পৃথিবী এবং চাঁদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটা মাত্র উপগ্রহ পৃথিবীর। সেই চাঁদও কিনা দূরে সরে যাচ্ছে! সম্প্রতি মহাকাশের নানা খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে দেখে এই তথ্যই জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। হিসাব কষে দেখেছেন, চাঁদ কেন সরছে, কতটা সরছে। সরতে সরতে কি পৃথিবী থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে উপগ্রহটি? এত দিনের বন্ধন ছিঁড়ে যাবে সুদূর কোনও ভবিষ্যতে? পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকা চাঁদের পরিণতি কী হবে? বিজ্ঞানীদের নতুন করে তা ভাবাচ্ছে। কারও কারও কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজও।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, চাঁদ প্রতি বছর দেড় ইঞ্চি করে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লেজ়ার রশ্মির সাহায্যে এই দূরত্ব পরিমাপ করে দেখা হয়েছে। পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত আলো যত ক্ষণে পৌঁছোয় এবং আবার ফিরে আসতে যত ক্ষণ সময় নেয়, তা হিসাব করে চাঁদ এবং পৃথিবীর নিখুঁত দূরত্ব মাপতে পারেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণ ভাবে পৃথিবী এবং চাঁদের দূরত্ব ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীকে এক বার প্রদক্ষিণ করতে চাঁদ ২৭.৩ দিন (প্রায় এক মাস) সময় নেয়। তবে চাঁদের কক্ষপথটি একেবারে নিখুঁত গোলাকৃতি নয়। ফলে প্রদক্ষিণের সময়ে চাঁদ এবং পৃথিবীর দূরত্ব ২০ হাজার কিলোমিটার কমবেশি হয়ে থাকে। সেই কারণেই কোনও কোনও পূর্ণিমায় চাঁদকে বেশি বড় এবং উজ্জ্বল দেখায়। তার নাম দেওয়া হয় ‘সুপারমুন’।
কেন বাড়ছে দূরত্ব?
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যেকার দূরত্ব বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে পৃথিবীর জোয়ার-ভাটা। চাঁদ এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তারতম্যের কারণে জোয়ার-ভাটা হয়। পৃথিবীর যে দিকটা যখন চাঁদের দিকে মুখ করে থাকে, সে দিকে তখন চাঁদের অভিকর্ষ বল চার শতাংশ বেশি শক্তিশালী হয়। এই বলের প্রভাবে পৃথিবীর সমুদ্রে ঢেউয়ের উচ্চতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। চাঁদের দিকে পৃথিবীর যে অংশ থাকে, সেই অংশের সমুদ্রে জোয়ারের সময় ঢেউয়ের উচ্চতা বেশি হয়। নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো জায়গায় জলস্তরের উচ্চতায় পাঁচ ফুট পর্যন্ত তারতম্য হতে পারে। যেহেতু একই সঙ্গে পৃথিবীও নিজের অক্ষরেখার চারদিকে ঘোরে, তাই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল এবং চাঁদের টানে জোয়ারের জল পাল্টা একটি শক্তি প্রয়োগ করে চাঁদের প্রতি। চাঁদকে তারা পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টানে। বিপুল জলরাশির এই টানে চাঁদ নিজের কক্ষপথে সামান্য হলেও এগিয়ে আসে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর এই তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
জোয়ারের টানে চাঁদের গতি বাড়ে। বেড়ে যায় তার কক্ষপথের দৈর্ঘ্য। আর কক্ষপথ দীর্ঘ হওয়ায় পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের দূরত্বও বেড়ে যায় অনিবার্য ভাবে। জোয়ার-ভাটা, গতিবেগ আর দূরত্বের এই অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে একই সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন, এখনই চিন্তার কোনও কারণ নেই।
কী হতে পারে
পৃথিবীর জোয়ারের টান শুধু চাঁদের গতিই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, তার বিপরীত ক্রিয়া হিসাবে একই হারে কমছে পৃথিবীর নিজের অক্ষরেখার চারপাশে ঘোরার গতি (আহ্নিক গতি)। পৃথিবীর এই গতি দিন-রাতের তারতম্যের কারণ। তা কমে যাচ্ছে বলে খুব সামান্য পরিমাণে বাড়ছে দিনের দৈর্ঘ্য! তবে এখনই এ সব নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব যে হারে বাড়ছে, তা অতি সামান্য। বছরে গড় দূরত্বের সামান্য কিছু বৃদ্ধি অঙ্কে ধরা পড়ছে মাত্র। ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটারে দেড় ইঞ্চি বার্ষিক বৃদ্ধি ০.০০০০০০০১ শতাংশ। ফলে আগামী আরও কয়েক লক্ষ বছরে চাঁদ ও পৃথিবীর সম্পর্কে, পৃথিবীর দিন-রাতে তেমন কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
চাঁদ কি আরও কাছে ছিল
সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর সঙ্গে প্রকাণ্ড এক মহাজাগতিক বস্তুর ধাক্কায় চাঁদ তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা জানান, সেই বস্তুটি ছিল আকারে মঙ্গলগ্রহের সমান। ওই সময়ে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য আরও কম ছিল। চাঁদ ছিল আরও কাছে। পৃথিবীর আকাশ থেকে চাঁদকে আরও বড় দেখাত। ধীরে ধীরে চাঁদ সরেছে। বড় হয়েছে দিন। ভবিষ্যতে অবশ্য তা নিয়ে চিন্তা করার কারণ নেই। কারণ, চাঁদ বেশি দূরে সরে যাওয়ার আগে সূর্য প্রসারিত হবে। তাপে শুকিয়ে যাবে পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র। প্রকাণ্ড লাল নক্ষত্রে পরিণত হয়ে চাঁদ-পৃথিবীকে তত দিনে গ্রাস করে নেবে সূর্য। তেমনটাই অনুমান বিজ্ঞানীদের।