মিশন কন্ট্রোল রুমের পর্দার অজস্র সংখ্যার আঁকিবুকি থেমে গিয়েছে। এক-একটা মিনিট যেন বুকের ভিতরে হাতুড়ি পিটছে! কখনও পর্দায় ভেসে উঠছে থমথমে নরেন্দ্র মোদীর মুখ। কখনও গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে ইসরোর অধিকর্তা কে রাধাকৃষ্ণনকে। বেঙ্গালুরুর ইসরো টেলিমেট্রি ট্র্যাকিং অ্যান্ড কম্যান্ড নেটওয়ার্কের (ইসট্র্যাক) মিডিয়া সেন্টারে বসে থাকা সাংবাদিকরাও কিছুটা থম মেরে গিয়েছেন!
হঠাৎই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন রাধাকৃষ্ণন। ফোনের রিসিভার তুলে কারও সঙ্গে কথা বললেন। তার পরেই উচ্ছ্বাসে হাত ঝাঁকাতে শুরু করলেন তিনি।
মুহূর্তে বদলে গেল মিশন কন্ট্রোল ও মিশন অ্যানালিসিস রুমের গুমোট আবহটা! বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। কেউ বা কাচের দরজার বাইরে থাকা সাংবাদিকদের দু’আঙুলে ‘ভি’ দেখাচ্ছেন। এ ভাবেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ল আজকের দিনটি।
বুধবার সকালে নির্ঘণ্ট মেনেই লাল গ্রহের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে মঙ্গলযান। প্রথম চেষ্টাতেই নিজেদের দূতকে মঙ্গলের কক্ষপথে বসিয়ে দিতে পেরেছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। বিশ্বে আগে কেউ যা পারেনি! “এ দিক থেকে আমরা নাসা, রাশিয়া, ইওরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকেও টপকে গিয়েছি,” বললেন ইসরোর জনসংযোগ অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ কার্নিক।
এই নয়া ইতিহাসকে নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্য। অভিযানের সাফল্যকে তুলনা করেছেন মা-ছেলের মিলন হিসেবে। বলেছেন, “মম (মঙ্গলযান ওরফে মার্স অরবিটার মিশন, সংক্ষেপে মম) কো মঙ্গল মিল গয়ি। মঙ্গল কো মম মিল গয়া।” ইসরোর এই সাফল্য মাপতে গিয়ে তিনি টেনে এনেছেন ক্রিকেটের প্রসঙ্গও। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “বিদেশে গিয়ে কাপ জিতলে দেশবাসী আনন্দ করেন। এই সাফল্য হাজারটা কাপ জেতার সমান।”
সকাল ন’টা। মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়াররা। আনন্দের সঙ্গে শরীরে লেগে রয়েছে বিনিদ্র রাত্রির ক্লান্তিও। অনেকেরই চোখ লাল টকটকে। তবু সারা শরীর থেকে যেন ঝরে পড়ছে জয়ের আনন্দ। এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার দীপক পণ্ডা বললেন, “সোমবার লিকুইড অ্যাপোজি মোটর (ল্যাম) ইঞ্জিন ঠিকমতো চালু হওয়ায় আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। তবু টেনশনে কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি। মঙ্গলযানকে লাল গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যে ওই ইঞ্জিনটার কাঁধেই।” ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সকাল ৭টা বেজে ১৮ মিনিটে ল্যাম ইঞ্জিন চালু করা হয়েছিল। মঙ্গলযান যাতে লাল গ্রহের মাটিতে আছড়ে না-পড়ে কিংবা অতিরিক্ত গতিতে ছিটকে বেরিয়ে না যায়, তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল ল্যামের। সে কাজ দক্ষতার সঙ্গেই সামলেছে সে। গোটা কাজটা করতে তার সময় লেগেছে ২৪ মিনিট। ৭টা ৪২ মিনিটে দায়িত্ব ফুরোয় ল্যামের।
ল্যাম যখন এই কাজ করছে তখন কিন্তু কোনও খবরই পাচ্ছে না ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এমনিতে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে রেডিও সঙ্কেত আসতে সময় লাগে সাড়ে বারো মিনিট। তার উপর মোট ২৪ মিনিটের মধ্যে ২০ মিনিটই মঙ্গলযান ছিল মঙ্গলের আড়ালে। অর্থাৎ, মঙ্গলযান ও পৃথিবীর মাঝে তখন মঙ্গল। ফলে মঙ্গলযান থেকে কোনও সঙ্কেতই পৃথিবীতে পৌঁছচ্ছে না। সুতরাং দমবন্ধ অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না বিজ্ঞানীদের। ৭টা ৫৮ মিনিটে জানা গেল, মঙ্গলযানকে নিরাপদেই অভিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দিয়েছে ল্যাম। দীপকের সহকর্মীরা বলছেন, চূড়ান্ত পর্যায়ের ২৪ মিনিটই ছিল চিন্তার কারণ। অভিযান ভেস্তে যাওয়ার ভয় অবশ্য ছিল প্রতি পদেই। ইসরোর বিজ্ঞানীরাই বলছেন, নাসার মতো উন্নত রকেট তাঁদের নেই। তাই শুরু থেকেই পেরোতে হয়েছে বহু বাধা। কিন্তু অভিযান উতরে গিয়েছে প্রযুক্তির জোরে। নাসার মঙ্গল অভিযানের খরচের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করে।
৫ নভেম্বর শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করার পর ২৫ দিন পৃথিবীর চার পাশে পাক খেয়েছিল মঙ্গলযান। একটু একটু করে লাফিয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছিল পৃথিবী থেকে। তার পর ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বরের সন্ধিক্ষণে এক লাফে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাকাপাকি ভাবে লাল গ্রহের দিকে রওনা দিয়েছিল। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, পৃথিবীর টান কাটিয়ে বেরোনোটাই ছিল প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। এশিয়ার দুই দেশ চিন ও জাপানের মঙ্গল অভিযান এই পর্যায়েই ব্যর্থ হয়েছিল। সে দিক থেকে দশ মাস আগেই এশিয়ায় সেরা হয়েছিল ভারত। তার পর তেমন বড় কোনও বাধা আসেনি। চিন্তা ছিল চূড়ান্ত পর্যায় ঘিরেই। “কিন্তু ইসরোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে সেই বাধা মালুমই হল না,” বলছেন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা, পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন।
এমন সাফল্যে এ দিন প্রকাশ্যেই উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল মোদীকে। হাত মেলাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। হঠাৎই সামনে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিরুঅনন্তপুরমের বিক্রম সারাভাই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা এম চন্দ্রদাতনকে। নবীন ইঞ্জিনিয়ারদের অকাতরে সই বিলোলেন। এক মহিলা বিজ্ঞানীকে ইশারা করে বললেন, ঢোল বাজিয়ে আনন্দ করতে! অভিযান শেষে বক্তৃতা দিতে উঠে বললেন, “ভারতের বিজ্ঞানীরা ইতিহাস তৈরি করেছেন। অল্প সাধ্য নিয়ে প্রথম বারেই এমন সিদ্ধিলাভ!” এই সূত্রেই পরে সাহা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “আমেরিকায় নাসা যে ভূমিকা পালন করে, আশা করি আগামী ন’-দশ বছরের মধ্যে ইসরো তা-ই করে দেখাবে ভারতে। দেশকে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি উপহার দেবে।” তাঁর মতে, এর ফলে দেশে থেকে গবেষণা করায় আরও উৎসাহ পাবেন ছেলেমেয়েরা।
শুধু নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা তৈরিই নয়, দেশের সামনে মহাকাশ বাণিজ্যের দিগন্ত খুলে দেওয়ার কাজটাও এই মঙ্গল অভিযান সেরে ফেলল বলে বিজ্ঞানীদের অনেকের মত। তার একটা বড় কারণ অনেক কম খরচে সাফল্য ছুঁয়ে ফেলা। যে সাফল্যকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে নিজের লেখা দু’লাইনের একটা কবিতা শুনিয়েছেন মোদী। “ব্যর্থ হলে হতে হয় সমালোচনার পাত্র। আর সাফল্যে ঈর্ষার পাত্র।”
সত্যিই তো। জাপান বা চিন যা পারেনি, বহু গুণ অর্থ খরচ করেও আমেরিকা এক বারে যা করে দেখাতে পারেনি, ভারত এক দানে মাত করেছে সেই কিস্তি। ঈর্ষা তো হবেই!