Fossil Shell

ডাইনোসর যুগের এই জীবাশ্মগুলি কেন রামধনু রঙের খেলা দেখায়? রত্ন-রহস্যে ইতি পড়ল রসায়নবিদদের নয়া গবেষণায়

ডাইনোসরদের সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়ে যায় এই সামুদ্রিক প্রাণীগুলি। এদের কিছু জীবাশ্মে রামধনু রঙ খেলা করে। কেন? কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই জীবাশ্মের ভিতরে! এত দিনে তা জানা গেল রসায়নবিদদের এক গবেষণায়।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৭
Share:

কানাডায় পাওয়া অ্যামোনাইটের জীবাশ্মে এমন উজ্জ্বল রঙের খেলা দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্যারিসের লুভ্‌র জাদুঘর থেকে চুরি যাওয়া রত্নসম্ভার এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আরেক রত্ন-রহস্যের সমাধান করে ফেললেন বিজ্ঞানীরা। এই জীবাশ্ম-রত্নগুলিতে উজ্জ্বল রামধনু রঙের খেলা চলে। কিন্তু কেন, তা দীর্ঘ দিন অস্পষ্ট ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। এ বার সেই ধোঁয়াশা কাটাল সাম্প্রতিক গবেষণা।

Advertisement

এই জীবাশ্ম-রত্নের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে কোটি কোটি বছরের পুরনো ইতিহাস। জুড়ে রয়েছে শামুক জাতীয় এক প্রাগৈতিহাসিক সামুদ্রিক প্রাণী। নাম অ্যামোনাইট। ডাইনোসর যুগে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াত ওরা। শামুকের মতো ওদেরও খোলস ছিল। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসরদের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায় ওরাও। বিলুপ্তির এত বছর পরেও অনেক অ্যামোনাইটের খোলস ভীষণ ভাবে ‘প্রাণবন্ত’।

প্রাগৈতিহাসিক এই সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, তাদের জীবাশ্ম এখনও রয়ে গিয়েছে পৃথিবীতে। ওই জীবাশ্মের অনেকগুলিতেই খোলসের মধ্যে উজ্জ্বল রঙের খেলা দেখা যায়। এই রামধনু-রঙা জীবাশ্মগুলিকে বলে অ্যামোলাইট, এক মূল্যবান জৈবিক রত্ন-পাথর। চড়া দামে তা বিক্রিও হয়। কানাডায় রকি পর্বতমালার কাছে আলবার্টায়, বিশেষ করে সেন্ট মেরি নদীর ধারে এগুলি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

Advertisement

অ্যামোনাইটের অন্য জীবাশ্মগুলির খোলসেও এই রঙগুলি রয়েছে। তবে তা আলবার্টায় পাওয়া রামধনু-জীবাশ্মের মতো উজ্জ্বল নয়। কেন শুধু একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির অ্যামোনাইটের খোলসেই এই রামধনু রঙের খেলা দেখা যায়, সেই রহস্যভেদ করতে সম্প্রতি এক গবেষণা চালান জাপানের কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা রসায়নবিদ হিরোকি ইমাই।

বিশ্বে যেখানে কোনও না কোনও সময়ে মহাসাগর ছিল, এমন প্রায় সর্বত্রই অ্যামোনাইটের জীবাশ্ম পাওয়া যায়। তবে উজ্জ্বল রঙা এই জীবাশ্মগুলির বেশির ভাগই মেলে কানাডার অ্যালবার্টা এলাকায়। গবেষকেরা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দু’টি ভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া অ্যামোনাইটের ‘ন্যাক্র’ (শামুক বা ঝিনুক জাতীয় প্রাণীর খোলসের ভিতরে প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে তৈরি এক খনিজ-সমৃদ্ধ তরলের স্তর)-র গঠন বিশ্লেষণ করেন। ঝিনুকের খোলসে এই স্তরের মধ্যেই মুক্তো তৈরি হয়, তাই এটিকে ‘মাদার অফ পার্ল’ও বলে। জীবিত হোক বা মৃত, শামুক জাতীয় সব প্রাণীর খোলসেই এই স্তর পাওয়া যায়।

গবেষণার জন্য কানাডার অ্যামোনাইটের রামধনু-জীবাশ্ম এবং মাদাগাস্কার থেকে পাওয়া অন্য অ্যামোনাইটের জীবাশ্ম বেছে নেন রসায়নবিদেরা। পাশাপাশি বিলুপ্ত হয়নি, এমন দু’ধরনের শামুক জাতীয় প্রাণী— অ্যাবালন এবং নটিলাসের খোলসও বিশ্লেষণ করেন তাঁরা। পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে অ্যাবালন খাওয়ার চল রয়েছে। অন্য দিকে নটিলাস হল এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী, যাদের শরীরে বহু বছর ধরে বিশেষ পরিবর্তনই হয়নি। এগুলিকে বলা হয় জীবন্ত জীবাশ্ম। গবেষকেরা এই চার ধরনের নমুনার খোলসের মধ্যে অ্যারাগনাইট প্লেট বিশ্লেষণ করে দেখেন। অ্যারাগনাইট হল ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের একটি রূপ, যা শামুক বা ঝিনুক জাতীয় প্রাণীর খোলস তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

প্রতিটি নমুনাতেই গবেষকেরা অ্যারাগনাইট খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু অ্যারাগনাইটের স্তরের পুরুত্ব প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা। স্তরগুলির মধ্যে কিছু ছোট ছোট ছিদ্রও রয়েছে। সেগুলিও এক এক ক্ষেত্রে এক এক ধরনের। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, রামধনু-জীবাশ্মের খোলসের মধ্যে থাকা অ্যারাগনাইটের স্তরে এক একটি ছিদ্র প্রায় চার ন্যানোমিটার (এক সেন্টিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগে এক ন্যানোমিটার হয়) চওড়া। প্রতিটি ছিদ্র রয়েছে সমান ব্যবধানে।

গবেষকেরা জানান, অ্যারাগনাইটের স্তর কতটা পুরু, তার উপর নির্ভর করে এই ফাঁকগুলি থেকে আলোর নির্দিষ্ট রঙ প্রতিফলিত হয়। গবেষণায় অন্য নমুনাগুলির ক্ষেত্রে এই ছিদ্রের ব্যবধান, কম-বেশি রয়েছে। তাই সেগুলি থেকে এমন উজ্জ্বল রঙ বিচ্ছুরিত হয় না। গত মাসের শেষে ‘সায়েন্টিক রিপোর্ট্‌স’ জার্নালে এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। গবেষকদলের প্রধান ইমাইয়ের কথায়, “অ্যামোলাইটের (রামধনু-জীবাশ্ম) এই উজ্জ্বল রঙগুলি পৃথিবী এবং প্রাণীর মিশ্রণে তৈরি এক অনন্য শিল্প।”

অ্যাবালনের ক্ষেত্রে এই ফাঁকগুলির প্রায় ১১ ন্যানোমিটার চওড়া। আবার মাদাগাস্কার থেকে পাওয়া অ্যামোনাইটের জীবাশ্মগুলি চার ন্যানোমিটারের চেয়েও কম। যা থেকে গবেষকেরা নিশ্চিত, কানাডায় পাওয়া রামধনু রঙা জীবাশ্মের মধ্যে পাওয়া অ্যারাগনাইটে ওই নির্দিষ্ট ব্যবধানের ছোট ছোট ফাঁকের কারণেই এগুলি থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়। জীবাশ্মগুলির খোলসের নমুনায় কোনও জৈব উপাদান পাওয়া যায়নি। তবে অ্যাবালনের যে খোলসগুলির পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে জৈব উপাদান ছিল। তবে ওই জৈব উপাদান অ্যাবালনের খোলস থেকে সরিয়ে ফেলার পরেও সেগুলিতে রামধনু-জীবাশ্মের মতো রঙ দেখা যায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement