‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র ঝড়!
তাদেরও ‘জন্ম-জন্মান্তর’ রয়েছে!
রয়েছে ‘এক জন্ম’ থেকে ‘পরের জন্মে’ উত্তরণ!
যেন একটা প্রবাহ। যাতে কোনও ছেদ নেই। নেই কোনও যতিচিহ্নও।
‘বিগ ব্যাং’-এর জন্মের প্রায় এক কোটি বছর এই ব্রহ্মাণ্ডে আবির্ভাব হয়েছিল প্রথম প্রজন্মের তারা বা নক্ষত্রের। সেই থেকেই নক্ষত্রদের জন্ম-মৃত্যুর পালা শুরু। এক প্রজন্মের নক্ষত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তার ছাই-ভস্ম থেকে পরের প্রজন্মের নক্ষত্রের জন্ম। এরই মধ্যে যখন প্রায় ৯০০ কোটি বছর পেরিয়ে গিয়েছে ‘বিগ ব্যাং’-এর পর, তখন আমাদের সূর্য তথা সৌরমণ্ডলের আবির্ভাব। তার তৃতীয় গ্রহে (পৃথিবী) এসেছে প্রাণ আর এসে গিয়েছে মানুষের মতো প্রাণী।
প্রশ্ন ওঠে, এই ব্রহ্মাণ্ডে সব নক্ষত্র একই সঙ্গে জন্মালো না কেন?
এমনও তো হতে পারত, সেই সময় ঘন গ্যাসের মেঘ সেই নক্ষত্র-যুগের আদি-পর্বে নক্ষত্র তৈরি করে দীপাবলীর মতো মহাবিশ্বকে ক্ষণ কালের জন্য আলোকিত করে নিভে গেল! আর কিছু কিছু (হাল্কা) নক্ষত্র ধুঁকতে ধুঁকতে আধমরা হয়ে রইল। ভারী নক্ষত্রগুলোর মৃত্যুর পর তার থেকে যে গ্যাস আবার বেরিয়ে এল, তা দিয়ে কয়েক কোটি বছর পর্যন্ত নক্ষত্র-কূলের জমিদারি চলতেই পারত! তার পর নিভেই যেতে পারত জলসাঘরের বাতি!
‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র কেন্দ্র। হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপে তোলা ছবি।
কিন্তু সে রকমটা হল না কেন?
এই যে একটু একটু করে নক্ষত্র জন্ম নিচ্ছে, একের পর এক প্রজন্মের নক্ষত্র আসছে, এই প্রক্রিয়াটা নিয়মিত ভাবে ঘটছে কেমন করে?
ওই প্রক্রিয়াটা বেহিসেবি জমিদারি চালে চলল না কেন?
প্রশ্নটা নিছকই তাত্ত্বিক বিলাসিতা নয়। এমনটা হতেই পারত। আর সে ক্ষেত্রে মানুষের মতো প্রাণীর উদ্ভবের জন্য প্রয়োজনীয় বিবর্তনের যথেষ্ট সময় থাকত না আমাদের হাতে। এক লহমায় আলোকিত হয়ে মহাবিশ্ব চির অন্ধকারে ডুবে যেত। তাই নক্ষত্রের জন্মের প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণের ওপর আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।
সেই প্রশ্নটার ভাসা ভাসা উত্তরটা পাওয়া গিয়েছে এত দিনে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোনও নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় তার চার পাশের গ্যাস এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, তার থেকে পরের প্রজন্মের নক্ষত্রের জন্মটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, নক্ষত্রের জন্মের জন্য প্রয়োজন খুব শীতল পরিবেশ। যেখানে বিভিন্ন ধরনের অণু জড়ো হতে পারে। আর তার ফলে গ্যাস সঙ্কুচিত হয়ে জমাট বাঁধতে পারে। এমন ‘আণবিক মেঘ’-এ যখন কোনও নক্ষত্রের জন্ম হয়, তখন তার মধ্যে ছোট, বড়- সব ধরনের ভরের নক্ষত্রের হদিশ পাওয়া যায়। হাতের পাঁচ-পাঁচটা আঙুল তো আর কখনও সমান হয় না। এদের আয়ুও এক এক রকমের হয়। হাল্কা নক্ষত্রগুলো বেশি আলো দেয় না। কিপ্টের মতো একটু একটু শক্তি খরচ করে (যার মানে, কম আলো বিকিরণ করে)। তার ফলে তারা বহু বহু যুগ ধরে টিঁকে থাকতে পারে। কিন্তু ভারী নক্ষত্রগুলোর আয়ু খুব কম হয়। এরা ক্ষণজন্মা। ২০/৩০ লক্ষ বছরেই এদের খেল খতম হয়ে যায়। এর পর তাদের শরীরের ভেতরে আলো তৈরির জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে, সেই নক্ষত্রগুলো একটা বিশাল বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। আর সেই বিস্ফোরণেই পরের প্রজন্মের নক্ষত্রের জন্মের জন্য প্রয়োজনীয় মালমশলা থাকে। থাকে প্রাণের জন্য দরকারি পরমাণু। যেমন- লোহা, অক্সিজেন, ইত্যাদি। এই ধরনের বিস্ফোরণের নাম হল- ‘সুপারনোভা’।
কিন্তু সেই ‘সুপারনোভা’র বিস্ফোরণের ফলে, তার চার পাশের গ্যাসের ওপর একটা বিশাল ধাক্কা এসে পড়ে। একটা ‘বিরাশি সিক্কা’র চড়ের মতো! কারণ, ওই বিস্ফোরণ থেকে গ্যাস সেকেন্ডে প্রায় কয়েক হাজার কিলোমিটার গতিবেগে ছিটকে বেরিয়ে আসে। ভাবা যায়? ওই গতিবেগে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসা যাবে! যখন এমন গতিবেগে ছুটে আসা নক্ষত্রের ভেতরকার পদার্থগুলো বাইরের গ্যাসে ধাক্কা মারে, তখন সেই গতিশক্তির (কাইনেটিক এনার্জি) কিছুটা অংশ রূপান্তরিত হয় তাপশক্তিতে (হিট এনার্জি)। যে কারণে চড় খেলে গাল গরম হয়ে যায়। আর সেই উত্তপ্ত গ্যাস হুড়মুড়িয়ে বাইরের দিকে ছিটকে পড়তে পড়তে আরও গ্যাসকে জড়ো করে বাইরের দিকে ঠেলে দেয়। বুলডোজার দিয়ে জঞ্জাল সাফ করার মতো নক্ষত্রের আঁতুড় ঘরের কাছাকাছি অংশটা এই ভাবেই উজাড় হয়ে যায়। ভারী নক্ষত্রের বিনাশের পরে।
‘মিল্কি ওয়ে’র কাছে গ্যালাক্সি-‘এম-৮২’। এর থেকে গ্যাস প্রচণ্ড বেগে বেরচ্ছে।
তার ভেতরে থাকা হাইড্রোজেন থেকে লাল আভার বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে।
-------------------------------------------------------------------------------------
তার ফলে, ওই এলাকায় গ্যাস আবার ঠাণ্ডা হতে প্রচুর সময় নেবে। সেই গ্যাসে তো পরমাণুগুলোরও বেহাল অবস্থা! মেলায় প্রচণ্ড হুড়োহুড়িতে যেমন বাবা-মায়ের হাত থেকে শিশুরা ছিটকে পড়ে হারিয়ে যায়, তেমনই ওই অঞ্চলের পরমাণুগুলো থেকে তাদের ইলেকট্রনগুলোও ছিটকে পড়ে। পরে যখন সেই গ্যাস কিছুটা ঠাণ্ডা হয়, তখন পরমাণুর কেন্দ্রগুলো এ দিক ও দিক থেকে ইলেকট্রন ধরে এনে আবার সংসার করতে শুরু করে। আর তারই ফলশ্রুতিতে, আনন্দাশ্রু হিসেবে ওই পরমাণুগুলো এক ধরনের আলো বিকিরণ করে। যেমন, গ্যাস যখন ঠাণ্ডা হয়ে প্রায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছয়, তখন তার মধ্যেকার হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো ইলেকট্রন ঘরে আনার পর এক ধরনের লাল আলো ছড়ায়। মহাবিশ্বকে জানান দেয় তার নতুন সংসারের কথা।
আরও পড়ুন- এই সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ!
মহাকাশ থেকে ঝুপ করে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ল ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া!
তার পর আরও ঠাণ্ডা হলে সেই সব পরমাণু জড়ো হয়ে তৈরি হয় অণু। এমন ঘটনা একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ঘটলে সেখানে একটা ‘আণবিক মেঘ’ তৈরি হয়ে যায়। আরও ঠাণ্ডা হলে সেই গ্যাস ধীরে ধীরে তার নিজের মহাকর্ষের কবলে পড়ে গিয়ে জমাট বাঁধতে শুরু করে। তার পরেই নক্ষত্র ‘সন্তানসম্ভবা’ হয়!
নক্ষত্রের বিনাশের ফলে চার পাশের গ্যাসে নক্ষত্রের ভ্রুণ-নাশ হয়। প্রকৃতিই তা হলে এমন করে নক্ষত্রের জন্ম-প্রক্রিয়াকে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। যাতে এই ব্রহ্মাণ্ডে গ্যালাক্সির বিবর্তন হয় ধীরে-সুস্থে। (যাতে বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভবের জন্য যথেষ্ট সময় থাকে, যাতে প্রকৃতির ওই সূত্র তারা আবিষ্কার করতে পারে?)
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, যে সব গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের বৃদ্ধির হার খুব বেশি, সেই সব গ্যালাক্সিতে উত্তপ্ত গ্যাসের সমাবেশও বেশি। এমন কিছু গ্যালাক্সিও রয়েছে, যেখানে এই রকমের হুটোপাটিতে এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, উত্তপ্ত গ্যাস তুমুল বেগে একেবারে গ্যালাক্সির বাইরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। তখন সেই গ্যালাক্সিতে আপনাআপনিই নক্ষত্রের জন্মের হার কমে আসে। ওই গ্যালাক্সিদের দেখলে মনে হবে যেন ঝড় উঠেছে! ব্রহ্মাণ্ডের ওই সব গ্যালাক্সির ‘অশনি সংকেত’ থেকে নক্ষত্রের জন্ম-প্রক্রিয়াটি কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় মহাবিশ্বে, তা জানার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
সেই যে ‘আনন্দাশ্রু’র মতো হাইড্রোজেন পরমাণুর লাল আভার কথা বলেছি, তেমনই আধুনিক শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে বেশ কয়েকটা গ্যালাক্সিতে দেখা গিয়েছে, ঝড়ের বেগে গ্যাস বেরিয়ে আসতে আসতে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আর সেই রকম লাল আভা দিচ্ছে। অক্সিজেন পরমাণু থেকে বেরচ্ছে সবুজ আভা। শুধু লাল, সবুজ রঙের দৃশ্যমান আলো নয়। অতিবেগুনি আর এক্স-রশ্মির মতো আলোর ছটাও ধরা পড়ে। এ ছাড়াও রয়েছে অবলোহিত আলো। এমনকী, রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমেও মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে ঝড়ের খবর। আর যে সব গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের জন্মের হার বেশি, সেখানকার গ্যাসের মধ্যে ঝড়ের উন্মাদনাও প্রচণ্ড। তবে এই সব তথ্যের মধ্যে এখনও অনেক ধাঁধাঁ রয়ে গিয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। নক্ষত্রের জন্মের হারের সঙ্গে কোনও গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে আসা এক্স-রে’র দীপ্তির বেশি-কম হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা গিয়েছে, অনেক সময় নক্ষত্রের জন্মের হার কম হলেও তার এক্স-রে’র ঔজ্জ্বল্য নজর কাড়ার মতো। কেন? বিজ্ঞানীরা এখনও তার সদুত্তর পাননি।
গ্যালাক্সির বাইরের জায়গাটা কিন্তু একেবারেই শূন্য নয়। সেখানেও হাল্কা গ্যাস রয়েছে। কতটা হাল্কা, সেটা বোঝাতে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহটি যতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে, তার মধ্যে যদি এক টুকরো বরফ-কণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তা হলে তার যা ঘনত্ব হবে, আন্তর্গ্যালাক্সিয় গ্যাসের ঘনত্বও সেই রকম। কিন্তু সেই অত্যন্ত অল্প গ্যাসের মধ্যেও বিজ্ঞানীরা এমন কিছু জটিল পরমাণুর সন্ধান পেয়েছেন, যেমন, সিসা, পারদ, সিলিকন ইত্যাদি, যে সব পরমাণু সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় আপনাআপনি তৈরি হওয়াটা কার্যত, অসম্ভবই। এখন আমরা জানি, এই পরমাণুগুলো গ্যালাক্সির ভেতরে নক্ষত্রদের অন্তরে-অন্দরেই তৈরি হয়েছিল। তার পর নক্ষত্রদের জন্ম-নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সির বাইরে এসে পড়ছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে সব ‘ব্ল্যাক হোল’ রয়েছে, তাদের মহাকর্ষের ফলেও গ্যালাক্সির গ্যাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফিনকির মতো সেই গ্যাস বহু দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। তার ফলেও অনেক সময়েই নক্ষত্রের জন্ম-প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তেও একটা ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে মহাকাশ থেকে আসা এক্স-রে’র চেয়েও শক্তিশালী গামা রশ্মি নিয়ে গবেষণার জন্য একটা বিশাল টেলিস্কোপ কৃত্রিম উপগ্রহে চাপিয়ে পাঠানো হয়েছিল। কারণ, পৃথিবী থেকে ওই গামা রশ্মিকে ততটা পাওয়া যায় না, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের বায়ুমণ্ডল তাকে শুষে নেয় বলে। ওই ‘ফের্মি’ টেলিস্কোপের মাধ্যমেই আমাদের গ্যালাক্সির দু’দিকে গামা রশ্মিতে অত্যন্ত উজ্জ্বল অঞ্চল দেখা গিয়েছে। যা গোলাকার। কোনও গ্যাস থেকে এমন শক্তিশালী গামা রশ্মি বেরিয়ে আসতে গেলে, তাকে হয় খুব তপ্ত করে তুলতে হবে। আর তা না হলে, তাকে শক্তিশালী পদার্থ-কণা তৈরি করতে হবে। আর শুধুই গামা রশ্মি নয়, এক্স-রে ছবিতেও ওই অঞ্চলে অস্বাভাবিক ভাবে উত্তপ্ত গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে তোলা ছবিতেও একই ধরনের সংকেত ধরা পড়েছে।
‘মিল্কি ওয়ে’ গোলাকার চাকতির মতো। তার দু’দিকে দু’টি গোলাকৃতি এলাকা
রয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর গামা-রে বেরচ্ছে। এটাকেই বিজ্ঞানীরা ‘মিল্কি ওয়ে’তে
ওঠা হাল্কা ঝড়ের চিহ্ন মনে করছেন।
------------------------------------------------
বিজ্ঞানীরা এখন বোঝার চেষ্টা করছেন, আমাদের গ্যালাক্সিতে এই ঝড়ের পিছনে কার হাত রয়েছে?
তা কি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোল? নাকি সেখানকার নক্ষত্র-সৃষ্টির প্রক্রিয়া?
আমাদের গ্যালাক্সি একটা মাঝারি ভরের গ্যালাক্সি। আর তার ঠিক মাঝখানে থাকা ব্ল্যাক হোলটিও ‘সুপারম্যাসিভ’ নয়। ব্রহ্মদৈত্যের মতো খিদে নেই তার। তাই সেই ব্ল্যাক হোলটা তার চার পাশের গ্যাসে আলোড়ন তোলে ঠিকই, কিন্তু সেই গ্যাসকে পিচকারির মতো বাইরে ছুঁড়ে ফেলার সাধ্যি নেই তার!
সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী এক জায়গায় লিখেছিলেন, মধ্যবিত্তের জীবনযাপন এক ধরনের মধ্যবৃত্তের মতো। তার সাধ-আহ্লাদ-স্বপ্ন-বিলাসিতা সব কিছুই মাঝারি রকমের। আমাদের গ্যালাক্সির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও মধ্যবিত্তের মতো। তার নক্ষত্র-জন্মের হারও মাঝারি রকমের। বছরে মোটামুটি তিন-চারটে সূর্যের মতো নক্ষত্রের জন্ম দিয়ে উঠতে পারে। এই জন্ম-হার দিয়ে গ্যালাক্সি জুড়ে ঝড় তোলা অসম্ভব। তার জন্য এর চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি জন্ম-হার প্রয়োজন। যেমনটি দেখা যায়, আমাদের একেবারে কাছের একটা গ্যালাক্সি-পুঞ্জে থাকা ‘এম-৮২’ গ্যালাক্সিতে।
বিজ্ঞানীরা এখন বোঝার চেষ্টা করছেন, আমাদের গ্যালাক্সিতে এই ঝড়ের পিছনে কার হাত রয়েছে?
তা কি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোল? নাকি সেখানকার নক্ষত্র-সৃষ্টির প্রক্রিয়া?
আমাদের গ্যালাক্সি একটা মাঝারি ভরের গ্যালাক্সি। আর তার ঠিক মাঝখানে থাকা ব্ল্যাক হোলটিও ‘সুপারম্যাসিভ’ নয়। ব্রহ্মদৈত্যের মতো খিদে নেই তার। তাই সেই ব্ল্যাক হোলটা তার চার পাশের গ্যাসে আলোড়ন তোলে ঠিকই, কিন্তু সেই গ্যাসকে পিচকারির মতো বাইরে ছুঁড়ে ফেলার সাধ্যি নেই তার!
তবে ওই মাঝারি হারই সই! বিজ্ঞানীদের ধারণা, হয় ওই ‘ব্ল্যাক হোল’ আর তা না হলে ‘সুপারনোভা’র বিস্ফোরণের জন্য একটা হাল্কা ঝড় উঠেছে আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তে। যার চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে গামা-রে, এক্স-রে আর মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে।আমরা ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’র বাসিন্দা হয়ে যে এমন একটা মাঝারি ধরনের ঝড় কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি, সেটাও খুব সৌভাগ্যের কথা! কারণ, গ্যালাক্সি যদি প্রচণ্ড ঝড়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকতো, তা হলে সেখানে প্রাণ সৃষ্টির জন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠত না। ‘মিল্কি ওয়ে’র এই হাল্কা ঝড় থেকেই হয়তো দূর দূরান্তের গ্যালাক্সির তুমুল ঝড়ের ধরন-ধারণ আন্দাজ করতে কিছুটা সুবিধা হবে। যার থেকে নক্ষত্রের জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটা ভাল করে বুঝতে পারব।
জানতে পারব, এই ব্রহ্মাণ্ডে কেন এক বসন্তেই সব ফুল ফুটে গিয়ে তা একই সঙ্গে ঝরে গেল না?
জানতে পারব, কেন এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রৌঢ় বয়সেও নক্ষত্রের জন্ম হয়? কেন গ্যাস আন্দোলিত হয়? কেন সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ঝড় ওঠে আর কেনই-বা গ্যালাক্সিদের চেহারায় ‘লজ্জা’র ‘লাল আভা’ দেখা যায়?
ছবি সৌজন্যে: নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।