পার্টনার মার্টিনা ও আসল মার্টিনার মাঝে। রবিবার সিঙ্গাপুরে ফাইনাল জিতে সানিয়া। ছবি: এএফপি
সানিয়া মির্জা-মার্টিনা হিঙ্গিসের সঙ্গে এখনই যদি কোনও ডাবলস টিমের তুলনা করি, আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে আসছে ব্রায়ান ভাইদের নাম। সেরা ফর্মের বব-মাইকের মতোই একচ্ছত্র দাপট দেখাচ্ছে মেয়েদের ডাবলস সার্কিটে সানিয়ারা।
সব মিলিয়ে সানিয়া-মার্টিনাকে অবশ্য এত তাড়াতাড়ি সর্বকালের সেরা ডাবলস টিম বলছি না। সেটা তর্কাতীত ভাবে এখনও অন্য মার্টিনা আর তাঁর পার্টনার পাম শ্রাইভারের জন্য তোলা থাকছে। অন্য মার্টিনা মানে অবশ্যই মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। বেশির ভাগ টেনিস-ভক্তই নাভ্রাতিলোভার আঠারোটা সিঙ্গলস গ্র্যান্ড স্ল্যামের কথা বলেন। কিন্তু তার পাশাপাশি ওর ডাবলস গ্র্যান্ড স্ল্যামের সংখ্যাটা কত জানেন? ৩১! যার মধ্যে কুড়িটা শ্রাইভারকে নিয়ে।
যদিও একটা বছরের কথা ধরলে সানিয়া-মার্টিনার সাফল্যও অবিশ্বাস্য! এ বছরের মার্চে ওরা জুটি বাঁধার পর ঠিকঠাক বিচারে মাত্র আট মাসে পেশাদার ট্যুরে ৯টা ট্রফি জিতল রবিবার। যার মধ্যে দু’টো গ্র্যান্ড স্ল্যাম, আর এ দিন ওয়ার্ল্ড ফাইনালস। যুক্তরাষ্ট্র ওপেন থেকে টানা চার মাস একটাও ম্যাচ হারেনি। সিঙ্গাপুরেই দেখুন না। বিশ্ব খেতাব জিতল গোটা টুর্নামেন্টে একটাও সেট না খুইয়ে। যাকে ধারাবাহিকতার শেষ কথা বললেও বোধহয় সবটা বলা হয় না! যেখানে চলতি মরসুমের সেরা আটটা ডাবলস টিম খেলছে, তার ফাইনাল সানিয়ারা জিতছে কিনা একটা সেটে বিপক্ষকে কোনও গেম না দিয়ে! সিঙ্গাপুরে এ দিন ফাইনালে সানিয়া-মার্টিনার সামনে ০-৬, ৩-৬ উড়ে গেল মুগুরুজা-নাভারো। যাদের মধ্যে কয়েক মাস আগে উইম্বলডন সিঙ্গলস রানার্স মুগুরুজা আমার মতে এ বছর মেয়েদের সার্কিটে স্কিলের দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত হওয়া প্লেয়ার।
মার্টিনার সঙ্গে সানিয়ার কোর্টে অসাধারণ বোঝাপড়া। মার্টিনার সার্ভ আর গ্রাউন্ডস্ট্রোকের বৈচিত্র, রিটার্ন, ভলি, ড্রপ শট, নেট প্লে-র পাশাপাশি ব্যাক কোর্ট থেকে সানিয়ার প্রচণ্ড জোরালো ফোরহ্যান্ড মিলেমিশে ওদের টিমকে দুর্ভেদ্য করে তুলেছে, সবই সত্যি। তবে আমার কাছে তার চেয়েও বেশি তাৎপর্যের সানিয়ার নিজস্ব পারফরম্যান্স।
দু’হাজার পনেরোর সানিয়ার মতো একটা গোটা মরসুম টানা এত ভাল ডাবলস খেলতে আমি লিয়েন্ডার বা মহেশকেও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না! এমনকী নিরানব্বইয়ে লি-হেশ জুটি যে বার চারটেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস ফাইনালের পাশাপাশি এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ফাইনালসেরও ফাইনাল খেলেছিল, সে বছরেও ওরা তিন-চারটের বেশি ট্রফি কিন্তু জিততে পারেনি। সেখানে সানিয়া এ বছর দশটা টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন। তার মধ্যে ন’টা হিঙ্গিসের সঙ্গে।
আবার শুধু হিঙ্গিসের পাশে খেলেই ওর সাফল্য সেটাও বলতে পারবেন না। বছরের গোড়াতেই সিডনি ওপেন জিতেছিল বেথানি মাটেককে পার্টনার নিয়ে। এমনকী রবিবার মেয়েদের টেনিস ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রাইজমানির যে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হল, সেটা সানিয়া গত বারও জিতেছিল কারা ব্ল্যাকের সঙ্গে। তার মানে মিডিয়া যে ডাবলস টিমকে আদর করে ‘সান্টিনা’ নাম দিয়েছে, সেই সানিয়া-মার্টিনা জুটির সাফল্যে আমাদের মেয়েটারও অবদান সমান। আমি তো বলব ফিফটি-ফিফটি।
হিঙ্গিসের কিছুটা বয়স (৩৫) হলেও সানিয়া এখনও তিরিশ পেরোয়নি। ফলে ওদের পার্টনারশিপ কমপক্ষে আরও তিন-চার বছর চলা উচিত। যদি না কোনও পেশাগত কারণে বিচ্ছেদ ঘটে তার আগে! সেটা না হলে আরও অনেক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে ওরা। সর্বকালের সেরা ডাবলস জুটির দাবিদারও হয়ে উঠবে।
এক-এক সময় যখন ভাবি, আমাদের দেশে যেখানে টেনিস বলতে বরাবর ছেলেদেরই বোঝায়, সেখানে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, কখনও বিদেশি কোচিং না পেয়ে, খেলাটা গোবর লেপা মান্ধাতা আমলের কোর্টে শুরু করে, আর্থ-সামাজিক প্রচুর বাধা-বিঘ্নের সামনে পড়েও কী ভাবে আজ ১২০ কোটি ভারতবাসীর টেনিসের মুখ, তখন আশ্চর্যই নয়, অত্যাশ্চর্য হয়ে যাই! একজন টেনিস প্লেয়ারের আন্তর্জাতিক সার্কিটে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার যেটা ‘প্রাইম টাইম’ সেই ২২-২৩ বছর বয়স নাগাদ সানিয়ার যদি বড় চোট না লাগত, যদি অস্ত্রোপচার না করতে হত, তা হলে সিঙ্গলসেও বিশ্বের প্রথম দশে উঠে আসত, আমি নিশ্চিত।
কিন্তু ডাবলসেই ও যা করেছে, একজন ভারতীয় মেয়ে টেনিস প্লেয়ার হিসেবে অতুলনীয়। এ দেশ থেকে দ্বিতীয় সানিয়া মির্জা বার করে আনাই হবে আমাদের মতো ভারতীয় টেনিস কোচেদের ওকে সত্যিকারের সম্মান জানানো!