Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Science

বড় চমক মহাকাশে, ভোরে ঘন কুয়াশায় যেন জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট!

এ বার চমকে দিল মহাকাশও! মহাকাশের অতল অন্ধকারে টেলিস্কোপের ‘চোখে’ ধরা পড়ল বহু বহু দূরের একটি আলোক-শিখা। যেন ভোরে ঘন কুয়াশায় সেখানেও জ্বলছে রাত-কাটানো ল্যাম্পপোস্ট।

দাউদাউ জ্বলছে আগুনের গোলা।

দাউদাউ জ্বলছে আগুনের গোলা।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১০:৪১
Share: Save:

শীত-ভোরে মর্নিং ওয়াক-এ বেরিয়ে নিশ্চয়ই দেখেছেন, চাপ চাপ কুয়াশায় ঢেকে আছে চার পাশ। ঘন, খুব ঘন কুয়াশা। এতটাই ঘন, ফুটখানেক দূরের রাস্তাটাও ঠাওর করা যাচ্ছে না। ঘন কুয়াশায় কিছু ঠাওর করা যায় না বলেই শীত-ভোরের হিম-ঠাণ্ডায় ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায় দুনিয়ার সব এয়ারপোর্টেই। সমুদ্রে জাহাজের নেভিগেশন সিস্টেমকে আরও শক্তিশালী করতে হয়। ওই অত ঘন কুয়াশায় শীত-ভোরে মর্নিং ওয়াকে বেরনো আমাকে, আপনাকে শুধু পথ দেখায় রাস্তায় দু’পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলো। টাইমারে সময় বেঁধে দেওয়া থাকে বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। সময় ফুরোয়নি বলে তখনও জ্বলছে। কিন্তু চাপ চাপ কুয়াশায় ফিকে হয়ে গিয়েছে তার আলো। যেন অনুষ্ঠান চুকেবুকে যাওয়ার পর প্রাক-ভোরে বিয়ে বাড়ির সামিয়ানার নিঃসঙ্গ আলো!

এ বার চমকে দিল মহাকাশও! মহাকাশের অতল অন্ধকারে টেলিস্কোপের ‘চোখে’ ধরা পড়ল বহু বহু দূরের একটি আলোক-শিখা। যেন ভোরে ঘন কুয়াশায় সেখানেও জ্বলছে রাত-কাটানো ল্যাম্পপোস্ট। মহাকাশের অতল অন্ধকারে কেন সেই আলো, কোথা থেকে আসছে সেই আলো, সেই আলোর জন্ম-রহস্যের ঠিকুজি-কোষ্ঠীটা ঠিক কেমন, এই প্রথম তা স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ল শক্তিশালী ‘আটাকামা লার্জ মিলিমিটার অ্যারে’ (আলমা) টেলিস্কোপের নজরে।


জ্বলছে ‘ল্যাম্পপোস্ট’, মহাকাশে!

এই নজরকাড়া আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ। আর তার পর শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন।

মহাকাশের অত সুদূর প্রান্তে অতটা বিশাল এলাকা জুড়ে কী জ্বলছে? অত দিন ধরে তা জ্বলছে কী ভাবে? কেনই-বা জ্বলছে? কী তার কারণ?

গত ১৬ বছর ধরে এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাননি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কৌতুহল মেটেনি গত দেড় দশকে। হালের ওই আবিষ্কারের গুরুত্ব এটাই যে, তা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গত দেড় দশকের প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পেরেছে।


জ্বলছে ‘ল্যাম্পপোস্ট’, মহাকাশে!


কেন ‘কুয়াশায় ঢাকা’ ওই ‘ল্যাম্পপোস্টে’র আলো মহাকাশে?

সেগুলি কী কী?

অন্যতম গবেষক ব্রিটেনের হার্টফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স রিসার্চের সিনিয়র প্রফেসর অনাবাসী ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী হরিশ দালভে বলছেন, ‘‘প্রথমত, জানা গিয়েছে, মহাকাশের অত সুদূর প্রান্তে দাউদাউ করে জ্বলছে হাইড্রোজেন গ্যাসের অসম্ভব ঘন মেঘ। দ্বিতীয়ত, জানা গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে হাইড্রোজেন গ্যাসের ওই অসম্ভব ঘন মেঘ। তৃতীয়ত, জানা গিয়েছে, ওই সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন গ্যাসের ওই অসম্ভব ঘন মেঘ আমাদের এই সৌরমণ্ডল থেকে রয়েছে অনেক অনেক দূরে। কতটা দূরে, তা কল্পনা করাটাও খুব কঠিন। সহজে বুঝতে হলে ভাবুন, সেই ‘ঘন কুয়াশা’য় ঢাকা ‘ল্যাম্পপোস্ট’-এর আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছতেই সময় নিয়েছে সাড়ে ১১০০ কোটি বছর। আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের আগে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহা-বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৩৭০ কোটি বছর আগে। অর্থাৎ, তার ঠিক ২০০/২২০ কোটি বছর পরেই যে আলোক-শিখা বেরিয়ে এসেছিল ওই ঘন সুবিস্তীর্ণ হাইড্রোজেন গ্যাসের মেঘ থেকে, সেটাই এখন পৌঁছেছে পৃথিবীতে। টেলিস্কোপের ‘চোখে’ ধরা পড়েছে। এর অর্থ, ওই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘের জন্ম হয়েছিল ‘বিগ ব্যাং’-এর সামান্য কিছু পরেই। চতুর্থত, জানা গিয়েছে, কেন ওই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘের ভেতর থেকে এত দিন ধরে বেরিয়ে আসছে আলোর শিখা। কেন মনে হচ্ছে, সেটা শীত-ভোরের ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো।’’


সেই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘ জ্বলছে!


মহাকাশের সেই ‘ল্যাম্পপোস্ট’!

মহাকাশের অতল অন্ধকারে কেন জ্বলছে ওই ‘ল্যাম্পপোস্টের আলো’? কেন জ্বলছে ওই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন সুবিস্তীর্ণ মেঘের পুরু একটা চাদর?

সহযোগী গবেষক অনাবাসী ভারতীয় পেনসিলভানিয়ার হ্যাভারফোর্ড কলেজের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর দেশিকা নারায়ণন বলছেন, ‘‘ওই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন সুবিস্তীর্ণ মেঘের পুরু চাদরের ঠিক মাঝখানে দু’-দু’টি বিশাল গ্যালাক্সি রয়েছে। আর সেই দু’টি গ্যালাক্সিতেই প্রচুর পরিমাণে নতুন নতুন তারার, নতুন নতুন সৌরমণ্ডলের জন্ম হচ্ছে। প্রায় প্রতি মূহুর্তেই। ঝড়ের গতিতে। আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তে নতুন নতুন তারার জন্ম হচ্ছে যে হারে, তার চেয়ে ১০০ গুণ গতিতে। ফলে, চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে আগুনের গোলা। উঠছে, নামছে, ছুটছে, ছড়িয়ে পড়ছে। আর তার জন্যই ওই আলোর শিখার জন্ম হচ্ছে। ওই দু’টি গ্যালাক্সি নিজেদের দিকে এগিয়েও আসছে খুব দ্রুত গতিতে। আর এক দিন ওই দু’টি গ্যালাক্সিই মিলে-মিশে গিয়ে একটি সুবিশাল গ্যালাক্সি হয়ে যাবে। যাকে ঘিরে থাকবে ছোট ছোট আরও অনেক গ্যালাক্সি। জন্ম হবে নতুন একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সি-ঝাঁকের। ওই সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকা হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘের পুরু চাদরটাকে বলে ‘লিম্যান-আলফা ব্লব’। যারা ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বের এলাকা জুড়ে। আর ওই হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘের পুরু চাদরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর শিখাকে বলে ‘লিম্যান-আলফা রেডিয়েশন’। ওই রেডিয়েশন বা বিকিরণের আদত কারণটা হল, নতুন নতুন তারার জন্মের সময় প্রচণ্ড পরিমাণে যে তাপ সৃষ্টি হচ্ছে, সেখান থেকেই তৈরি হচ্ছে আলট্রাভায়োলেট রে বা অতিবেগুনি রশ্মি বা বিকিরণ। আর সেই রশ্মি বা বিকিরণই হাইড্রোজেন গ্যাসর ঘন মেঘের পুরু চাদরে পরে এ দিক ও দিকে ঠিকরে বেরচ্ছে। ছিটকে বেরচ্ছে। তার ফলেই আমরা মহাকাশের অতল অন্ধকারে ওই ‘ল্যাম্পপোস্ট’-এর আলো দেখতে পাচ্ছি।’’


ঘন গ্যাসের চাদর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে সেই আলো...


আরও সহজে বুঝতে চান গোটা ব্যাপারটা?

মূল গবেষক ব্রিটেনের হার্টফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স রিসার্চের সিনিয়র প্রফেসর বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিম গিচ তাঁর ‘আলমা অবজার্ভেশন অফ লিম্যান-এ ব্লব ওয়ান: হ্যালো সাব-স্ট্রাকচার ইল্যুমিনিটেড ফ্রম উইদিন’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘শীতের ভোরে ঘন কুয়াশায় ঢাকা ল্যাম্পপোস্টের কথা ভাবুন। কুয়াশার খুব ছোট ছোট জলের কণার ওপর পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোর যে বিচ্ছুরণ হয়, তার ফলেই ওই আবছা ঝিরঝিরে আলো দেখা যায় ল্যাম্পপোস্টের। একই ঘটনা ঘটছে মহাকাশে। সেখানে ওই ‘ল্যাম্পপোস্টের আলো’টা বেরিয়ে আসছে ওই নতুন নতুন তারার জন্ম দেওয়া গ্যালাক্সিগুলি থেকে। আর ‘কুয়াশা’টা হল হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন মেঘের পুরু চাদরের।’’

আরও পড়ুন- এ বার ফেলে যাওয়া চুলই ধরিয়ে দেবে ক্রিমিনালকে

এটাই কী আমাদের পৃথিবী? এ ভাবে পাল্টে দিয়েছি আমরা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE