জার্সি ছুড়ে সূচনা নতুন জমানার

কখনও গর্বিত সেনাপতি, কখনও উচ্ছল কিশোর

বিরাট কোহলির চুল আজ খুব ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে। অসংখ্য আকুতির হাত ছুঁতে চাইছে প্রাণপণ, আর তিনি ঝুঁকে নীচে। সিংহলিজ ভক্তের ভাষা দুর্বোধ্য, চাহিদা অসীম। কিন্তু তাতে কী? এতটুকু বিরক্তি নেই, বরং হাসি ঝুলে ঠোঁটে। কী মনে হল, এক টানে জার্সিটা খুলে ফেললেন। খালি গায়ে গটগট করে এগিয়ে এসে ছুড়ে দিলেন নীচে! কে বলবে, ওটা তাঁর ব্যক্তিগত স্মারক। দেখে তো মনে হল ওটা তাঁর বিদেশে প্রথম সিরিজ জয়ের জার্সি।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কলম্বো শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:৫৫
Share:

বিরাট কোহলির চুল আজ খুব ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে। অসংখ্য আকুতির হাত ছুঁতে চাইছে প্রাণপণ, আর তিনি ঝুঁকে নীচে। সিংহলিজ ভক্তের ভাষা দুর্বোধ্য, চাহিদা অসীম। কিন্তু তাতে কী? এতটুকু বিরক্তি নেই, বরং হাসি ঝুলে ঠোঁটে। কী মনে হল, এক টানে জার্সিটা খুলে ফেললেন। খালি গায়ে গটগট করে এগিয়ে এসে ছুড়ে দিলেন নীচে! কে বলবে, ওটা তাঁর ব্যক্তিগত স্মারক। দেখে তো মনে হল ওটা তাঁর বিদেশে প্রথম সিরিজ জয়ের জার্সি। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের বারান্দা থেকে ড্রেসিংরুমে গেলেন এক বার, এবং ফিরে এসে অন্য ‘বৃষ্টি’। জুতোর। আর্মব্যান্ডের। যা পাওয়া যায় হাতের কাছে।
বিরাট কোহলির চুল আজ খুব ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে। সাংবাদিক সম্মেলন সবে শেষ। ভারতীয় মিডিয়া ম্যানেজার ‘থ্যাঙ্কস এভরিওয়ান’ বলে দিয়েছেন। কিন্তু অধিনায়ক থামলে তো! মিডিয়ার ল্যাপটপ বন্ধ করতে গিয়েও করা হল না। কারণ বিরাট ততক্ষণে অদ্ভুত সব কাজকর্ম করতে শুরু করে দিয়েছেন। নিজের চেয়ারটাকে দু’তিন বার এমন ভাবে টানলেন, যেন ক্লাস ফাইভের কিশোরকে ফার্স্ট হওয়ার খবরটা তখনই স্কুলের হেডস্যার খুলে-আম দিতে বলেছেন! ক্যাপ্টেনের রকমসকম দেখে ম্যানেজার হেসে ফেললেন। পাশে বসা সিরিয়াস অশ্বিনকেও দেখা গেল, হাসি চাপতে পারছেন না। বিরাট চার দিক দেখে নিজেও একগাল হেসে বলে দিলেন, “আমি আসলে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আপনারা গল থেকে আমাদের সাপোর্ট করে গিয়েছেন। ঈশ্বর আপনাদের ভাল করুন!” ভারত অধিনায়ক দেশজ মিডিয়াকে এ সব বলছেন, ঠিক কত দিন পর হচ্ছে এমন ভারতীয় ক্রিকেটে? মহেন্দ্র সিংহ ধোনির রাজপাটে এ সব স্বপ্নেও ভাবা যেত?
বিরাট কোহলির চুল আজ খুব ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে। ইশান্ত শর্মার সঙ্গে ধামিকা প্রসাদের ব্যাপারটা তাঁর নাকি বড় ভাল লেগেছে! গণ্ডগোলের টাইমিংটা নাকি একদম পারফেক্ট ছিল! “আরে, আমাদের তার কিছুক্ষণ পরেই বল করতে হত। মোক্ষম সময়ে ওরা ইশান্তকে রাগিয়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম, দারুণ ব্যাপার হবে এখন। ইশান্ত তেতে থাকবে,” দুলে দুলে বলে যান বিরাট। মিডিয়া স্তম্ভিত। টিমের সেরা পেসার শাস্তি পাচ্ছেন, আর অধিনায়ক কী বলছেন? “বুঝলেন না? দেখুন, দ্বিতীয় ইনিংসে ইশান্ত একটা সময় ওর উনিশ ওভারে একটাও বাউন্ডারি দেয়নি। প্রেশারটা তো ওরাই তৈরি করে দিল। ইশান্ত তখনই ঠিক করে ফেলল যে, এ বার ও দেখে নেবে। আমি তাই অত্যন্ত খুশি!

Advertisement

বিরাট কোহলির চুল আজ খুব ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ইয়ার্কি মারছেন, পিছনে লাগছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে কত দিন যে এমন ফুরফুরে পরিবেশ আসেনি! অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজের প্রেস মিট থেকে শুরু হল। এক তরুণী সিংহলিজে শ্রীলঙ্কা অধিনায়ককে প্রশ্ন করছেন শুনে হাতের মোবাইল নাড়াচাড়া থামিয়ে বড় বড় চোখদুটো তরুণীর দিকে ঘুরে গেল। অল্প অল্প দুলতে থাকল মাথা! যেন বলতে চাওয়া, সবই আমি বুঝতে পারছি! পরে তাঁকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, এই জয় অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে কতটা পরিণত করে দেবে? চটজলদি উত্তর এল, “সেটা প্লিজ আপনারাই লিখুন যা মনে হয়। মানে, আমি বড় হলাম না কি হলাম না। নইলে পরে একটা হারব আর আপনারাই বলবেন, বিরাট আবার বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। ও সবে আমি নেই!”

আসলে ইনি এমন এক সাফল্যের মুখ, যিনি একটু আগে প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া গৌরবের জলে স্নান করে উঠেছেন। গত বাইশ বছরে সৌরভ থেকে ধোনি, কেউ তো সিংহল-সাম্রাজ্যে সিরিজ জয়ের মুকুট পরতে পারেননি। বিরাট সেটা পেরেছেন। তা ছাড়া ইনি এমন এক সাফল্যের মুখ, যাঁর যাবতীয় স্ট্র্যাটেজিও ভারতের ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। টেস্টে এমএসডির ধ্যানধারণা থেকে সরে পাঁচ বোলারে গিয়েছেন। এবং যুদ্ধ জিতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়েছেন। যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেটের কথা তিনি ও তাঁর টিম বারবার বলে গিয়েছে, সেটা চর্মচক্ষে ক্রিকেটবিশ্বকে দেখিয়েছেন।

Advertisement

বিরাট আজ গর্বিত সেনাপতির মতো বলতেই পারেন, “আমার কখনওই মনে হয়নি যে, ম্যাচটা বেরিয়ে যেতে পারে। আসলে যখন একটা পার্টনারশিপ হয়, তখন চুপচাপ দেখতে হয় ম্যাচটা কোন দিকে যাচ্ছে। টেস্টে পঞ্চম দিন একশো রানের পার্টনারশিপ তো হবেই। কিন্তু সুযোগ তোমারও আসবে। আর একটা এলেই সেটা ঝাঁপিয়ে নিতে হবে।” তিনি সদম্ভ ঘোষণায় এটাও আজ বলতে পারেন যে, “এই সিরিজে বোলিংটাই আমাদের সেরা প্রাপ্তি। টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে কুড়িটা উইকেট নিতেই হবে। গলে আমরা হেরে গিয়ে ঘাবড়ে যাইনি। বরং সবাই মিলে কথা বলে ঠিক করেছিলাম কী ভাবে কামব্যাক করব। এই যে বিশ্বাসটা পেয়ে গেলাম, এটা আমাদের পরবর্তী যুদ্ধে নিজেদের ঘরানার ক্রিকেট খেলতে সাহায্য করবে, দেখবেন। আমরা মুখে বলতাম টেস্ট জিতে দেখাব, টেস্ট জিতে দেখাব। কিন্তু যতক্ষণ সেটা হচ্ছিল না, টিমে বিশ্বাসটা আসছিল না। আজ আমরা বিদেশে সিরিজ জিতে দেখালাম।” ঠিক। যা বলেছেন, করে দেখিয়েছেন।

আর তাই আজ বিরাট কোহলির চুল বারবার ঘেঁটে দিতে ইচ্ছে করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন