‘বিগ বি: বাবার পকেট থেকে পয়সা নিতে? ঝুলন: বল কেনার জন্য নিতাম’

‘মোদী, বচ্চন স্যার খুব উদ্বুদ্ধ করেছেন’

কোনও সন্দেহ নেই, এ বারের বিশ্বকাপই এই পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে। এখন আমাদের দলের মেয়েদের অনেকের কাছে বিজ্ঞাপন করার প্রস্তাব আসছে।

Advertisement

ঝুলন গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০৪:৫৮
Share:

উদাহরণ: ঝুলন গোস্বামীদের লড়াইয়ের ভক্ত এখন অনেকেই। প্রশংসা নরেন্দ্র মোদী, বচ্চনেরও। ফাইল চিত্র

লর্ডসে বিশ্বকাপ ফাইনালের এক মাস হয়ে গেল বুধবার। এই এক মাসে আমাদের পারিপার্শ্বিকটা অনেকটাই বদলে যেতে দেখলাম।

Advertisement

আমাদের মানে অবশ্যই মেয়েদের ক্রিকেটের কথা বোঝাতে চাইছি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, দল হিসেবে জনতার মনে জায়গা করে নেওয়াটা। এর আগে আমাকে বা মিতালি রাজকে দেখে কেউ হয়তো এগিয়ে এসে কথা বলেছে, শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু গোটা দল হিসেবে আজ মেয়েদের ভারতীয় ক্রিকেট টিম যে স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেটা আমি আগে কখনও দেখিনি।

কোনও সন্দেহ নেই, এ বারের বিশ্বকাপই এই পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে। এখন আমাদের দলের মেয়েদের অনেকের কাছে বিজ্ঞাপন করার প্রস্তাব আসছে। নানা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ আসছে। যেমন অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানে ঘুরে এলাম আমরা ছ’জন। বচ্চন স্যারকে শুধু রুপোলি পর্দাতেই দেখেছি। কখনও ভাবিইনি তাঁর সঙ্গে এক মঞ্চে ‘হট সিট’-এ বসার সুযোগ পাব।

Advertisement

আমরা সবাই খুব নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু সেটা উনিই কাটিয়ে দিলেন হাল্কা হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে। মজার মজার প্রশ্নও করেছেন উনি। যেমন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি শুনেছি তুমি নাকি বাবার পকেট থেকে পয়সা চুরি করতে? এটা কি ঠিক?’’ আমি বললাম, একদম ঠিক শুনেছেন স্যার। তার পর ঘটনাটা কী জানতে চাইলেন উনি। বললাম, বল কেনার পয়সা না দিতে পারলে ক্রিকেট টিমে জায়গা হতো না আমার। কিন্তু অত ছোট বয়সে কোথা থেকে পয়সা পাব? তাই বাবার পকেট থেকে পয়সা নিতে হয়েছে কয়েক বার।

আরও পড়ুন: ধোনিকে ছন্দে চান বিরাট

এ নিয়ে সত্যিই আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমি তো আর কোনও খারাপ উদ্দেশে বাবার পকেট থেকে পয়সা নিতাম না। ক্রিকেট খেলব বলে এটা করতে হতো। সেটা শুনে বচ্চন স্যার খুব তারিফ করলেন। তার পর আমাকে বললেন, ‘‘তুমি বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক, দারুণ ব্যাপার। আমার কাছে এটা একটা খুব গর্বের মুহূর্ত যে এক জন বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারীর সঙ্গে এখানে বসে আছি।’’ শুনে ওঁকে কী বলব, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম ওঁর মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনে। বচ্চন স্যারের মতো কিংবদন্তি বলছেন, আমার সঙ্গে বসে থাকতে পেরে গর্বিত! গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছিল, ঠিক শুনছি তো? শুধু আমাকে একা নয়, পুরো দলকেই খুব আন্তরিক ভাবে বাহবা দিলেন উনি। সব চেয়ে ভাল লাগল যখন বললেন, আমাদের প্রত্যেকটা খেলা উনি মন দিয়ে দেখেছেন এবং খেলা দেখে আনন্দও পেয়েছেন।

এর আগে মেয়েদের ক্রিকেট মানেই লোকে পুরুষদের সঙ্গে তুলনা করে তার একটা মান তুলে ধরার চেষ্টা করত। এ বারের বিশ্বকাপ সেই প্রথাগত ধারণাকে বদলে দিতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। এ বারে মেয়েদের খেলাও লোকে দেখেছে। বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। আইসিসি-কে এর জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে যে, ওরাও ম্যাচগুলি সরাসরি সম্প্রচার করেছে। মেয়েদের ক্রিকেটকে ‘প্রোমোট’ করতে চেয়েছে আইসিসি। ভারতীয় বোর্ডের ভূমিকার কথাও বলতে হবে। এবং অবশ্যই আমার নিজের রাজ্য ক্রিকেট সংস্থা সিএবি থেকে যে সংবর্ধনা এবং স্বীকৃতি পেয়েছি ফেরার পরে সেটাও কখনও ভুলতে পারব না।

এখন ফাঁস করতে দ্বিধা নেই যে, বিশ্বকাপ শুরুর আগে আমরাও একটা গোপন শপথ নিয়েছিলাম দল হিসেবে। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে বিশ্বকাপ জয়ের স্রোতেই বিপ্লব ঘটেছে এ দেশে। কপিল দেবের দৈত্যরা ১৯৮৩ প্রুডেনশিয়াল কাপ জেতার পর থেকে ভারতে ক্রিকেটের ভাষাটাই বদলে গিয়েছিল। ২০০৭-এ যখন ধোনির ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতল বা ২০১১-তে পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ জেতার পরেও একই রকম আবেগের বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছে। আমরাও তাই বলাবলি করেছিলাম যে, মেয়েদের ক্রিকেটকে যদি মানুষের মনে স্থান করে নিতে হয়, তা হলে বিশ্বকাপে ধমাকা করতে হবে।

আমার মনে হয়, সেটা আমরা করতে পেরেছি। ফাইনালটা হেরে গিয়ে সত্যিই খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বার বার মনে হচ্ছিল, শেষটা তো কত মধুর হয়ে থাকতে পারত। মনে হচ্ছিল, তীরে এসে তরী কেন ডুবল? সেই খারাপ লাগাটা অনেকটা কমে গেল দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। যখন নরেন্দ্র মোদী স্যার বললেন, ‘‘গোস্বামীজি আপ উতনা উদাস কিঁউ থে ফাইনাল কে বাদ?’’ বললাম, স্যার চার বছর ধরে তৈরি হয়েছিলাম ওই দিনটার জন্য। স্বপ্ন দেখেছিলাম, কাপটা নিয়ে আমরাই আনন্দ করছি। শেষ ল্যাপে এসে পারলাম না। তাই খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।’’ মোদী স্যার বলে উঠলেন, ‘‘তো ক্যায়া হুয়া?’’ তার পর বললেন, ‘‘দেশের গর্ব তোমরা। ফাইনালটা হেরে গেলেও সকলকে স্বপ্ন দেখতে শেখালে, এটাই তো আসল।’’ এই কথাগুলো আমাদের মনের বোঝা অনেকটাই হাল্কা করতে পেরেছিল।

মানুষের মনে আমাদের নিয়ে একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে বিশ্বকাপের খেলা দেখতে দেখতে। আমার মনে হয়, সেটা একটা বড় প্রাপ্তি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর পর কী? অক্টোবর-নভেম্বরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আমরা টার্গেট করছি সেই ইভেন্টকে। খুব শীঘ্রই হয়তো এ নিয়ে বৈঠক হবে। বিশ্বকাপ মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে চেতনাটা তৈরি করে দিয়েছে। আশা করব, এ বার অটোপাইলটে ফ্লাইট উড়তে থাকবে। আর হয়তো কোনও মেয়েকে চাকদহ থেকে ভিড় ট্রেনে ক্রিকেটের কিটব্যাগ নিয়ে ঠেলাঠেলি করে উঠতে দেখে কেউ কটাক্ষ করবে না যে, মেয়েরা আবার ক্রিকেট কী খেলবে!

পাশাপাশি, একটা কথা বলতে চাই। চাকদহ থেকে ট্রেনে চেপে সেই যে নিত্য যাত্রাটা, সেটাকে কিন্তু আমি কখনও খারাপ ভাবে দেখিনি। কখনও এটা নিয়ে মন খারাপ হয়নি আমার। বরং, জানতাম আমি বাস্তব পৃথিবীর মুখোমুখি হচ্ছি। আমি তাই পরিস্থিতিটা উপভোগ করার চেষ্টা করে গিয়েছি।

এখনও বিশ্বাস করি, ‘চাকদহ টু কলকাতা’ ট্রেনে চেপে ওই নিত্যযাত্রাটা— সেটাই আমার জীবনের সেরা ‘জার্নি’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন