গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
কোথাও দেড় ফুট, কোথাও মেরেকেটে তিন ফুট। রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে তীব্র ভূমিকম্পের পর যে বিধ্বংসী সুনামির আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ঢেউয়ের উচ্চতা অধিকাংশ জায়গাতেই চার ফুটের বেশি হয়নি। কেবল কামচাটকায় ১৪ থেকে ১৬ ফুট ঢেউ দেখা গিয়েছে। আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া-সহ একাধিক দেশে সুনামির সতর্কতা জারি করা হয়েছিল বুধবার। তবে সময়মতো সতর্কতা আবার তুলেও নেওয়া হয়েছে। উপকূল থেকে যে সমস্ত বাসিন্দাদের সরানো হয়েছিল, তাঁরাও যথাস্থানে ফিরে গিয়েছেন। কামচাটকায় ভূমিকম্পের তীব্রতা তো কম ছিল না। তা সত্ত্বেও কেন এত ‘মৃদু’ হল সুনামি?
প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে কামচাটকা উপদ্বীপে বুধবার স্থানীয় সময় ঠিক সকাল ১১টা ২৪ মিনিট। আচমকা থরথর করে কেঁপে ওঠে সমুদ্রের তলার মাটি! রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা মেপে আঁতকে উঠেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। ৮.৮! সমুদ্রের নীচে এত তীব্র ভূমিকম্পের পরিণতি তো একটাই— সুনামি! সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক দেশকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সমুদ্রের ধার থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। জল ফুঁসে ওঠার আগেই খালি করে দেওয়া হয় অধিকাংশ উপকূল।
কিন্তু কোথায় কী!
কামচাটকা ছাড়া সুনামির তেমন ধ্বংসলীলা আর কোথাও দেখা যায়নি। ওই রুশ উপদ্বীপের খুব কাছেই জাপান। মনে করা হয়েছিল, রাশিয়ার পরে সুনামি সবচেয়ে তীব্র হবে সেখানেই। লক্ষ লক্ষ মানুষকে জাপানের উপকূল থেকে সরানো হয়েছিল। আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ থেকেও বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায়। পূর্বাভাস ছিল, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায় চলে যাবে। ঢেউয়ের উচ্চতা হবে অন্তত ১০ ফুট। কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই সেই জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। জাপান এবং হাওয়াইয়ে ঢেউ চার ফুটের কিছু বেশি উঠেছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু কিছু অংশে আট ফুটের জলোচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছে, তবে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
কামচাটকায় যে তীব্রতায় ভূমিকম্প হয়েছে, তা ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলির তালিকায় প্রথম সারিতে থাকবে। তবে তার পরেও যে সুনামি তেমন বিধ্বংসী হয়নি, তাতে বিজ্ঞানীরা তেমন বিস্মিত নন। তাঁদের মতে, ৩০ ফুট উঁচু ঢেউ হলেই কেবল সুনামি বিধ্বংসী হবে, তার কোনও মানে নেই। কম উচ্চতার ঢেউয়েও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আর তেমন ধ্বংসলীলার সম্ভাবনা নেই। ভূকম্পন বিজ্ঞানী অ্যামিলকার ক্যারিরা-সেভালোস বলেছেন, ‘‘যখন কোনও ভূমিকম্প হয়, সুনামির শক্তি প্রতিসম ভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে না। চ্যুতি কোনও সরলরেখায় ঘটে না। ফলে বাইরের দিকে তার গতিও সর্বত্র একই থাকে না। ভূমিকম্পের উৎসের আনুমানিক আকার এবং অবস্থানের উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক ভাবে সতর্কতাগুলি জারি করা হয়ে থাকে। তবে ভূমিকম্পে কতটা জল স্থানচ্যুত হল, কোথায় তরঙ্গ ঘনীভূত হচ্ছে, তা এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় না।’’ তিনি আরও জানিয়েছেন, গভীর সমুদ্রে জলের চাপের সেন্সরের একটি নেটওয়ার্ক সুনামির সতর্কতা জারি করতে সাহায্য করে। কিন্তু এই নেটওয়ার্ক তেমন শক্তিশালী নয়। তরঙ্গশক্তির সম্পূর্ণ জটিলতা এই নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে না। এ ছাড়া, সমুদ্রতলের উচ্চতা এবং উপকূলরেখার উপরেও তরঙ্গের দৈর্ঘ্য নির্ভর করে থাকে।
এ তো গেল সতর্কতার ত্রুটির কথা। কিন্তু ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প কেন বিধ্বংসী সুনামির জন্ম দিল না? ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৯.১। একই ভাবে, ২০১১ সালে জাপানের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের মাত্রাও ছিল ৯.১। প্রথম ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলে সুনামির তাণ্ডব কেড়েছিল প্রায় আড়াই থেকে তিন লক্ষ মানুষের প্রাণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে জাপানের সুনামিতে ১৩০ ফুট পর্যন্ত উঠেছিল ঢেউ। মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১৫ হাজার মানুষের। বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রতলে ৯.১ মাত্রার কম্পন এবং ৮.৮ মাত্রার কম্পনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। কম্পনের মাত্রার স্কেলটি সরলরেখায় চলে না। মাত্রা সামান্য বেশি হলেও কম্পনের শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আমেরিকার ভূকম্পনবিদদের মতে, ৯.১ মাত্রার কম্পন ৮.৮ মাত্রার কম্পনের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। তাই তা এত বেশি ধ্বংসাত্মক হয়েছিল।
অন্য একটি অংশের বিজ্ঞানীদের মতে, ২০০৪ বা ২০১১ সালের তুলনায় এ বারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল বেশি গভীর ছিল। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০.৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল সাম্প্রতিক কম্পনের উৎপত্তি। এর ফলে সমুদ্রতলের উল্লম্ব স্থানচ্যুতি তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম হয়ে থাকতে পারে।