Michel Mayor

১৫০ বছরের যাত্রায় ম্যাড্রাস অবজারভেটরির 'ভুল' শুধরে মিশেলের নোবেল

ইতিহাস বলছে, মহাকাশ গবেষণায় এই ভিনগ্রহ খোঁজের যাত্রাপথে ভারতের নামও জড়িয়ে রয়েছে ২০০ বছরেরও আগে থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, ১৭৮৬ সালে, বর্তমান চেন্নাই বা তত্কালিন মাদ্রাজে স্থাপিত হয় ম্যাড্রাস অবজারভেটরি।

Advertisement

সুজন সেনগুপ্ত

বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:২৭
Share:

সুজন ও মিশেল (বাঁ দিক থেকে)

পদার্থবিদ্যায় এ বারের নোবেলের ভিত্তিপ্রস্তরটা মনে হয় সেই কোপার্নিকাসের সময়েই স্থাপন হয়েছিল, যে দিন তিনি বলেছিলেন, সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরছে। আসলে তখনই বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন, তা হলে এত যে তারা রয়েছে, তাদের চারপাশেও নিশ্চয়ই গ্রহরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তখন প্রযুক্তির উন্নতি সেই উচ্চতায় পৌঁছয়নি, যা দিয়ে সুদূর মহাকাশের কোনও একটি কোণের এক সূর্যের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। পরে গ্যালিলিও কিছু ছোট ছোট টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন। যা দিয়ে কিছু নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা যেত মাত্র।

Advertisement

ইতিহাস বলছে, মহাকাশ গবেষণায় এই ভিনগ্রহ খোঁজের যাত্রাপথে ভারতের নামও জড়িয়ে রয়েছে ২০০ বছরেরও আগে থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, ১৭৮৬ সালে, বর্তমান চেন্নাই বা তত্কালিন মাদ্রাজে স্থাপিত হয় ম্যাড্রাস অবজারভেটরি। সেখানে প্রথমে মূলত অক্ষাংশ নির্ধারণের ভিত্তিতে মানচিত্র তৈরির কাজই হত। পরে সেখানকার টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু হয় মহাকাশের অলিন্দে।

১৮৪৮ সালে, ম্যাড্রাস অবজারভেটরিতে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্টিফেন জ্যাকব টেলিস্কোপে চোখ রেখে একদিন দেখেন দু’টি তারা ঘুরে চলেছে। কিন্তু তারা কেপলারের সূত্র মানছে না। তাঁর দাবি ছিল, দু’টির মধ্যে একটির জায়গায় যদি কোনও গ্রহকে বসানো হয়, তবে তা কেপলারের সূত্রে মেনে চলছে। জ্যাকব ১৮৫৫ সালে ‘৭০ ওপিউচি’ নক্ষত্র যুগলের চারপাশে এক গ্রহের কথা মান্থলি নোটিস অব রয়্যাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই ভিনগ্রহের হদিস এখনও মেলেনি। তিনি ম্যাড্রাস অবজারভেটরির ডাইরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ১৮৪৯ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত। এই অবজারভেটরি ১৯০০ সালে কোডাইকানালে স্থানান্তরিত হয়। আর এখন কোডাইকানাল অবজারভেটরি, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধীনস্থ।

Advertisement

আরও পড়ুন : ‘রিচার্জেবল বিশ্ব’ গড়ার পথ দেখিয়ে নোবেল পেলেন তিন রসায়নবিদ

এর পর দীর্ঘ সময় কেটেছে। বহু মহাকাশ গবেষক গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথের নানান অংশে ভিনগ্রহের খোঁজ চালিয়েছেন। ১৯৯২ সালে কয়েকজন বিজ্ঞানী মহাকাশে পালসার বলে একটি অবজেক্টের কাছে কিছু গ্রহের উপস্থিতির কথা বলেন। তবে সেই তত্ত্ব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।

এর পর ১৯৯৫ সালে মিশেল মেয়র ও দিদিয়ার কুয়েলজ্, জেনেভা অবজারভেটরিতে নতুন একটি পদ্ধতি রেডিয়াল ভেলোসিটি বা ডপলার মেথড ব্যবহার করে সূর্যের মতো একটি নক্ষত্র ‘৫১ পেগাসি’-র চার পাশে একটি গ্রহকেও ঘুরতে দেখেন তাঁরা। নাম দেওয়া হয় ‘৫১ পেগাসি বি’। এক বছরের মধ্যেই মার্কিন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা সেটিকে কনফার্ম করেন। সেই প্রথম সৌরমণ্ডলের বাইরে কোনও গ্রহের সন্ধান মেলে।

আরও পড়ুন : ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন তত্ত্বে নতুন দিশা, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন তিন জন

মিশেল মেয়র ও দিদিয়ার কুয়েলজের এই আবিষ্কার নতুন উত্সাহ যোগায়, নতুন দিগন্ত খুলে দেয় মহাকাশ গবেষণায়। এ বার পৃথিবী জুড়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা প্রবল উত্সাহ নিয়ে টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে নেমে পড়েন নতুন ভিনগ্রহ আর সেই গ্রহে প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে। ধীরে ধীরে মহাকাশ গবেষণার এই দিকটি আরও বেশি করে পরিচিতি পেতে শুরু করে। জনপ্রিয়তাও লাভ করতে থাকে।

আজকের মহাকাশ গবেষণায় মিশেল মেয়র ও দিদিয়ার কুয়েলজের আবিষ্কার মহাকাশ গবেষণায় ভিনগ্রহের খোঁজকে নতুন দিগন্ত দেখিয়েছিল। এ বার তাঁদের সেই কাজকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হল। তবে পুরস্কার এলেও, বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্র নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ বার কি বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্রে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ হবে?

আমার আশা, মিশেল ও দিদিয়ারের এই প্রাপ্তি আরও বেশি অর্থসাহায্য আনবে ভিনগ্রহ খোঁজের গবেষণায়। এই পুরস্কার শুধু যে এই দুই বিজ্ঞানী (মিশেল মেয়র ও দিদিয়ার কুয়েলজ্ ) পেলেন তা নয়, এই পুরস্কার বিজ্ঞানের এই বিশেষ শাখার স্বীকৃতি।

মহাকাশ গবেষণার এই দিকটির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা সকলেই গত পাঁচ বছর ধরে আশা করছিলেন, মিশেল মেয়র নোবেল পাবেন। কিন্তু নানা কারণে সেটা পিছিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে মিশেল এবং তাঁর পোষ্ট ডক্টোরাল ছাত্র ও সহযোগী দিদিয়ার নোবেল পেলেন। আশা করা যায়, এ বার ভারতেও মহাকাশ গবেষণায় এই ক্ষেত্রটি আরও বেশি করে জনপ্রিয়তা লাভ করবে, আরও বেশি করে অর্থ বরাদ্দ হবে।

মিশেল মেয়রের নোবেল পাওয়ায় আমার খুশি হওয়ার আরও একটি ব়ড় কারণ হল, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ও সখ্যতা। মিশেলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৩ সালে আমদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা পিআরএল-এ। তার পর থেকে গবেষণা ও বই লেখার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ চলতে থাকে। নোবেল পাওয়ার খবর পাওয়ার পরই ব্যক্তিগত ভাবে মিশেলকে অভিনন্দন জানিয়েছি।

আমাদের দেশে এই ভিনগ্রহ খোঁজের বিষয়টি এতটা গুরুত্ব পায় না। তাঁর আশা, এ বার হয়তো আর একটু বেশি গুরুত্ব পাবে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়, এ বার এই ক্ষেত্রটিও হয়ত সেখান থেকে আর একটু বেশি টাকা পাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে আরও বেশি করে উত্সাহ তৈরি করবে। আরও বেশি করে তাঁরা এই শাখায় আসার জন্য আগ্রহী হবেন। তাই মিশেল ও দিদিয়ারের নোবেল প্রাপ্তিতে গোটা বিশ্বের সঙ্গে আশার আলো দেখাবে ভারতের মহাকাশ গবেষণাতেও।

(লেখক বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক, ভিনগ্রহ বিষয়ক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী)

ছবি সৌজন্যে- সুজন সেনগুপ্ত

অনুলিখন – অরূপকান্তি বেরা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন