আর কখনও বোর্ড প্রেসিডেন্ট ঘরে ঢুকে নির্বাচকদের খারিজ করতে পারবে না

সরাসরি কথা বলেন। তীক্ষ্ম জবাব দেন। কিন্তু সোমবারের বিশাল জয়ের পর রাজেন্দ্র মাল লোঢা যেন তূরীয় মেজাজে। নয়াদিল্লির বাড়ি থেকে আনন্দবাজারকে লম্বা ফোন সাক্ষাৎকার দিলেন এমন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে, যেন টি-টোয়েন্টির শেষ ওভার ব্যাট করছেন।সরাসরি কথা বলেন। তীক্ষ্ম জবাব দেন। কিন্তু সোমবারের বিশাল জয়ের পর রাজেন্দ্র মাল লোঢা যেন তূরীয় মেজাজে। নয়াদিল্লির বাড়ি থেকে আনন্দবাজারকে লম্বা ফোন সাক্ষাৎকার দিলেন।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:১৬
Share:

রাজেন্দ্র মাল লোঢা

প্রশ্ন: বোর্ডে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি আজকের দিনটা যে আসবে।

Advertisement

লোঢা: কেন?

প্র: কারণ প্রধান বিচারপতি ঠাকুর রিটায়ার করে যাবেন ৪ জানুয়ারি। সবাই ভাবছিল আদালতে সিন্ধান্ত নেওয়া যেমন নিয়মিত পিছোচ্ছে, তাতে ৪ জানুয়ারি পার করে দিলেই হল। বোর্ড বেঁচে গেল। নিশ্চিন্ত।

Advertisement

লোঢা: এটা কোনও কথা হল? বিচারপতিরা আসেন-যান। সুপ্রিম কোর্ট তার মতো করে ন্যায়বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যক্তিবিশেষের ওপর সিদ্ধান্ত নির্ভর করে না।

প্র: বলা হচ্ছে আজকের দিনটা এত বিশাল, এত প্রভাবশালী যে, জাস্টিস লোঢা নামটা ভারতীয় ক্রিকেটে চিরকালীন ভাবে ঢুকে গেল।

লোঢা: আমি অতশত বলতে পারব না। এটুকু বলতে পারি, আজকের রায়ের উপর ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমী খেলাটার মধ্যে স্বচ্ছতা খুঁজে পাবেন। পেশাদারিত্ব খুঁজে পাবেন। আজ দেশে ক্রিকেট যেখানে দাঁড়িয়ে, তার মূলে ওঁদের সমর্থন। অথচ ওঁদেরই সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কিছু কর্তা নিজেদের কুক্ষিগত করে বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই মৌরসিপাট্টা বন্ধ হল আজ থেকে।

প্র: বহু বছর ধরেই অনেকে বলছিল বোর্ড চলে একটা প্রাইভেট কোম্পানির মতো। অথচ তার রেশ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মতো। প্রভাব পড়ে বৃহত্তর জনতার ওপর। সেই দর্শনে কি কোথাও কন্ট্র্যাডিকশন রয়েছে?

লোঢা: ভাল বলেছেন। ঠিক তাই হচ্ছিল। ক্রিকেট বোর্ড এত বছর ধরে চালানো হচ্ছিল সম্পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক ভাবে। যা-তা সব কাণ্ড হতো। লোকে ধন্দে পড়ে যেত, যা দেখছে জেনুইন খেলা তো? না কি বেটিং চলছে? নির্বাচন কি ঠিকঠাক হচ্ছে? না কি কিছু প্লেয়ার পিছনের দরজা দিয়ে কর্তাদের সুপারিশে দলে ঢুকছে?

প্র: কিন্তু ইন্ডিয়ান টিমের দিকে যদি তাকান, এখন তো ভারত টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে পয়লা নম্বরে। অনুন্নত অনেক শহর থেকে ছেলেরা এখন ইন্ডিয়া টিমে ঢুকছে। নির্বাচন নিয়ে কারচুপি হচ্ছে কী ভাবে বলা যাবে?

লোঢা: অবশ্যই বলা যাবে। দেখুন ভাই, ৮/৯ জন প্লেয়ার নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত করে নেয়। তাদের নিয়ে ভাবার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। গণ্ডগোল হল বাকিগুলোকে সিলেক্ট করার। অনেক সময় প্রেসিডেন্ট এসে বাকি সিলেক্টরদের ঘাড়ে চেপে বসে। তারা যা-যা ঠিক করে দিল, সব খারিজ করে দেয়।

প্র: হয়েছেও এমন ঘটনা। নির্বাচকেরা মিলে ঠিক করে দিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরিয়ে দেবেন। শ্রীনিবাসন এসে সেটা খারিজ করে দেন।

লোঢা: এগজ্যাক্টলি। আমি তো ওই ঘটনার কথাই বলছি। প্রশাসন বলে কোনও বস্তু নেই। কোনও স্বচ্ছতা নেই। সবটাই একনায়কতন্ত্র। এটা কেমন কথা হল তুমি পাঁচজন পেশাদার নিযুক্ত করেছ দেশের টিম আর ক্যাপ্টেন বাছার জন্য। এ বার একটা লোক ঢুকল। ঢুকে সব কিছু ভেস্তে দিল। আমার কথা হল, তুমি কে যে তোমার ভেটো পাওয়ার থাকবে?

প্র: কিন্তু বিসিসিআই সংবিধানে তো রয়েছে প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া জাতীয় দল নির্বাচন বৈধ নয়।

লোঢা: আমি এই আইনের ভিত্তিকে আক্রমণ করতে চাই। এটা অত্যন্ত আপত্তিকর। হতে পারে না! তা হলে তো একটা লোক সবাইকে ছাপিয়ে সুপার সিলেক্টর হয়ে গেল। দেশের আইন তাকে সমর্থন করতে পারে না।

প্র: আমার আইনি অজ্ঞতা মাফ করবেন। বোর্ডের লোকেদের মুখে শুনেছি ক্রিকেট বোর্ড তৈরি তামিলনাড়ু রেজিস্টার্ড কোঅপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট অনুযায়ী। সেই আইন নাকি সব কিছুর আওতায় পড়ে না।

লোঢা: দেখুন ভাই, আমার কথা খুব সিম্পল। তোমার গঠনতন্ত্র যা-ই হোক, তুমি মোটেও প্রাইভেট বডি নও। তোমার অ্যাকশনে গোটা দেশের জনতা প্রভাবিত হচ্ছে। তুমি ইন্ডিয়ান লোগো ব্যবহার করছ। তা হলে তুমি প্রাইভেটের ছাড় পাবে কেন?

প্র: ক্রিকেট সমর্থকেরা তো বকলমে এক-একজন শেয়ারহোল্ডার।

লোঢা: অ্যাবসলিউটলি। তারাই তোমাকে টানছে। তারা মাঠে আসছে বলেই তুমি এত কোটি-কোটি টাকা কোষাগারে ভরতে পারছ। আর তাদের কিনা তুমি কিছু জানতে দিচ্ছ না। যা মন চায় প্রাণ চায় তোমরা কয়েকটা লোক মিলে করে যাচ্ছ। আজকের রায় সেই অন্ধকার পদ্ধতিগুলোরই সর্বাঙ্গীণ সংস্কারের কথা বলে।

প্র: একটা কথা বলুন। বোর্ড যদি আদালতে এত অনমনীয় না হতো, তা হলে আপনার কমিটির সুপারিশ কি এত কঠোর হতো?

লোঢা: অবশ্যই না। বোর্ড বেয়াদপি করে, আদালত-বিরোধিতা করে আরও ব্যাপারটা ডেকে আনল।

প্র: বোর্ড কর্তাদেরও নিশ্চয়ই একটা অঙ্ক ছিল। নইলে তাঁরাই বা জেদ আঁকড়ে পড়ে থাকবেন কেন? সেটা কোন অঙ্ক বলে মনে হয়?

লোঢা: জানি না। জানার কোনও স্পৃহাও নেই।

প্র: অনেকের মনে হচ্ছে তাঁরা ভাবছিলেন লোকসভায় স্পোর্টস বিল পাশ করিয়ে আদালতের রায় উল্টে দেওয়া যাবে। আচ্ছা এখনও সেটা কি সম্ভব?

লোঢা: কোনও আইনের ভিত্তি যদি ঠিকঠাক সংশোধিত হয়ে থাকে, তা হলে তা আর বদলাবে কী করে? যদি ফাউন্ডেশনে কোনও গণ্ডগোল থেকে থাকে, একমাত্র তা হলেই তার সংশোধন সম্ভব।

প্র: যেমন সত্তর বছরে বোর্ড থেকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে হবে, ওই নিয়ম। অফিশিয়ালদের কাছে এটাই সবচেয়ে আপত্তিকর ঠেকছে। মনে করা যাক লোকসভায় স্পোর্টস বিল পাশ করে ওটা আশি হয়ে গেল।

লোঢা: আপত্তিকর কেন?

প্র: কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর বয়সসীমা নেই। রাষ্ট্রপতির নেই। ক্রিকেট কর্তা তা হলে কী দোষ করল?

লোঢা: এজ লিমিট তো অনেক চাকরিতেই রয়েছে। নেই কে বলল ওদের? সরকারি চাকরিতে ৫৮ বছরে অবসর নিতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অবসর নেন ৬৫ বছর হলে। হাইকোর্ট জাজের ক্ষেত্রে ওটা ৬২। আমার তো মনে হয় স্পোর্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে খুব অ্যালার্ট থাকা উচিত। তা ছাড়া সত্তর বছর বয়স তো যথেষ্ট। আমার তো মনে হয় যে কোনও চাকরির জন্য ৭০ যথেষ্ট রিজনেবল বয়স।

প্র: এঁদের তো মনে হচ্ছে এই যে ন’বছর হল কী প্রশাসন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, সেটা অন্যায়।

লোঢা: ন’বছরটা কীসে কম আমাকে বলুন তো? বোর্ড প্রশাসনে কেউ কি ষাট বছরে আসে নাকি? আপনারা জানেন তার অনেক আগেই আসে। তো সেই লোক তো ন’বছর মেয়াদ পুরো পাচ্ছে। এমনকী একষট্টিতে জয়েন করলেও পাচ্ছে। সরকারি কর্মী বা আমলাদের আমরা বাইরে রেখেছি। কিন্তু তাঁদেরও তো পোস্ট রিটায়ারমেন্ট বোর্ডে এসে পুরো টার্ম শেষ করে যাওয়ার সমস্যা নেই। সে যদি ৫৯ বছরে ঢোকে, ৬৮ অবধি তো থাকতে পারছে। আমার তো মনে হয় সত্তর বছরের আইনটা যথেষ্ট ফেয়ার।

প্র: সংস্কারমুখী এই যে বোর্ড আগামী দিনে আসবে, তাতে আপনি কি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা মোহিন্দর অমরনাথ জাতীয় চরিত্রকে দেখতে চান যাঁরা একটা সময় প্রশাসনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন?

লোঢা: আমি নিজে থেকে কারও নাম করতে চাই না। তবে আপনি যে দুটো নাম তুললেন, দুটোই ভাল নাম। আমরা তো অ্যাড হক মোহিন্দরের নাম অন্যতম অন্তর্বর্তিকালীন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে প্রস্তাবও করেছিলাম। বোর্ড সেটা খারিজ করে। গাঙ্গুলির নামটাও ভাল। শুধু ভাল ক্রিকেট-বোদ্ধা বলে নয়। ও প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য বেঙ্গলের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অনেক উপকৃত হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন