বাড়ির গোঁড়ামি ফুঁড়েই কেটেছে আমার মেয়েবেলা

Advertisement

মুর্শিদা খাতুন (শিক্ষিকা)

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০২:১৬
Share:

যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের একেবারে প্রথম দিকের কথা। আদ্যপ্রান্ত একটা সংখ্যালঘু গ্রাম। আমাদের বয়সী মেয়েরা পড়তে যেত বড়জোর প্রাথমিক পর্যন্ত। বাড়ির অন্যরা ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারে আছন্ন, বহুবিবাহ, তালাক আর গার্হ্যস্থ হিংসায় জর্জরিত মায়েদের ঢেঁকির শব্দে ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙত। নিজেদের আলাদা কোনও অস্তিত্ব বা জীবনের কোনও অনুভূতি আমাদের মেয়েদের ছিল না। এমনই একটা পরিবারে আমি, আমার মায়ের দ্বিতীয় কন্যাসন্তান, বলাই বাহুল্য মায়ের প্রথম অবহেলিত কন্যাসন্তান আমার জন্মের পরে পরেই আগুনে ঝলসে মরে যায়।

Advertisement

খুব ছোট থেকেই অযত্নে পালিত মেয়েদের বাল্যবিবাহ একটা সাধারণ রেওয়াজ। এ ধরণের পরিবেশে সায়া ব্লাউজ-সহ শাড়ি পরে তুলনায় শিক্ষিতা আমার মা বউ হয়ে এসেছিলেন বলেই হয়তো বারবার আমি বাল্যবিবাহের কবল থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছি। মোটামুটি বছর বারো বয়স পেরোতেই নিজের জীবনের অভিমুখ ঠিক করে আমাদের মা-মেয়ের লড়াই শুরু করেছিলাম। স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে আমার যাত্রাপথের সংগ্রাম ভয়াবহ হলেও আমার মায়ের সংগ্রাম আরও বহুগুণ বেশিই ছিল।

আর্থিক ভাবে নিঃস্ব এক মা গোটা সমাজ ও পরিবারের বাধা কাটিয়ে যখন একমুখী হয়ে তার মেয়ের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে সেই সময়কার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়। কিছু মহান শিক্ষক মহাশয়ের সাহায্যে সব বাধা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য লড়াইয়ের পথে এগিয়ে চলেছি। এলাকার মৌলবাদী মানুষ পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে, ফতোয়া জারি করেছে। সে সময় অন্ধকার চিরে সাইকেল করে যখন দূর শহর থেকে টিউশন পড়িয়ে ও নিজে পড়ে বাড়ি ফিরতাম, তখন দেখতাম কিছু অতিউৎসাহী চোখের অবজ্ঞা!

Advertisement

এক দিন সব বাধা জয় করে আমি যখন শিক্ষকতার পেশায় এলাম, এসে দেখলাম আমার ছাত্রীসম সন্তানেরা-ও একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বিচরণ করছে। আমি ওদের পেটে ধরিনি ঠিকই ওদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই। আর আমার উপর যেন আমার আজম্ম দুখিনী মা ভর করে রয়। আমি ঘুমোতে পারলাম না। দশ বছর চাকরির পর আমি স্বেচ্ছায় স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে হাই মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে এলাকার একটা গ্রামে চলে এলাম। যে সমস্যাগুলো আমাকে প্রতি দিন কষ্ট দিয়েছে, যে সিস্টেম আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর হয়েছিল, যে ব্যাবস্থা মেয়েদের নূন্যতম মানুষের স্বীকৃতি দেয় না, সেই সিস্টেমে কোটি কোটি মায়েরা, মেয়েরা কোনওক্রমে বেঁচে আছে। তাই আজও আমি নিশ্চিতে বসে থাকতে পারি না। আমার পেশার দায় দায়িত্বের মধ্যে আমি আমার সামাজিক দায়িত্বকে যুক্ত করি।

যখন শুনি আমার কোনও ছাত্রী আর্থিক সঙ্কট, সামাজিক সঙ্কট বা মৌলবাদীরা পথ আটকে দাঁড়ায়, ন্যাশনাল খেলতে যেতে পারে না। কারণ ‘বাইরে রাত কাটালে মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে!’ তখন আমার প্রয়াত মা অন্ধকার থেকে জেগে ওঠে আমার মাঝে ভর করেন। ধর্মীয় হানাহানির বিষবাষ্প ওদের যাতে ছুঁতে না পারে, বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর করার সঙ্গে নিজের জীবন যাতে নিজেই গড়ে তুলতে পারে, এ জন্য ওরা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নারীদিবসে স্বপ্ন দেখতে চাই, আমাদের দুঃস্থ অভাগী সংখ্যালঘু মেয়েরা ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন