ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের এই গোটা প্রক্রিয়া টাইম-ল্যাপ্স কায়দায় রেকর্ড করা হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, ভ্রূণ থলির গায়ে লেগে থাকছে না। তা সজোরে ধাক্কা মারছে! ছবি: ভিডিয়ো।
শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে তৈরি হয় মানবভ্রূণ (এমব্রায়ো)। তার পরেই মাতৃজঠরে শিশুর শরীর গড়ে ওঠার নানা প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় নতুন জীবনের স্পন্দন! এ কথা আমাদের জানা। কিন্তু মায়ের জরায়ুতে কী ভাবে ভ্রূণের প্রতিস্থাপন ঘটে, তা এত কাল স্বচক্ষে দেখেননি বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম বার সেই প্রক্রিয়া নিজেদের চোখে দেখে চমকে গেলেন তাঁরা।
বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব শিশুর জন্ম প্রায় সাড়ে চার দশক আগে। এই প্রক্রিয়ায় মানুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে আলাদা ভাবে সংগ্রহ করে কৃত্রিম উপায়ে টেস্ট টিউবে তাদের নিষিক্ত (ফার্টিলাইজ়েশন) করানো হয়। তার পর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করতে হয় ওই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় কৃত্রিম উপায়ে এ বার সেই মাতৃজঠর তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার পর তাতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে। মাতৃদেহে ‘অ্যামনিয়োটিক স্যাক’ বা থলির নিরাপদ আশ্রয়েই ভ্রূণ থেকে শিশু পূর্ণতা পায়। আক্ষরিক অর্থে তা ‘লাইফ স্যাক’ বা ‘জীবনথলি’। বিশেষত গর্ভাবস্থার একেবারে শুরুতে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড বা তরল ভর্তি ওই থলিতে ভ্রূণের ক্রমবিকাশ ঘটে। এ ক্ষেত্রেও সে রকমই একটি থলি তৈরি করা হয়েছিল। তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল কোলাজেন জেল। কোলাজেন এক ধরনের প্রোটিন, যা মানবশরীরের কলায় (টিস্যুতে) থাকে।
বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিস্ট)-র গবেষক স্যামুয়েল ওজোসনেগ্রোস এবং তাঁর দল এই গবেষণা চালিয়েছেন। তা প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, শুক্রাণু-ডিম্বাণুর নিষেক ঘটিয়ে তৈরি ভ্রূণের আচরণ বুঝতে এত দিন ইঁদুরের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চলত। তা থেকেই মানবশরীর সম্পর্কে খানিক আন্দাজ করা যেত। এ বার মানবভ্রূণ নিয়েও পরীক্ষা চালানো হল।
মায়ের জরায়ুতে কী ভাবে ভ্রূণের প্রতিস্থাপন ঘটে, তা এত কাল স্বচক্ষে দেখেননি বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম বার সেই প্রক্রিয়া নিজেদের চোখে দেখে চমকে গেলেন তাঁরা। ছবি: ভিডিয়ো।
কিন্তু কী ভাবে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হল? স্যামুয়েল জানান, মানুষের শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষেক ঘটিয়ে যে ভ্রূণ তৈরি করা হয়েছিল, তা-ই ফেলে দেওয়া হয় জ্যালজেলে-আঠালো ওই থলিতে। গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ওই ভ্রূণ আসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষের ঝাঁক, যেগুলি মানবভ্রূণের একেবারে আদি পর্বের মতো কাজ করে। ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের এই গোটা প্রক্রিয়া টাইম-ল্যাপ্স কায়দায় রেকর্ড করা হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, ভ্রূণ থলির গায়ে লেগে থাকছে না। তা সজোরে ধাক্কা মারছে! ধাক্কা মেরে ‘মাতৃগর্ভে’ প্রবেশের চেষ্টা করছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, ইঁদুরের ভ্রূণের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে না। মাতৃগর্ভে প্রবেশের জন্য এতটাও সক্রিয় হয় না ইঁদুরের ভ্রূণ। এর থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, ইঁদুরের ভ্রূণ এবং মানবভ্রূণের মধ্যে আচরণগত ফারাক প্রচুর।
ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের এই প্রক্রিয়াই বিজ্ঞানীদের কাছে এত দিন রহস্যের মতো ছিল। আদতে কী ঘটে, তাঁরা জানতেন। কিন্তু কখনও চোখে দেখেননি। এ বার কৃত্রিম উপায়ে মানবভ্রূণ প্রতিস্থাপনের সেই প্রক্রিয়া ‘ভিডিয়ো রেকর্ডিং’ করে যা পাওয়া গেল, তাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ উদ্ধারের সঙ্গেই তুলনা করছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রসঙ্গত, কোথাও কোনও বিমান দুর্ঘটনা হলে, সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় এই ‘ব্ল্যাক বক্স’ নিয়ে। আসলে বিমানে থাকা ‘ব্ল্যাক বক্স’ পরীক্ষা করেই জানা যায়, কী ভাবে সেই বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মানবভ্রূণের যে আচরণ ধরা পড়ল, তা ভবিষ্যতে গবেষণার নতুন দিক খুলে দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
অন্তত ৬০ শতাংশ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে থাকে সঠিক ভাবে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন না হওয়ার কারণে। বিজ্ঞানীদের আশা, সাম্প্রতিক গবেষণায় যা জানা গেল, তাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের গর্ভপাতের ঘটনা আটকানো গেলেও যেতে পারে। তবে আরও পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন। যেমন, মাতৃজঠর তৈরিতে যদি অন্য কোনও তরল ব্যবহার করা হত, সে ক্ষেত্রেও মানবভ্রূণের আচরণ এক হত? এই প্রশ্নের উত্তর অজানা।