Science News

মেধা নয়, ওঁর প্রাণশক্তির কথা আগে মনে আসে

অনেকে আবার বলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর হকিংয়ের মতো আর কারও নাম জনমানসে এ ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। আমার মনে হয়, এর পিছনে বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে।

Advertisement

অমিতাভ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৮ ১৮:২৮
Share:

স্টিফেন হকিং অসামান্য পদার্থবিদ ছিলেন, সন্দেহ নেই! তবে তাঁর সম্পর্কে লিখতে বসে প্রথমেই যা আমার মনে আসে, তা হল তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তির কথা।

Advertisement

১৯৬৩-তে মাত্র ২১ বছর বয়সে মারাত্মক স্নায়ুর অসুখ এএলএস (অ্যামিয়োট্রপিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস)-এ আক্রান্ত হন। চিকিৎসকেরাও জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। অন্য কেউ হলে কিছু করতে পারতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তবে হকিং পদার্থবিদ্যার জগতে অসাধারণ সৃজনশীলতা দেখিয়েছিলেন। হকিং-ই দেখিয়েছেন, জীবনে যতই বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, তা সত্ত্বেও এগিয়ে যেতে হবে। আমার মনে হয়, এই বিষয়টি শিক্ষণীয়।

আমাদের গবেষণাক্ষেত্রটিকেই ধরুন না! অনেকেই অনুযোগ করেন যে, ‘অনেক কিছুই তো করতে পারতাম। তবে এ দেশে গবেষণা করায় অনেক অসুবিধা রয়েছে।’ স্টিফেন হকিং কিন্তু নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অনেক কিছুই করে দেখিয়েছেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন স্টিফেন হকিং।

Advertisement

আরও পড়ুন
মুম্বইয়ের সেই সন্ধ্যা, ছাঁইয়া ছাঁইয়ায় দুলে চলেছেন তিনি...

পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে হকিং যে সব কাজ করেছেন তার গুরুত্ব অসীম। তাঁর সিঙ্গুলারিটি থিওরম বা হকিং রেডিয়েশন-এর তুলনা হয় না। তবে আমার মতে, এ সবের থেকেও তাঁর মানসিক দৃঢ়তা আরও অতুলনীয়। হকিং যদি ওই সব কাজ না করতেন, তবে হয়ত অন্য কোনও বৈজ্ঞানিক সে কাজ করতেন। কিন্তু, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এক জন মানুষ কত দূর যেতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে উঠে এলেন তিনি। আমার মনে হয়, সে জন্যই ওঁকে আমাদের মনে রাখতে হবে।

অনেকে আবার বলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর হকিংয়ের মতো আর কারও নাম জনমানসে এ ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। আমার মনে হয়, এর পিছনে বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে। প্রথমত, হকিং অসাধারণ গবেষণা করেছেন। দ্বিতীয়ত, একাধিক বেস্টসেলার বই লিখেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এর মতো বই। তৃতীয়ত, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ওঁকে অন্য এক মাত্রায় তুলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন
শিশুর মতো সহজ-সরল ছিলেন হকিং

শুধুমাত্র স্টিফেন হকিংয়ের গবেষণার সঙ্গে পরিচয় নয় বা তাঁর বইপত্র পড়াই নয়, স্টিফেন হকিং-কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগও হয়েছিল। সালটা ১৯৯৮। আমার বয়স তখন ছেচল্লিশ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স অ্যান্ড থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স-এর ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজ করছি। একটি সেমিনারে তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম। হুইলচেয়ারে বসে, কণ্ঠস্বর হারিয়েছেন, সিন্থেটিক ভয়েসের মাধ্যমে ভাষণ দিচ্ছেন, প্রশ্ন করছেন, আবার প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন। আমার প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন। একেবারে আর পাঁচটা বৈজ্ঞানিকের মতো। যেন কোনও প্রতিবন্ধকতাই নেই তাঁর শরীরে। একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এই ‘স্বাভাবিক’ থাকাটা বজায় রেখেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সময়েও। ‘লুকাসিয়ান প্রফেসরশিপ’ ছিল তাঁর। আইজ্যাক নিউটনে এক সময় এই চেয়ারে ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বৈজ্ঞানিকদের মতো হকিং সাতসকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতেন। আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি কোনও দিন। নিয়মিত ডিপার্টমেন্টে আসতেন।

আরও পড়ুন
ফিল্মে, কমিকসে, গানে, কোথায় নেই হকিং

আরও একটি বিষয় আজ মনে পড়ছে। আমি তাঁর বহু সেমিনারে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। পদার্থবিদ্যার গুরুগম্ভীর বিষয়গুলি এমন স্পষ্ট করে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারতেন হকিং, তা ভোলার নয়! যাঁরা তা শুনছেন, তাঁদের কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। আবার পিএইচডি-র ছাত্র হিসেবে যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন, তখনও যে ভাবে জটিল এবং নতুন বিষয় সহজ ভাবে বিশ্লেষণ করছেন, তা-ও অবাক করার মতো। সম্প্রতি হকিংয়ের পিএইচডি থিসিস প্রকাশ করেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ডেনিস শায়ামার তত্ত্বাবধানে সেই থিসিস লিখেছিলেন তিনি। তা পড়ে দেখেছি আমি। কোনও থিসিস যে এমন যত্ন নিয়ে লেখা যায় তা-ও উল্লেখ করার মতো বিষয়।

এত কিছুর মাঝে হকিংয়ের নোবেল না পাওয়ার প্রসঙ্গটিও বার বার উঠে আসছে। আমার মতে, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল না পেলেও তাতে তাঁর অবদান কিছু কমে যায় না। হকিংয়ের সিঙ্গুলারিটি থিওরম বা হকিং রেডিয়েশন-এর মতো তত্ত্ব-ই তার প্রমাণ। ৫০ বা ১০০ বছর পরেও অনেক নোবেল প্রাপকদের কাজের থেকেও হকিং-এর কাজ মনে রাখবেন মানুষ।

(লেখক পদার্থবিদ্যার প্রফেসর এমেরিটাস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন