গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মানব-মস্তিষ্ক এখনও গোলকধাঁধা। এত গবেষণার পরেও মস্তিষ্কের সমস্ত রহস্যের উন্মোচন সম্ভব হয়নি। কোন পরিস্থিতিতে মানুষ কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয় বিজ্ঞানীদের কাছে। তারই আভাস পেতে ইঁদুরের মস্তিষ্কের উপর গবেষণা চালিয়ে কিছুটা আন্দাজ পেলেন তাঁরা। জানা গেল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট ‘নেতা’ নেই মস্তিষ্কে। সকলে মিলেজুলে সেই সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক যেমনটা গণতন্ত্রে হয়!
অন্তত ২২টি ল্যাবরেটরির গবেষকেরা (নিউরোসায়েন্টিস্ট) মিলে এই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মস্তিষ্কের কোনও একটি নির্দিষ্ট অংশ নয়, বরং সমস্ত অংশই প্রায় সমান সক্রিয় থাকে! এই ফল মস্তিষ্কের কাজের পদ্ধতি নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী পল গ্লিমচার বলেন, ‘‘অভূতপূর্ব ফল মিলেছে। এই গবেষণা স্নায়ুবিজ্ঞানের জগতে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। মস্তিষ্কের এত সুনির্দিষ্ট এবং সম্পূর্ণ মানচিত্র এর আগে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।’’
শরীরের সবচেয়ে জটিল অঙ্গই হল মস্তিষ্ক। তার গঠনগত ও কার্যগত একক নিউরন। মস্তিষ্ক কী ভাবে কাজ করে, তা বুঝতে সাধারণত নিউরনের উপরেই নজর দেন বিজ্ঞানীরা। এত কাল তাঁরা একসঙ্গে বড়জোর ১০০টি নিউরনের তথ্য জোগাড়় করতে পারতেন। মস্তিষ্কে লাখ লাখ নিউরনের মধ্যে মাত্র এই ১০০টি নিউরনের গতিবিধির তথ্য কখনওই স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি বিজ্ঞানীদের। কিন্তু এ বার গোটা মস্তিষ্ক জুড়েই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অন্তত ছ’লক্ষ নিউরনের তথ্য সংগ্রহ করেছেন গবেষকেরা। যার ফলে একটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের অন্তত ৯৫ শতাংশ অংশেই উঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ জার্নালে।
একটি নিউরনের বৈদ্যুতিক সঙ্কেত সংগ্রহের জন্য এত কাল ইলেকট্রোড ব্যবহার করে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। ১০০টি নিউরনের তথ্য পেতে বছরের পর বছর লেগে যেতে গবেষকদের। এ বার তাঁরা ‘নিউরোপিক্সেল’ নামে একটি যন্ত্র ব্যবহার করেছেন। সেই যন্ত্র একসঙ্গে হাজার হাজার নিউরনের গতিবিধির তথ্য পাবে।
বিজ্ঞানীরা জানান, এই গবেষণায় ইঁদুরের মাথায় ইলেকট্রোড হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পর সেটিকে একটি স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিয়েছিলেন গবেষকেরা। ওই স্ক্রিনে একটি সাদা-কালো বল কখনও ডান দিকে, কখনও বাঁ দিকে ফুটে উঠছিল। ইঁদুরের কাজ ছিল, একটি চাকা ঘুরিয়ে বৃত্তটিকে মাঝখানে আনা। আর সেটা করতে পারলেই চিনি-জল দেওয়া হত ইঁদুরকে। এই কাজ করার সময়েই ‘নিউরোপিক্সেল’ ব্যবহার করে ইঁদুরের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সঙ্কেত রেকর্ড করেছেন গবেষকেরা।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, চাকা ঘোরানোর সময় ইঁদুরের মস্তিষ্কের প্রথম কার্যকলাপ শুরু হয় পিছনের দিকে। সেখানেই চোখে দেখা কোনও কিছুর তথ্য বিশ্লেষিত হয়। তার পর ধীরে ধীরে সক্রিয় হয় মস্তিষ্কের বাকি অংশ। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক আলেকজ়ান্দ্রে পুগেট বলেন, ‘‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মস্তিষ্কের কোনও নির্দিষ্ট অংশ নয়, বরং মস্তিষ্কের সব অংশই নিজেদের মতো করে কাজ করে। সক্রিয় থাকে।’’
গবেষকেরা জানান, মাঝেমাঝে স্ক্রিনের সাদা-কালো বলটিকে তাঁরা মুছেও দিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে চাইছিলেন, বল দেখতে না পেলেও ইঁদুরগুলি কোনও ভাবে চাকা ঘুরিয়ে সেটিকে স্ক্রিনের মাঝখানে আনতে পারে কি না।
পুগেট বলেন, ‘‘এটাকেই আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতা বলি। আসলে আমরা প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্তই নিই এই পূর্ব অভিজ্ঞতা মেনে।’’ এই ফলাফলের জন্য একটি ভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।