনের মধ্যেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই ‘ডিজাইনার শিশু’র জন্ম হয়নি এখনও।
কী ভাবে হয় জিন এডিটিং: দেখুন ভিডিও।
ক্যান্সার, পার্কিনসন্সের মতো বহু রোগের মূলে রয়েছে নানা ধরনের জিন। তাই জিন এডিটিং-এর মাধ্যমে অনেক রোগভোগ থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তা হলে ক্ষতি কীসের? যে কোনও শিশুরই অধিকার রয়েছে সুস্থ জীবনযাপনের। তা হলে, ‘ডিজাইনার শিশু’র জন্ম সত্যি-সত্যিই হলে সমস্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
জিন এডিটিং নিয়ে সমস্যা কোথায়?
গবেষণার কাজে জিন এডিটিং করলে তেমন কোনও সমস্যা নেই। আমাদের জিনের নানা রকমের কর্মকাণ্ড গভীর ভাবে জানতে জিন এডিটিং খুব দরকার। সমস্যাটা হবে তখনই, যখন ফসলে বা মানব শরীরে জিন এডিটিং করা হবে। যত দিন না আমাদের জিনগত সমস্যাগুলিকে আমরা ভাল ভাবে বুঝতে পারছি, জিন পরিবর্তনের ভাল আর মন্দ দিক- দু’টোই যাচাই করতে পারছি, তত দিন সমস্যা রয়েছে। জিন পরিবর্তন করে হয়ত একটা রোগ সারানো গেল, কিন্তু যদি অন্য একটা মারাত্মক সমস্যা এসে পড়ে তার জন্য? সেই বিপদ ঠেকানোর মত জ্ঞান এখনও বিজ্ঞানীরা অর্জন করতে পারেননি।
আরও পড়ুন- মোবাইলের বেশি ব্যবহারে ক্যান্সার অনিবার্যই, জানাল গবেষণা
রয়েছে আরও একটি সমস্যা। ধরা যাক, সমাজের কিছু ধনী পরিবারের মধ্যে ‘ডিজাইনার শিশু’ জন্ম দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। সেই শিশুরা হবে অত্যন্ত সুস্থ-সবল। বুদ্ধিমত্তায় তারা পৃথিবীর অন্য শিশুদের চেয়ে অনেক, অনেক গুন এগিয়ে থাকবে। এর ফলে, ধীরে ধীরে এমন এক দুনিয়া গড়ে উঠতে পারে, যেখানে এক শ্রেণির মানুষ অর্থ বলে পরিণত হবেন অতিমানবে (ট্রান্সহিউম্যান) আর তাঁরা চাইলে, সমাজের একেবারে পিছিয়ে পড়া অংশটিকে তাঁদের ক্রীতদাসে পরিণত করতে পারবেন।
এই সব সাত-সতেরো ভেবে বিজ্ঞানীরা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। ওয়াশিংটনে গত ডিসেম্বরে এই সব নিয়েই হয়ে গেল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যেখানে ‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তির সাহায্যে জিন এডিটিং-এর বিপদ-আপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। জিন এডিটিং-এর অন্যতম দিকপাল বিজ্ঞানী জেনিফার ডাউডনা বার বার সতর্ক করলেন সতীর্থ বিজ্ঞানীদের, যাতে তাঁরা জিন এডিটিং করার ভাল-মন্দ সমস্ত দিক খতিয়ে দেখেন। আর তার পরেই কোনও জীবিত মানুষের জিন এডিটিং করেন।
এর অর্থ এই নয় যে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে রাখবেন। এমনকী, গবেষণাগারে মানব-ভ্রূণ বা জনন কোষেও জিন এডিটিং করা দরকার। আমাদের জিনের নানা ধরনের কার্যকলাপ ভাল করে বোঝার জন্য। কিন্তু তাই বলে ‘ডিজাইনার শিশু’? কখনও নয়।
বিজ্ঞানীরা নিজেদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে পারেন নীতিবোধের ওপর ভিত্তি করে। সমস্যাটা হল, সেই নীতিবোধের তো কোনও মানদণ্ড নেই, যা গোটা বিশ্ব মেনে চলবে। তাই আন্তর্জাতিক ভাবে সবক’টি দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে একটা সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নের জন্য। যার মাধ্যমে জিন এডিটিং-এর গবেষণা এগিয়ে চলবে। আবার অনর্থেরও আশঙ্কা থাকবে না। তার পর বার বার পরীক্ষার পর যখন এক দিন জিন এডিটিং-কে একদম নিরাপদ বলে সবাই মেনে নেবেন, তখন মানুষের জিনগত রোগ সারাতেও তা কাজে আসবে। বর্তমানে অনেক দেশেই নিয়মের গেরোয় এই গবেষণা নানা রকমের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। আপাতত ভারতে মানব জিন এডিটিং নিষিদ্ধ করে নির্দেশিকা বলবৎ থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনও আইন নেই এই বিষয়ে।
জিন এডিটিং নিয়ে এত হল্লা কেন?
কিন্তু এই জিন এডিটিং নিয়ে হঠাৎ এত মাতামাতি কেন?
জিন নিয়ে ‘খেলা’ আজকে শুরু হয়নি। ১৯৮০-র দশকে ‘জিন-লক্ষ্যভেদ’ (জিন-টার্গেটিং) নিয়ে প্রথম বড় সাফল্য এসেছিল ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মারিও কাপেক্কি, কার্ডিফ ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন এভান্স এবং নর্থ ক্যারোলিনা চ্যাপেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিভার স্মিথিসের গবেষণায় যখন তাঁরা ইঁদুরের জিনকে বংশ পরম্পরায় অকেজো করে দিতে পেরেছিলেন। তৈরি করতে পেরেছিলেন ‘নক-আউট ইঁদুর’। তার পর আরও সহজে জিন এডিটিং করার উপায় বাতলালেন জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীনিবাসন চন্দ্রশেখরন আর ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেনা ক্যারল। তাঁদের তৈরি করা ‘জিঙ্ক-ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ’ দিয়ে জিন এডিট করে। তার পর বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। জিন এডিটিং-এর প্রযুক্তি তরতর করে এগিয়েছে। মাঝে আরও কিছু নতুন প্রযুক্তি এসেছে। কিন্তু ‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তি সব কিছুকে ছাপিয়ে বিজ্ঞানীদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। তার প্রধান কারণ, গবেষণাগারে ইঁদুর বা অন্য প্রাণীর জিন এডিট করাটা ‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তি দিয়ে খুব সহজেই সম্ভব। আর যখন প্রযুক্তি সহজ হয়ে যায়, তখন আরও অনেক বিজ্ঞানী সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের রোগভোগ দূর করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। অসীম সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে যে!
‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ কী জিনিস? খায়, না মাথায় দেয়?
জিন এডিটিং গবেষণায় অনেক ‘খেলুড়ে’র মধ্যে ‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তিটাই নবীনতম সংযোজন।
‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তি দিয়ে কী ভাবে জিন ইচ্ছে মতো কাটা যায়, তার একটা খুব সহজ ছবি তুলে ধরছি। এই প্রযুক্তি রসায়নের খুব সহজ এক প্রকার বন্ধনীর (bonding) ওপর নির্ভর করে, যাকে বলা হয়- ‘হাইড্রোজেন বন্ধনী’। ‘ডিএনএ’ আর ‘আরএনএ’ হল ‘ফসফেট মেরুদণ্ডে’র ওপর যথাক্রমে ২’-ডিঅক্সিরাইবোজ (2’-deoxyribose) বা রাইবোজ (Ribose) নামের শর্করা এবং চার রকমের নিউক্লিও-বেস দিয়ে বানানো ‘নিউক্লিওটাইড’গুলির লম্বা সুতোর মত দীর্ঘ বিন্যাস। এই চার রকমের নিউক্লিও-বেস কী ভাবে নিজেদের মধ্যে ‘হাইড্রোজেন বন্ধনী’ তৈরি করে, তা চিত্র-১ থেকে বোঝা যাবে। ডিএনএ আর আরএনএ-র মধ্যে অন্যতম ফারাকটা হল আরএনএ-তে থাইমিনের পরিবর্তে ইউরাসিল থাকে। দু’টো নিউক্লিও-বেসই অ্যাডেনিনের সঙ্গে ‘হাইড্রোজেন বন্ধনী’ তৈরি করতে পারে। (চিত্র-১)
ডিএনএ, আরএনএ-র মধ্যে হাইড্রোজেন-বন্ধনী (চিত্র ১ )
আমাদের জিন ডিএনএ দিয়ে তৈরি। তাই জিন এডিটিং করা মানে আদতে, ডিএনএ-টাকেই ‘এডিট’ করা। ওই প্রযুক্তির প্রতিটি পর্যায় নম্বর দিয়ে বর্ণনা করা হল চিত্র-২ এ।
প্রথম ধাপে, ডিএনএ-র যে অংশটি এডিট করা হবে, তার সবক’টি নিউক্লিওটাইডের সঙ্গে ‘হাইড্রোজেন বন্ধনী’ গড়ে তুলতে পারবে, এমন একটা আরএনএ বানানো হয়। তার পর সেটিকে ‘ক্যাস-৯’ উৎসেচকের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ধাপে, ওই মিশ্রণের আরএনএ যখন সেই ডিএনএ-র দু’টি ফিতের মধ্যে একটির সঙ্গে ‘হাইড্রোজেন-বন্ধনী’ বানিয়ে ফেলে, তখনই শুরু হয়ে যায় একটি প্রক্রিয়া। যার নাম- কৃস্পার হস্তক্ষেপ (বা, ক্রিস্পার ইন্টারফেয়ারেন্স)। এই ধাপটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার ওপরেই জিন এডিটিংটা ঠিক জায়গায় হল কি না, সেটা নির্ভর করে।
তিন নম্বর ধাপে ‘ক্যাস-৯’ উৎসেচকটি ডিএনএ-র দু’টো ফিতেই কেটে দেয়। যাকে বলে- ‘ডিএনএ-র জোড়া বিভাজন’ (ডাব্ল স্ট্র্যান্ড ব্রেক)।
চতুর্থ ধাপটা হল: যখন ছিন্ন ডিএনএ আবার জোড়া (ডিএনএ রিপেয়ার) লাগিয়ে জিন এডিটিং-কে সম্পূর্ণ করা হয়। ওই জোড়া লাগানোর সময় অনেক রকম কারিকুরি করেন বিজ্ঞানীরা। যদি বাইরে থেকে নতুন ডিএনএ (ডোনার ডিএনএ) ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে ডিএনএ-র দু’টো টুকরো জোড়া লাগানোর সময় এই নতুন ডিএনএ-র টুকরোটিকেও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ভাবে কোনও ‘রোগের কারণ’ জিনকে ‘সুবোধ বালক’ বানিয়ে ফেলা যায়। আর তারই মাধ্যমে সারিয়ে ফেলা যায় অনেক জিনঘটিত অসুখ। যাকে বলা হয়- ‘জিন সংশোধন’ (জিন কারেকশান)। এ ছাড়াও উপায় রয়েছে একটা। তা হল- ডিএনএ-র দু’টো টুকরোকে সরাসরি জোড়াতালি দিয়ে ‘রোগের কারণ’ জিনটিকে অকেজো করে দেওয়া যায়। যাকে বলে- ‘জিন-বিভ্রাট’ (জিন-ডিজরাপশান)।
(চিত্র ২)- ‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’ প্রযুক্তির বিভিন্ন ধাপ।
‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস-৯’-এর আসল মালিক কে?
একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, জিন এডিটিং-এর এই ‘ক্রিস্পার/ক্যাস-৯’ প্রযুক্তি কিন্তু বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেননি। তাঁরা ওই পদ্ধতিটা শুধুই আবিষ্কার করেছেন। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের পথে, প্রকৃতি বহু আগেই এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে রেখেছে। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে। মানে, ওই ব্যাকটেরিয়া এটা নিজে থেকেই করতে পারে। আমরা যেমন ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হই, তেমন ভাবে ব্যাকটেরিয়ারাও প্রায়শই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ভাইরাসের আক্রমণে। তবে ব্যাকটেরিয়ারাও খুব একটা কম যায় না। তারাও ভাইরাসের হানাদারি রুখতে নিজেদের সংক্রমণ-প্রতিরোধ ক্ষমতার (অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি) বিবর্তন করে নেয়। আর সেই ভাবে, ভাইরাসের অস্ত্রেই তাকে বধ করার ফন্দি আঁটে ব্যাকটেরিয়া। চিত্র-৩ এ সেই প্রক্রিয়াটারই সবিস্তার বিবরণ দেওয়া হল।
ডিএনএ ভাইরাস (যাদের জিন ডিএনএ দিয়ে তৈরি) কী করে, জানেন? ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তাদের ডিএনএ ঢুকিয়ে দেয় একেবারে চুপিসাড়ে। বাইরে পড়ে থাকে শুধুই ভাইরাসের একটা ‘প্রোটিন-খোলস’। এর পর ওই ভাইরাস ডিএনএ-র কিছু অংশ ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জুড়ে যায়। বাইরে থেকে আসা ‘ডিএনএ-আত্মীকরণ’ (অ্যাকুইজিশন) করার নানা রকমের পদ্ধতি রয়েছে। আর তা শুধুই ব্যাকটেরিয়াতে নয়, সমস্ত জীবজগতেই সেই পদ্ধতির ব্যবহার হয়েছে বিবর্তনের কোনও না-কোনও সময়ে।
ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমের কিছু অংশে নিয়মিত ভাবে প্রায় ৩০টি নিউক্লিওটাইডের একটাই বিন্যাস দেখা যায়। যাকে বলা হয়- ‘ক্রিস্পার’ (মানে, ‘ক্লাস্টার্ড রেগুলারলি ইন্টারস্পেস্ড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিট’)। আর মজার ব্যাপারটা হল, এই বিন্যাসগুলির মাঝে ঢুকে থাকে সেই সব বহিরাগত জিনের অংশ, যা ভাইরাসের কাছ থেকে এসেছে। চিত্র-৩ এ ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমে বেগুনি রঙের বরফি দিয়ে সেই বিন্যাস দেখানো হয়েছে। যা বার বার নিয়মিত পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে। এদের মাঝে রয়েছে বহিরাগত ডিএনএ। যা, কমলা, গোলাপি আর সবুজ রঙে দেখানো হয়েছে।
ওই বহিরাগত ডিএনএ-র প্রতিলিপিকরণ (ট্রান্সক্রিপশন) আর প্রক্রিয়াকরণের (প্রসেসিং) মাধ্যমে সেই সব পথ-প্রদর্শক আরএনএ (গাইড আরএনএ) বানানো হয়, যা সেই ভাইরাসের ডিএনএ-র সঙ্গে পর পর জুটি (পেয়ারিং) বানাতে পারে, ‘হাইড্রোজেন-বন্ধনী’র মাধ্যমে।
ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোজোমে রয়েছে আরও কিছু জিন। যারা নানা রকম ‘ক্যাস’ নামের প্রোটিন বানাতে পারে। তাদের মধ্যে ‘ক্যাস-৯’ নামের উৎসেচকটি পথ-প্রদর্শক আরএনএ-র সঙ্গে মিলেমিশে ব্যাকটেরিয়ার কোষে পাহারা (সার্ভেল্যান্স) দিতে থাকে।
চিত্র ৩ – ব্যাকটেরিয়ার ভাইরাস-সংক্রমণ রোখার বিভিন্ন ধাপ।
এর মধ্যে কোনও ব্যাকটেরিয়াকে যদি পুরনো সেই ভাইরাসের বংশধর আক্রমণ করে বসে, তা হলে পথ-প্রদর্শক আরএনএ সহজেই সেই ভাইরাসের ডিএনএ-কে চিনতে পেরে যায় (চিত্র ৩-এ কমলা রঙের বাক্স)। আর চিনতে পেরেই, ‘ক্যাস-৯’-কে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে সেই ডিএনএ-র দফা-রফা করতে (আসলে ‘ক্যাস-৯’ প্রোটিন আর ‘গাইড-আরএনএ’- দুটো’ই এক সঙ্গে পাহারা দেওয়ার কাজটা করে। তবে প্রথমে সেই কাজটা করে ‘গাইড-আরএনএ’ই।)! তখন বেচারি ভাইরাস তার সব শক্তিই হারিয়ে ফেলে। এর পর যত বারই ওই ভাইরাসের বংশধররা আক্রমণ করুক না কেন, ব্যাকটেরিয়ার আর কিছুই এসে যায় না। এই ধুরন্ধর বুদ্ধির জন্য ব্যাকটেরিয়ারই ‘নোবেল’ পাওয়া উচিত!
ব্যাকটেরিয়ার পথ-প্রদর্শক আরএনএ আরও এক ধরনের আরএনএ-র সাহায্য নেয়। যাকে বলা হয়, ‘ট্রেসার-আরএনএ’। ‘ক্রিস্পার’ প্রযুক্তিতে এই দুই আরএনএ মিলিয়ে শুধুই একটি পথ-প্রদর্শক আরএনএ (সিঙ্গল গাইড আরএনএ) ব্যবহার করা হয় (চিত্র ২)।
‘ক্রিস্পার’/‘ক্যাস ৯’ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
ব্যাকটেরিয়ার কপালে ‘নোবেল’ না-জুটলেও, কয়েক বছরের মধ্যে যে নোবেল কমিটি এই প্রযুক্তিকে ‘নোবেল পুরস্কার’ দিয়ে সম্মান জানাবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে খুব একটা সংশয় নেই।
তবে এই প্রযুক্তির ‘পেটেন্ট’ করা নিয়ে বেশ কিছু নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। সকলেরই দাবি, এই প্রযুক্তি তারাই প্রথম জিন এডিটিং করার কাজে লাগিয়েছেন।
এই বিতর্ক হয়ত আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকবে। কিন্তু সত্যিই যদি বিজ্ঞানীরা ওই প্রযুক্তিটিকে কাজে লাগিয়ে জীবন্ত প্রাণীর দেহে জিন এডিটিং করতে চান, তা হলে তাঁদের আরও বেশ কিছু বাধা পেরোতেই হবে।
সেগুলো কী কী?
প্রথমত, যে পথ-প্রদর্শক আরএনএ-র কথা একটু আগে বললাম, সবচেয়ে আগে সেটাকে কিন্তু বাইরে থেকেই প্রাণীর দেহে ঢোকাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ‘ক্যাস-৯’ প্রোটিন কিন্তু আমাদের শরীরে তৈরি হয় না। তাই সেই প্রোটিনকে ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ দিয়ে কৃত্রিম ভাবে, খুব দ্রুত তৈরি করতে হবে। যেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আসলে ‘গাইড-আরএনএ’ আর ‘মেসেঞ্জার-আরএনএ’ দু’টোই সরাসরি আমাদের শরীরে ঢুকে গেলে খুব মুশকিল।
তৃতীয়ত, বহিরাগত আরএনএ কোনও প্রাণীর দেহে ঢুকলে, শরীরের কোষগুলি মনে করে, ভাইরাস তাদের আক্রমণ করেছে। আর তখনই তারা তাদের সংক্রমণ-প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই সব আরএনএ-কে একেবারে নির্বংশ করে দেয়। এটা একটা বড় সমস্যা। যার সমাধান করতে বিজ্ঞানীরা ‘নিরীহ ভাইরাস’ (যেমন, ‘অ্যাডিনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস’ বা, নানা রকমের ‘নন-ভাইরাল প্রতিনিধি’দের ব্যবহার করছেন। আমাদের শরীরে কৃত্রিম ভাবে আরএনএ তৈরি করতে। বা, সেটাকে সরাসরি পাচার করার জন্য।
ভাইরাস ব্যবহারের ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকায় ‘লিপিড ন্যানো-পার্টিক্ল’ দিয়ে শরীরে আরএনএ পাচার করাটাই শ্রেয়। সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী উপায় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ।
আর তাই বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও কোম্পানি এই বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কবে ঘরে-ঘরে জিন এডিটিং করে আমাদের অনেক অসুখবিসুখই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে, সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলার সময় এখনও আসেনি। সেই লক্ষ্যপূরণে এখন যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- এমানুয়েল শার্পনটিয়ে, জেনিফার ডাউড্না, জিন সু কিম, ফং ঝাং, প্রশান্ত মালি, জর্জ চার্চ, কিথ জং, রবার্ট ল্যাঙ্গার, ড্যানিয়েল অ্যান্ডারসন, ম্যাথু পোর্টিয়াস, ডেভিড লিউ সহ বিশ্বের বহু বিজ্ঞানী।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে- ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)