Glacier Melting

সে দিন ঘনিয়ে আসছে, শীঘ্রই বছরে ৩০০০ হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হবে উষ্ণায়নে! প্রমাদ গুনছেন বিজ্ঞানীরা

আশঙ্কা ছিলই। এ বার সেই আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেল পরিবেশ বিজ্ঞানীদের নতুন গবেষণায়। যে ভাবে উষ্ণায়ন চলছে, সে ভাবে চলতে থাকলে শীঘ্রই ‘হিমবাহশূন্য’ হওয়ার দিকে এগোতে পারে পৃথিবী।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭
Share:

প্রতি বছর গড়ে তিন হাজারটি করে হিমবাহ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে, সেই দিন আর বেশি দূরে নেই। — প্রতীকী চিত্র।

গত দু’দশকে বহু হিমবাহ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। বরং, আরও দ্রুত হবে। কার্বন নিঃসরণকে নির্ধারিত সীমার মধ্যে আটকে রাখলেও এই ভবিতব্য বদল করা যাবে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনটাই আভাস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

কার্বন নিঃসরণ এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ক্রমশ ‘বরফশূন্য’ হচ্ছে পৃথিবী। গত ২০ বছরে কমপক্ষে চার হাজার হিমবাহ হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। বর্তমানে প্রতি বছরে গড়ে এক হাজারটি করে হিমবাহ গলে জল হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আরও দেড় দশকের মধ্যে হিমবাহ গলনের হার তিন গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রতি বছর গড়ে তিন হাজারটি করে হিমবাহ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে, সেই দিন আর বেশি দূরে নেই। ২০৪০ সালেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সুইৎজ়ারল্যান্ডের ইটিএইচ জ়ুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ল্যান্ডার ভন ত্রিচ এবং তাঁর সহযোগীরা সম্প্রতি হিমবাহের উপরে উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এই গবেষণার জন্য জলবায়ু সংক্রান্ত বেশ কিছু মডেল ব্যবহার করেন তাঁরা। উষ্ণায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আগামী এক শতাব্দীতে বিশ্বের দু’লক্ষেরও বেশি হিমবাহের কী অবস্থা হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে দেখেন গবেষকেরা।

Advertisement

বিশ্বব্যাপী শিল্পের ব্যাপক প্রসার হওয়ার পর থেকেই উষ্ণায়নের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, এই ব্যাপক প্রসার হয়েছিল ১৮৫০-১৯০০ সালের মধ্যে। এর আগের সময়কালকেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হারকে একটি আদর্শ মাপকাঠি হিসাবে ধরেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। ওই সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার ছিল ১.৫-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন তা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০ বছর আগে, ২০১৫ সালে বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলা করতে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাতে স্থির হয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের হারকে ফের ১.৫ ডিগ্রিতে নামিয়ে আনতে উদ্যোগী হবে দেশগুলি। না-হলে অন্তত ২ ডিগ্রির নীচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

এক দশক পেরিয়েও প্যারিস চুক্তির সেই লক্ষ্যপূরণ হয়নি। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে পথে এগোচ্ছে, তাতে চলতি শতাব্দীতে উষ্ণায়নের হার ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও এই ভাবেই উষ্ণায়ন চলতে থাকে, তবে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৭৯ শতাংশ হিমবাহই গলে জল হয়ে যাবে। যদি উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রির নীচে সীমাবদ্ধ রাখাও যায়, তা-ও পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে না। হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হওয়ার হার কিছুটা শ্লথ হবে মাত্র। গবেষকদের অনুমান, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখা গেলেও পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে ৬৩ শতাংশ হিমবাহ।

উষ্ণায়নের হার ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে গেলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তা-ও বিশ্লেষণ করে দেখেছেন গবেষকেরা। সে ক্ষেত্রে প্রায় ‘বরফশূন্য’ হয়ে যাবে পৃথিবী। হারিয়ে যাবে ৯১ শতাংশ হিমবাহই। এই গবেষকদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়ার পিট্‌সবার্গে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভিড রাউন্সও। তাঁর কথায়, “বহু হিমবাহ আমরা হারাতে ফেলতে চলেছি। তবে এর মধ্যে অনেকগুলিকে আমরা বাঁচাতেও পারি।”

জলবায়ু পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, তা মানছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সমাধান করে উঠতে পারছে না। ২০২৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক হিমবাহ সংরক্ষণ বর্ষ’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা। উদ্বেগ যে কতটা বাস্তব, তা এই সিদ্ধান্ত থেকেই অনুমেয়। দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজ়ুয়েলার পরিস্থিতি নিয়েও দেড় বছর আগে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সে দেশের একটি মাত্র অবশিষ্ট হিমবাহও প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, সেটিও হারিয়ে ফেলতে পারে ভেনেজ়ুয়েলা।

উদ্বেগ রয়েছে আরও। হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পাবে। চলতি শতাব্দীতে হিমবাহ গলনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। তা ছাড়া হিমবাহের দ্বারা পুষ্ট নদীগুলির জলের উপরেও বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের কাজ নির্ভর করে। তা-ও ব্যাহত হবে। এ ছাড়া হিমবাহের জল জমে এমন হ্রদগুলি থেকে আচমকা জল বেরিয়ে এসে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। যেমনটা হয়েছিল সিকিমে, ২০২৩ সালে। ওই বছরে সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হিমবাহের হ্রদ ছাপিয়ে বন্যা হয়। তাতে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

উষ্ণায়নের ধাক্কা সামাল দিতে বিভিন্ন দেশ উদ্যোগী হয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতি যা, তাতে উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখলেও চলতি শতাব্দীতে প্রায় অর্ধেক হিমবাহ নিশ্চিত হয়ে যাবে। গবেষকদের অনুমান, শতাব্দী শেষে ১.৫ ডিগ্রি উষ্ণায়ন থাকলে ৫৫ শতাংশ হিমবাহ হারিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।

গবেষকদলের প্রধান ভন ট্রিচের কথায়, “বড় হিমবাহগুলির বরফ গলতে অনেক সময় লাগে। তাই সেগুলি দেরিতে নিশ্চিহ্ন হবে।” বর্তমানে জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, তাতে অনুমান করা হচ্ছে ২১০০ সালের মধ্যে পশ্চিম কানাডা এবং সংলগ্ন আমেরিকার বেশির ভাগ হিমবাহই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। প্রায় হিমবাহশূন্য হয়ে পড়তে পারে আল্প‌্‌স পর্বতমালাও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement