না, আপনি আর ‘লিও’ নন! আপনার ‘রাশি’ বেমালুম বদলে গিয়েছে। হয় আপনি ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছেন ‘ভার্গো’। না হলে হয়েছেন ‘ক্যানসার’!
না, আপনি আর ‘লিব্রা’ও নন! আপনি পুরোপুরি বদলে গিয়ে হয়েছেন ‘ভার্গো’ বা ‘স্করপিয়াস’!
জানেন কি, আমার-আপনার তিন হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ভাগ্যচক্র আমূল বদলে গিয়েছে? ফলে, যে কোনও ‘সানডে ম্যাগাজিন’ বা ‘ট্যাবলয়েড’টা খুলে সবচেয়ে আগে ‘স্টার ওয়াচ’ পাতায় যাওয়ার পুরনো অভ্যাসটা এ বার অনিবার্য ভাবেই আপনাকে ঠকিয়ে দেবে! আপনার এত দিনের চেনা-জানা ‘লিও’-র সারা সপ্তাহ কেমন যাবে, জেনে নিয়ে সপ্তাহটা কাটাতে হলে এ বার ঠিক উল্টো ফল হবে! সপ্তাহটা ‘ভাল চলবে’ জেনে এগোলে দেখবেন, হয়তো সেই সপ্তাহেই আপনার চাকরি চলে গেল! আর ম্যাগাজিনের ‘স্টার ওয়াচ’-এ পড়া ‘মন্দ সপ্তাহটা’ই হয়তো দেখলেন, আপনার ঘরে লক্ষ্মী এনে দিল! মানে, আপনার চেনা-জানা ‘জোডিয়াক সাইন’ ধরে ‘স্টার ওয়াচ’ দেখে সপ্তাহটা কাটাতে চাইলে এ বার বেমালুম ঠকে যাবেন।
বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জ বা ‘কনস্টেলেশন’
ঠকতে ঠকতেই মানুষ শেখে, ঠেকতে ঠেকতেও! তাই এ বার সরাসরি আপনার জ্যোতিষীকে গিয়ে বলুন, ‘‘জন্মসময়, জন্মক্ষণ দেখে-টেখে ঠিকুজি-কোষ্ঠীতে যে রাশি বসিয়েছিলেন, তা দিয়ে তো আর কাজ হবে না। ‘ধনু’ রাশি হয়ে যেতে পারে ‘মেষ’ বা ‘বৃষ’, ‘মীন’, ‘বৃশ্চিক’ বা ‘কর্কট’ কিংবা ‘মিথুন’ও হতে পারে।’’
মানে, আমি-আপনি এত দিন যে ঠিকুজি-কোষ্ঠীকে প্রায় ‘গীতা’ বলে জেনে ও মেনে এসেছি, যার ঘর গুণে-টুনে আমাকে, আপনাকে জ্যোতিষী বলে দিয়েছেন, ‘‘আর দু’টো মাস অপেক্ষা করুন। ডিসেম্বর থেকে আপনার রোজগার এতটাই বেড়ে যাবে যে আপনি দশ আঙুলে দশটা হিরে পরে ঘুরবেন’’, সেই ঠিকুজি-কোষ্ঠী আমূল বদলে যাওয়ার সময় এসে গেল!
কেন?
আমরা এত দিন জানতাম, ‘জোডিয়াক সাইন’-এর সংখ্যা ১২। ইংরেজিতে ‘অ্যারিস’, ‘টরাস’, ‘জেমিনি’, ‘ক্যানসার’, ‘লিও’, ‘ভার্গো’, ‘লিব্রা’, ‘স্করপিও’, ‘স্যাজিটারিয়াস’, ‘ক্যাপ্রিকর্ন’, ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’ ও ‘পিসেস’। আর বাংলায় ‘মেষ’, ‘বৃষ’, ‘মিথুন’, ‘কর্কট’, ‘সিংহ’, ‘কন্যা’, ‘তুলা’, ‘বৃশ্চিক’, ‘ধনু’, ‘মকর’, ‘কুম্ভ’ ও ‘মীন’। গত তিন হাজার বছর ধরে ১২টি ‘জোডিয়াক সাইনে’র মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে আমাদের ভাগ্য!
কিন্তু নাসা বলছে, এ বার ‘জোডিয়াক সাইন’-এর সংখ্যাটাকে ১৩ ধরতে হবে। নতুন সেই ‘জোডিয়াক সাইন’টির নাম- ‘ওফিউকাস’। আর তার জন্য জন্মসময় অনুযায়ী আমাদের যে যে ‘রাশি’ বরাদ্দ করা হত, তা বদলে যাবে অনিবার্য ভাবেই। বদলে যাবে বাংলার ১২টি ‘লগ্ন’ও।
২০১৬-র সেপ্টেম্বরে নক্ষত্রপুঞ্জগুলির অবস্থান
নাসার সাম্প্রতিক গাণিতিক হিসেবনিকেশে কী ভাবে ‘জোডিয়াক সাইনে’র সংখ্যাটা ১২ থেকে ১৩ হয়ে গেল, সেটা বুঝতে হলে আগে সহজে বুঝে নিতে হবে ‘জোডিয়াক’ বা ‘জোডিয়াক সাইন’ আদতে কী জিনিস? ‘জোডিয়াক সাইন’ কীসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে? কেনই-বা ১২টি ‘জোডিয়াক সাইনে’র মধ্যেই এত দিন আমাদের ভাগ্য ঘোরাফেরা করেছে?
কেন আমার ‘লিও’, আপনার ‘ভার্গো’...
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘জোডিয়াক বলতে কী বোঝায়, প্রথমে সেটা একটু জেনে নেওয়া যাক। একটা সরলরেখা কল্পনা করুন, যেটা পৃথিবী থেকে টানলে সরাসরি সূর্যকে ফুঁড়ে সোজা গিয়ে পৌঁছবে মহাকাশে। এমনকী, তা আমাদের এই সৌরমণ্ডলকেও ছাড়িয়ে পৌঁছে যেতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম প্রান্তে। একটা আদ্যোপাল্ত সরলরেখা। সেই সরলরেখাটা গিয়ে যেখানে পৌঁছবে, সেখানে রয়েছে আমাদের সূর্যের মতো কোনও তারা বা নক্ষত্র (স্টার)। বা, আমাদের সূর্যের মতো বা চেহারায় তার চেয়ে অনেকটাই বড় তারা বা নক্ষত্রের একটা ঝাঁক, যাকে বলে নক্ষত্রমণ্ডলী বা নক্ষত্রপুঞ্জ বা ‘কনস্টেলেশন’। আমাদের জন্মের সময় পৃথিবী থেকে টানা ওই সরলরেখাটা সূর্যকে ফুঁড়ে ঠিক তার পিছনে থাকা যে নক্ষত্রপুঞ্জ বা ‘কনস্টেলেশন’-এ পৌঁছেছিল, সেটাই হয়ে ওঠে আমাদের ‘জোডিয়াক সাইন’। যেমন, আপনার জন্মের সময় ওই সরলরেখাটা যদি সূর্যকে ফুঁড়ে গিয়ে ঠিক তার পিছনে থাকা ‘লিও’ নক্ষত্রপুঞ্জে পৌঁছে থাকে, তা হলে আপনার ‘জোডিয়াক সাইন’ হবে ‘লিও’। এই ভাবেই এত দিন আমাদের জন্য আলাদা আলাদা ‘জোডিয়াক সাইন’ বা ‘রাশি’ বা ‘লগ্ন’ বরাদ্দ করতেন জ্যোতিষীরা। আর সূর্যের চার দিক দিয়ে পৃথিবীর পাক মারতে সময় লাগে পাক্কা ৩৬৫ দিন বা একটা বছর। এটাকেই আমরা বলি ‘আর্থ ইয়ার’। পার্থিব বছর। এই পাক মারার সময় পৃথিবী থেকে সূর্যকে ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া সরলরেখাটাও ঘুরতে থাকে। এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে। আপনার জন্মের সময় যে সরলরেখাটা ছিল ‘লিও‘ পর্যন্ত, এক বছর পর তা ‘ভার্গো’-মুখী হয়ে যেতেই পারে। সূর্যকে কেন্দ্র করে একটা চাকতি কল্পনা করলে তার ওপরে থাকা ওই নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থানকেই বলে ‘জোডিয়াক’।’’
নতুন ‘ভাগ্যচক্র’: জেনে নিন ‘ওফিউকাস’ কোথায়
‘জোডিয়াক সাইনে’ যেমন দেখানো হয়, নক্ষত্রপুঞ্জ বা ‘কনস্টেলেশন’গুলিকে অমন দেখতে হয় কেন?
নক্ষত্রপুঞ্জে তারা বা নক্ষত্রগুলি থাকে বিন্দুর মতো। সেগুলিকে সরলরেখা দিয়ে জুড়িলে তা কখনও মানুষের চেহারার আদল নেয়, কখনও বা কোনও প্রাণী কিংবা কোনও প্রাকৃতিক বস্তুর। সেই চেহারা দেকেই আমাদের ‘জোডিয়াক সাইন’গুলির ছবি আঁকা হয়েছিল ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়ে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে। আবার সেই আদলগুলিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমূল বা অনেকটাই বদলে যায়। কারণ, ওই নক্ষত্রপুঞ্জগুলি সূর্যের সাপেক্ষে তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। ওই নক্ষত্রপুঞ্জে থাকা তারা বা নক্ষত্রগুলিও তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। কিন্তু ওই ‘কনস্টেলেশন’গুলি আমাদের চেয়ে এতটাই দূরে রয়েছে যে, সেই অবস্থান বদল বা তার জন্য তাদের আদলে, চেহারায় বদলটা আমাদের চোখে ধরা পড়তে অনেক অনেক সময় লেগে যায়। একটা মানুষের গড় আয়ু সাধারণত যতটা হয়, অতটা অল্প সময়ে ওই নক্ষত্রপুঞ্জগুলির অবস্থান তেমন কিছু বদলায়ও না। তাই আমাদের জন্মের সময় জ্যোতিষীর বরাদ্দ করা ‘রাশি’ বা ‘জোডিয়াক সাইন’ মোটামুটি আমাদের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত অপরিবর্তিতই থাকে।
জোডিয়াক সাইনের জন্ম-রহস্য: কী ভাবে নক্ষত্রপুঞ্জগুলির চেহারা গড়ে ওঠে?
কারা বানিয়েছিলেন ‘জোডিয়াক সাইন’? তাঁরা কি কিছু ভুল করেছিলেন?
পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুধাকর রামস্বামী বলছেন, ‘‘প্রায় তিন হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময় ওই ‘জোডিয়াক সাইন’গুলি বানানো হয়েছিল। আমাদের ক্যালেন্ডারে যেহেতু ১২টি মাস, তাই সেই সময় গোটা ‘জোডিয়াক’টাকেই মোট ১২টি ‘জোডিয়াক সাইনে’ ভাগ করে নিয়েছিলেন ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষ। তার মানে, প্রতিটি ‘জোডিয়াক সাইনে’র জন্য তাঁরা কম-বেশি এক মাস করে সময় বরাদ্দ করেছিলেন। তাঁরা কিন্তু ১৩ নম্বর ‘কনস্টেলেশন’ বা নক্ষত্রপুঞ্জের কথা জানতেন। কিন্তু ক্যালেন্ডারের মাসের সংখ্যার সঙ্গে মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার মানুষ ইচ্ছাকৃত ভাবেই ১৩ নম্বর ‘কনস্টেলেশন’ -- ‘ওফিউকাস’কে অস্বীকার করেছিলেন। মানে, ‘জোডিয়াক সাইনে’র জন্মদাতারা জেনেশুনেই একটি ভুল করেছিলেন। শুধু একটি নয়। তাঁরা বেশ কয়েকটি ভুল করেছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, সব নক্ষত্রপুঞ্জেরই চেহারা এক রকম আর তাদের অবস্থান সূর্য ও পৃথিবীর সাপেক্ষে একই বাবে বদলায়। যদিও আদতে নক্ষত্রপুঞ্জগুলি আকারে ও চেহারায় একেকটা এক-এক রকমের। তার ফলে, পৃথিবী থেকে টানা যে সরলরেখাটা সূর্যকে ফুঁড়ে সরাসরি তার পিছনে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জে পৌঁছয়, তা একেকটি নক্ষত্রপুঞ্জের জন্য একেক রকম সময় পর্যন্ত ঠিক ওই সরলরেখাই থাকে। তার পর সেটি বদলে য়ায়। যেমন, ওই সরলরেখাটা ‘ভার্গো’ নক্ষত্রপুঞ্জ পর্যন্ত সরলরেখাই থাকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। কিন্তু ‘স্করপিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জের জন্য সেটা সরলরেখা থাকে ৭ দিন পর্যন্ত।’’
এখন কোন মাসের কোন সময়ে কী রাশি বা জোডিয়াক সাইন হল আপনার
নাসা কী করল?
টুইটারে নাসার বিবৃতি
রামস্বামীর কথায়, ‘‘আমরা অঙ্ক কষে এ বার ১৩ নম্বর নক্ষত্রপুঞ্জকে (ওফিউকাস) স্বীকৃতি দিয়েছি। যা এত দিনের এই ভুলটা অঙ্ক কষে শুধরে দিয়েছে। ওই নক্ষত্রপুঞ্জটির জন্য জোডিয়াকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জগুলির অবস্থানে বেশ কিছুটা রদবদল হয়েছে। আর এটাই এখন ওই নক্ষত্রপুঞ্জগুলির আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত অবস্থান।’’
ছবি সৌজন্য : নাসা।
আরও পড়ুন- বড় চমক মহাকাশে, ভোরে ঘন কুয়াশায় যেন জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট!