ছবি সৌজন্য: নাসা
জলে ভরে আছে শনির চাঁদ!
অনেকটা যেন তালশাঁস! ডাবও বলা যায়!
অত জল নেই আমাদের চাঁদেও।
এই সৌরমণ্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তেও রয়েছে আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের মতো মহাসাগর! যেখানে কোনও অভাবই নেই জলের! একেবারে আদিগন্ত, অতলান্ত মহাসাগর।
হ্যাঁ, সূর্য থেকে অত দূরেও। শনির চাঁদ— ‘এনসেলাডাস’-এ সেই জল আমাদের এই গ্রহের মতোই রয়েছে একেবারে তরল অবস্থায়। মহাকাশের হাড়-হিম করা ঠান্ডায় বরফ আর গ্যাসের তুমুল দাপাদাপির মধ্যেও। যার ওপরটা পুরু, শক্তপোক্ত বরফের চাদর।
কয়েক মাস আগে বৃহস্পতির দুই ‘চাঁদ’— ‘ইউরোপা’ আর ‘গ্যানিমিদ’-এও তরল জলের মহাসাগর থাকার জোরালো তথ্য হাতে এসেছিল নাসা-র। আরও জোরালো তথ্য ও নজরকাড়া ছবি পাওয়ার জন্য আগামী বছরের শেষাশেষি বৃহস্পতির চাঁদ ‘ইউরোপা’র কক্ষপথে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে নাসা। ওই মহাকাশযানটি পরের চার বছরে মোট ৪৫ বার চক্কর মারবে ‘ইউরোপা’কে।
কী ভাবে বোঝা গেল, তরল জলের অতলান্ত মহাসাগর রয়েছে শনির অন্যতম চাঁদ ‘এনসেলাডাস’-এ?
ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় নাসা-র ‘জেট প্রপালসান ল্যাবরেটরি’ (জেপিএল)-র মিডিয়া সেলের তরফে পাঠানো ই-মেলে জানানো হয়েছে, ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযানের পাঠানো ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, শনির চার দিকে তার উপগ্রহ ‘এনসেলাডাস’ চক্কর মারার সময় যেন একটু টাল খাচ্ছে। কখনও উপগ্রহটি একটু বেশি ঝুঁকে পড়ছে বাঁ দিকে। কখনও বা একটু ডান দিকে। ডিমের মতো দেখতে ‘এনসেলাডাস’-এর পিঠটা যেমন পুরু ও শক্ত বরফের চাদরে মোড়া, তার অন্তরে-অন্দরেও যদি থাকত ততটাই পুরু ও শক্ত বরফ, তা হলে শনির কক্ষপথে ঘোরার সময় তার উপগ্রহটি অমন টাল খেত না। একমাত্র জল যদি তরল অবস্থায় থাকে ‘এনসেলাডাস’-এর অন্দরে, তবেই শনির চার পাশে চক্কর মারার সময় সে অমন টাল খেতে পারে। এর অর্থ, ‘এনসেলাডাস’-এর পিঠের পুরু ও শক্ত বরফের চাদরের নীচের দিকটা আর বরফ হয়ে নেই। তা গলে জল হয়ে গিয়েছে। আর সেই জল পরিমাণে এতটাই হওয়ার সম্ভাবনা যে, তা আমাদের প্রশান্ত বা আটলান্টিক মহাসাগরের মতো হতেই পারে।’
শুধু এটুকুই নয়। শনির ‘চাঁদ’ ‘এনসেলাডাস’-এ জলের তরল অবস্থায় থাকার আরও কিছু প্রমাণ মিলেছে।
সেগুলি কী কী?
নাসা-র পাঠানো ই-মেলে জানানো হয়েছে, ‘শনির উপগ্রহ ‘এনসেলাডাস’-এর দক্ষিণ মেরু থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসার ছবি তুলেছে ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযান। তা অনেকটা ‘জলের ফোয়ারা’র মতো উঠে আসছে। যার মধ্যে মিশে থাকতে দেখা গিয়েছে টুকরো টুকরো বরফের কণা। এমনকী, সরল কিছু জৈব অণুও। ‘এনসেলাডাস’-এর দক্ষিণ মেরুর পুরু বরফের চাদরে কিছুটা ফাটলও লক্ষ্য করা গিয়েছে। তারই ফাঁক গলে ওই জলীয় বাষ্প, বরফের কণা ও জৈব অণু বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। ‘এনসেলাডাস’-এর অন্দরে তরল জলের মহাসাগর না-থাকলে, বিপুল পরিমাণে ওই জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসা সম্ভব হত না। ‘ক্যাসিনি’ প্রথম যে ছবি পাঠিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল, হয়তো জলের ছোটখাটো হ্রদ বা সাগর রয়েছে ‘এনসেলাডাস’-এর দক্ষিণ মেরুতে। কিন্তু পরে যে সব ছবি ও তথ্য মিলেছে, তাতে শনির ‘চাঁদে’ মহাসাগর না-থাকলেই অবাক হতে হবে।’
নাসা-র বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাপত্রটি আগামী সপ্তাহেই বহুপঠিত বিজ্ঞান-জার্নাল ‘আইকারাস’-এ ছাপা হচ্ছে। আগামী ২৮ অক্টোবর ‘এনসেলাডাস’-এর আরও কাছে চলে যাবে ‘ক্যাসিনি’ মহাকাশযান। তখন উপগ্রহটির অন্দরে থাকা মহাসাগরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও তথ্য ও ছবি পাওয়া যাবে বলে নাসা মনে করছে।
সঙ্গত প্রশ্ন যেটা, তা হল, সূর্যের এত দূরে থেকেও, ‘এনসেলাডাস’-এর পিঠের পুরু ও লোহার মতো শক্তপোক্ত বরফের চাদরের তলায় দু’-এক ফোঁটা জল নয়, একেবারে সুবিশাল মহাসাগর রয়ে গিয়েছে কী ভাবে? আর সেই মহাসাগর কী ভাবেই বা লক্ষ-কোটি বছর ধরে তরল জলেই ভরে রয়েছে?
নাসা-র মিডিয়া সেলের পাঠানো ই-মেলে জানানো হয়েছে, ‘কারণটা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। অনুমান করা হচ্ছে, শনির জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে তার অন্যতম উপগ্রহ ‘এনসেলাডাস’-এর মহাসাগরেও খুব জোরালো জোয়ার-ভাটা হয়। আর তা খুব নিয়মিতই হয়ে থাকে। এর ফলে, প্রচুর পরিমাণে তাপশক্তির জন্ম হয় ‘এনসেলাডাস’-এর অন্তরে। ওই বাড়তি তাপই ভিতরের পুরু ও শক্ত বরফের চাদরকে গলিয়ে দেয়। আর তার নীচে থাকা মহাসাগরের জলকে ফের জমে গিয়ে বরফ হতে দেয় না। তাকে তরল অবস্থাতেই রেখে দেয়।’