আমার কথা: নন্দিতা রায়
Women's Day

‘কেরিয়ার আর সংসার সমান তালে চলে না’

কে বলেছে সবসময় ছেলেদেরই বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে... শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়লড়াই চালিয়ে যেতেই হয়। তবেই ইচ্ছের জয় হয়। দেখিয়ে দিয়েছেন নন্দিতা। পঞ্চাশ বছরে প্রথম ছবি পরিচালনা। সত্যি তো স্বপ্নের জোর থাকলে বয়সকে উড়িয়ে দেওয়া যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৮ ১৬:২৯
Share:

নন্দিতা রায়।— ফাইল চিত্র।

শৈশবের রং পেনসিলে জলছবির দৃশ্যায়ন। বাবা যখন কড়া সুরে রাশ টেনেছেন, মেয়েকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তৈরি করবেন, তখন মেয়ে ভাবছে নিজেকে মেলে ধরতে এই সোজা নিয়মের বেড়াজাল কেমন করে টপকাই।

Advertisement

এই মেয়ে বিজয়িনী। নন্দিতা রায়।

মুম্বইয়ের পরিবেশে তখন তিনি মেসোমশাই পরিচালক সুবোধ মুখোপাধ্যায়ের ছায়ায় দেখে ফেলেছেন রূপসী সায়রা বানুকে। শশী কপূরের জন্য পাগল মেয়ে সরাসরি হলে গিয়ে ছবি হয়তো দেখছেন না। কিন্তু বন্ধুদের কাছে শুনছেন প্রতিটি দৃশ্যের গল্প। সেখান থেকেই বোধহয় চিত্রনাট্য লেখার রসদ মনে গেঁথে রেখেছিলেন তিনি! তাঁর মেসোমশাই পরিচালনা করছেন 'জংলি', 'শর্মিলি'-র মতো ছবি। কী করেই বা এই ঝলমলে তারা জগত থেকে মুখ ফেরানো যায়?

Advertisement

ইতিমধ্যে হুট করে এক ছেলের সঙ্গে আলাপ। খুব বেশি সময় নেননি। সোজা বললেন, "আমাকে বিয়ে করবে?"

কে বলেছে সবসময় ছেলেদের বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে? বিয়ের মধ্যে অন্য এক আকাশ পেলেন নন্দিতা। শুধু ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে মুক্তি নয়। সঙ্গী হিসেবে পেলেন নীতীশ রায়কে। ছোটবেলার জমানো স্বপ্নের মলাট থেকে একটা পাতা খুলে গেল।

কেবল সংসারে নয়। দু’জনে পথ হাঁটলেন নান্দনিকতায়। মৃণাল সেনের 'খারিজ'। শ্যাম বেনেগালের 'মান্ডি'... একের পর এক চমকে দেওয়া আর্ট ডিজাইন, সঙ্গে নন্দিতার ভাবনা। হাতের ছোঁয়া। ফিরে তাকাতে হয়নি নীতীশ রায়কে। এগিয়ে যাওয়ার এমন এক দিনও এসেছিল যে দিন সাদা পোশাকের এক লোক দায়িত্ব দিয়ে বসলেন বাংলায় ইটিভি তৈরি করার। নীতীশ রাজি, "আমার স্ত্রী নন্দিতা পারবে"— বলে বসলেন তিনি।

আরও পড়ুন: এখনও এ সমাজে মেয়েরা শুধুই ‘মেয়ে’!

টেলিভিশন গড়ার হাতছানি একজন মাকে তাঁর ছেলের কৈশোর থেকে আলাদা করল।

"একজন পুরুষের কাছে কেরিয়ারের জন্য স্টেশন লিভ করা যতটা সোজা, একজন মেয়ের কাছে সেটা খুবই কঠিন! ছেলেকে ছাড়ার আফসোস আজও থেকে গেছে। ওর সঙ্গে যদি ওই সময়টা কাটাতে পারতাম।" থামলেন নন্দিতা। দুপুরের বাসন্তী রোদ তাঁর মুখে লেগে। কপালে এঁকেছেন এক বিস্ময়। এই বিস্ময়ে আচ্ছন্ন আজ বাঙালি-অবাঙালি সমাজ। জানতে চাই, বেলাশেষের আলোয় কেমন করে ডানা মেলেছিল তাঁর ইচ্ছের গাছ?

ছেলেকে মুম্বইতে রেখে কলকাতায় পাড়ি দিলেন। নিজে হাতে গড়লেন ইটিভি। সঙ্গে পেলেন সজীব এক প্রাণ। তাঁর চোখেও সেই স্বপ্ন। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। "শিবুকে বলেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চেয়ে আমার সঙ্গে কাজ কর। কাজের মাটিতে জীবন থেকে যা শিক্ষা পাবে তা দিয়েই তৈরি হয়ে যাবে তোমার আগামীর জগত"। দুই রাস্তা মিলে 'পথ' তৈরি হল। সেই পথের প্রান্তরে সাদা কাগজে লেখা হল 'অলীক সুখ' -এর নাম। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের প্রথম চিত্রনাট্য। মা-ছেলের গল্প বলা হল 'ইচ্ছে'-তে।

শুনতে বেশ লাগে সোজা এক পথ যেন। "ইচ্ছে নিয়ে প্রযোজকদের দরজায় ঘুরেছি। জয়া বচ্চন থেকে ঋতুপর্ণা কেউ রাজি হয়নি সতেরো বছরের ছেলের মা হতে। আবার সোহিনীকে যখন ভেবেছি, সবাই বলেছে এ যদি হিরোইন হয় কেউ ছবি দেখবে না"।

লড়াই চালিয়ে যেতেই হয়। তবেই ইচ্ছের জয় হয়। দেখিয়ে দিয়েছেন নন্দিতা। পঞ্চাশ বছরে প্রথম ছবি পরিচালনা। সত্যি তো স্বপ্নের জোর থাকলে বয়সকে উড়িয়ে দেওয়া যায়।

"শিবু আর আমার কেমিস্ট্রিটা খুব ভাল। আমরা এক রকম ভাবি। ওর জন্য কাজটা সহজে করতে পারি"। এই একরকম ভাবা বাংলা ছবিকে একের পর এক সাফল্যের দরজায় দাঁড় করিয়েছে। মনে হয় তাঁরাই যেন 'বেলাশেষের নায়ক-নায়িকা'।

"বাধা আসবে। কিন্তু সব মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে হবে। যে স্বপ্ন তাঁর নিজের। স্বপ্ন তাকে কথা বলার সাহস দেবে", স্বপ্নালু চোখে, গালে হাসির টোল নিয়ে বললেন নন্দিতা।

আরও পড়ুন: নারীবাদীর প্রেম কেমন, দেখা বাকি

জীবনের দশ নম্বর ছবি 'হামি'-র কাজ শেষ করে আরও এক নতুন ছবি 'কণ্ঠ'-র কাজে হাত দিচ্ছেন নন্দিতা। ছেলে মুম্বইতে নিজের জগতে, স্বামী নিজের জগতে আবার কলকাতার বাইরে। "একসঙ্গে থাকা আর হয় না আমাদের। তাই বলে কি আমার পরিবার ভেঙেছে। কখনই না। আমরা সবসময় একে অপরের জন্য আছি। কোথাও আফসোস থেকে গেছে। মেয়েদের থাকে। সমান তালে কেরিয়ার আর সংসার চলে না...।"

নিজের শর্তে চলা স্বপ্ন আর ইচ্ছে তৈরি করেছে এই মেয়েকে। "ছেলেকে যখন বলেছিলাম বেটা তোকে সময় দিতে পারিনি। খারাপ লাগে। ও বলেছিল— মা তুমি আমায় 'ইচ্ছে'-র মতো ছবি দিয়েছো!"

ছেলের কথা বলতে বলতে আলো বেরিয়ে এল তাঁর শরীর থেকে।

এই মেয়ের কাছে সন্ধ্যাতারা আছে। ছবি দিয়ে দিয়ে যে জোৎস্না দেখায় মানুষকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন