সৌরমণ্ডলের বাইরে প্রথম হদিশ মেলা চাঁদ। ‘কেপলার-১৬২৫-বি’।- ছবি: নাসা।
হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন বিজ্ঞানীরা! আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে। এই প্রথম।
সেই চাঁদ আমাদের থেকে রয়েছে ৪ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। মানে, আলোর গতিতে ছুটলে সেই চাঁদে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগবে ৪ হাজার বছর। ফলে, খুব যে কাছেপিঠে আছে সেই চাঁদ, তা বলা যাচ্ছে না।
সেই চাঁদ রয়েছে যে নক্ষত্রমণ্ডলে, তার নাম- ‘কেপলার-১৬২৫’। আমাদের বৃহস্পতির মতো চেহারার বিশাল একটা নক্ষত্র। ভরের নিরিখে যা আরও ১০ গুণ ভারী বৃহস্পতি গ্রহের চেয়ে। সেই নক্ষত্রটিকে ঘিরে চক্কর মারছে যে গ্রহ, সেই ‘কেপলার-১৬২৫-এ’-র একটি চাঁদ রয়েছে বলে হালে টের পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে প্রথম হদিশ মেলা সেই তাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে- ‘কেপলার-১৬২৫-বি’। ওই চাঁদ আমাদের চাঁদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বড়। আকারে ও ভরে আমাদের নেপচুনের মতো।
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডেভিড কিপিং ও অ্যালেক্স টিকের সেই গবেষণাপত্রটি ২৬ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘অন দ্য ডেয়ার্থ অফ গ্যালিলিয়ান অ্যানালগ্স ইন কেপলার অ্যান্ড দ্য এক্সোমুন ক্যান্ডিডেট কেপলার-১৬২৫-বি’। সহযোগী গবেষকদের অন্যতম কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লুনার সায়েন্স অবজারভেটরির ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিষ্ণু রেড্ডি।
আগামী পড়ুন- আগামী বছরের গোড়াতেই ভারতের জোড়া চন্দ্রাভিযান
দুই মূল গবেষক (বাঁ দিক থেকে) অ্যালেক্স টিকে ও ডেভিড কিপিং ও সহযোগী গবেষক ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিষ্ণু রেড্ডি
আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের ই-মেল জবাবে বিষ্ণু লিখেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভিনগ্রহের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে কোনও চাঁদের হদিশ পাওয়া গেল এই প্রথম। ওই চাঁদের হদিশ দিয়েছে মহাকাশে থাকা কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ (কেএসটি)। তবে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এ বার আমরা আরও শক্তিশালী হাবল স্পেস টেলিস্কোপকে ব্যবহার করব। চেহারায় নেপচুনের মতো বলে আমরা একে ডাকছি ‘নেপ্ট-মুন’ নামে।’’
মহাকাশে বসানো এই কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের নজরেই প্রথম ধরা পড়েছে সেই চাঁদের ‘আলো’র সিগন্যাল
গবেষকদের দাবি, এটা যে সত্যি সত্যিই এই সৌরমণ্ডলের বাইরে হদিশ মেলা প্রথম কোনও চাঁদ, সে ব্যাপারে তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত। গবেষণার নিশ্চয়তার মানদণ্ডে তার মান ‘ফোর সিগমা’। মানে, অন্তত ১৬ হাজার সম্ভাবনার মধ্যে মাত্র একটি ক্ষেত্রে সেই প্রথম হদিশ মেলা চাঁদ, কোনও চাঁদ না হয়ে অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তু হতে পারে। কোনও আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য প্রয়োজন ‘ফাইভ সিগমা’ নিশ্চয়তা। গবেষকদের দাবি, আরও শক্তিশালী হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (এইচএসটি) সেই কাজটা করতে পারবে।
কী ভাবে এই প্রথম হদিশ মিলল ভিনগ্রহের কোনও চাঁদের?
মূল গবেষক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডেভিড কিপিং ও অ্যালেক্স টিকে টেলিফোনে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, সাধারণত আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে কোনও নক্ষত্রের আলো কী ভাবে আমাদের কাছে পৌঁছচ্ছে, আসার পথে তা বেঁকেচুরে যাচ্ছে কি না, বাঁকলে তা কতটা বাঁকছে, আলো কিছুটা কমছে কি না, কমলে কতটা কমছে, তা দেখেই জানা যায়, সেই নক্ষত্রের কোনও গ্রহ আছে কি না। সেই ভাবেই এত দিন বহু বহু আলোকবর্ষ দূরে থাকা ভিনগ্রহের আবিষ্কার হয়েছে এত দিন। এখনও হচ্ছে। তাতে ওই নক্ষত্রটিকে ঘিরে যদি শুধু একটা গ্রহই পাক মারতো, তা হলে আলো যতটা কমতো, এ ক্ষেত্রে তার পরিমাণ আরও কমেছে। সেটা একমাত্র সম্ভব যদি ‘কেপলার-১৬২৫-এ’ ভিনগ্রহটিকে চক্কর মারে তার কোনও চাঁদ। আর সেই চাঁদটা যদি আমাদের নেপচুন গ্রহের মতো চেহারার হয়। ততটা ভারী হয়।
আরও পড়ুন- অকারণ ভয়ে আর ভুগতে হবে না? পথ দেখালেন দুই বাঙালি
তবে অক্টোবরে হাবল স্পেস টেলিস্কোপই এ ব্যাপারে ১০০ শতাংশ সঠিক খবর দিতে পারে বলে আশা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। কারণ, তা অনেক বেশি শক্তিশালী কেপলার টেলিস্কোপের চেয়ে।
২৬ জুলাই প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রটি
এই ‘কেপলার-১৬২৫-বি’ সত্যি সত্যিই আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে প্রথম হদিশ মেলা কোনও চাঁদ হলে অবশ্য নক্ষত্রমণ্ডল সৃষ্টির যে ব্যাখ্যা রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানে, তা হয়তো কিছুটা বদলাতে হবে। এমনটাই মনে করছেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝা। তাঁর কথায়, ‘‘বৃহস্পতির চেহারায় আর অতটা ভারী কোনও গ্রহ (কেপলার-১৬২৫-এ)-কে ওই অবস্থানে থেকে কোনও চাঁদ অন্তত পাক মারতে পারে না। অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে তা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ওই বস্তুটি চাঁদ নাও হতে পারে। হতে পারে তা বৃহস্পতির মতো চেহারার ও ভারী ‘কেপলার-১৬২৫-এ’ গ্রহটির জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে অন্য কোনও নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ছিটকে এসে গিয়েছে সেই ভিনগ্রহটির কাছে।’’
ছবি সৌজন্যে: কলম্বিয়া ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাসা