যুগান্তকারী আবিষ্কারের পরেও নোবেল পুরস্কার অধরাই থেকে গিয়েছে স্টিফেন হকিংয়ের কাছে। ছবি:রয়টার্স।
বিজ্ঞানের জগতে স্টিফেন হকিং হলেন দমবন্ধ পরিবেশে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ার মতো। তাঁর গবেষণার দরজা ছিল সব সময়ই আমজনতার জন্য উন্মুক্ত। বিন্দু বিসর্গ বিজ্ঞানের জ্ঞান নেই যাঁদের সেই জনসাধারণের জন্য মহাবিশ্বের জটিল তত্ত্বকে সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিল এই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর।
বিগ ব্যাং থিওরি থেকে ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য—নানা দিকে বিচরণ করেছে তাঁর বিজ্ঞান মনন। মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানী এই পদার্থবিদ এবং চিন্তাবিদের ‘হকিং রেডিয়েশন’ থিওরি এক সময় বিজ্ঞানমহলে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে তাঁর গবেষণা পদার্থবিদ্যার জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিলেও তথাকথিত বিজ্ঞান জগতের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরস্কার তাঁর অধরাই থেকে গিয়েছে।
স্টিফেন হকিং কেন নোবেল পুরস্কার পাননি সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এক সময়। গ্যালিলিও, নিউটন এবং অবশ্যই আইনস্টাইনের সার্থক উত্তরসূরি হকিং বিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধে কাজ করেছেন সাঙ্ঘাতিক উঁচু পর্যায়ে। সেই গবেষণাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সহজ-সরল ভাষায়, তাজা বাতাসের মতো। তাঁর গবেষণা ছিল থিওরিটিক্যাল। কিন্তু নোবেলের উইলে পরিষ্কার লেখা আছে যে, পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার যদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ করা যায়, তা হলেই তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই প্রমাণ তিনি করে যেতে পারেননি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার প্রফেসর এমেরিটাস অমিতাভ চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমার মতে, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল না পেলেও তাতে তাঁর অবদান কিছু কমে যায় না। হকিংয়ের সিঙ্গুলারিটি থিওরেম বা হকিং রেডিয়েশন-এর মতো তত্ত্ব-ই তার প্রমাণ। ৫০ বা ১০০ বছর পরেও অনেক নোবেল প্রাপকদের কাজের থেকেও হকিং-এর কাজ মনে রাখবেন মানুষ।’’
আরও পড়ুন:
মেধা নয়, ওঁর প্রাণশক্তির কথা আগে মনে আসে
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর কাজের অন্তরায় হয়নি কোনও দিন। জটিল স্নায়ু রোগে শরীরে ক্ষয় ধরে। চলে যায় মুখের ভাষা, গলার আওয়াজ। তাও, জনসাধারণের উপর তাঁর প্রভাব ছিল সাঙ্ঘাতিক। তাঁর চিন্তা পাড়ি দিয়েছে মহাবিশ্বের অলি-গলিতে। মস্তিষ্ক রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টামের জটিল অঙ্ক কষেছেন, কিন্তু মুখে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন জনতার দরবারে। পুণে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার অব অ্যাসট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাসট্রোফিজিক্সের ডিরেক্টর এবং পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সোমক রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, জটিল বিজ্ঞান আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনই হকিংয়ের ‘স্টারডম’-র কারণ। কিন্তু, তাঁর সব চিন্তাভাবনা ছিল খাতায় কলমে বন্দি। বাস্তব প্রয়োগের রাস্তা সেখানে ছিল অবরুদ্ধ। তাই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছলেও নোবেলের স্বাদ থেকে দূরেই থেকে গিয়েছেন।
বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস-এর সিনিয়র প্রফেসর সন্দীপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, হকিং নোবেল কেন পাননি সেই প্রশ্নই আজ ঘুরে ফিরে আসছে বার বার। মহাবিশ্বের অপার তথ্য ছিল যাঁর নখদর্পণে, সেই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর নোবেল না পাওয়ার পিছনে ছিল একটাই কারণ— সারা জীবন ধরে যে থিওরিগুলোর কথা বার বার বলে এসেছেন তিনি, তা পরীক্ষিত সত্য বলে প্রমাণ করার মতো সূক্ষ্ম প্রযুক্তিই যে উদ্ভাবিত হয়নি এখনও!