গোলের নীচে দেবজিৎ মজুমদার থাকলে সেই দলের কোচের কপালের ভাঁজ অর্ধেক কমে যায়। মোহনবাগান থেকে আটলেটিকো দে কলকাতা। ক্লাব ফুটবল থেকে আইএসএল—সাম্প্রতিক কালে এ রকম ধারাবাহিক গোলকিপিং কোনও ভারতীয় গোলকিপার সম্ভবত করেননি। আগের দিন দিল্লি ডায়নামোসের বিরুদ্ধে কলকাতার নিশ্চিত হার বাঁচিয়ে সোমবার শহরে ফেরার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আনন্দবাজার-কে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি। জিমে যাওয়ার ব্যস্ততা থেকে সময় বাঁচিয়ে।
প্রশ্ন: আপনার গোলকিপিংয়ের প্রশংসায় এখন সবাই পঞ্চমুখ। আপনি নিজে কী বলছেন দেবজিৎ মজুমদার সম্পর্কে?
দেবজিৎ: এ সব প্রশংসা-টশংসা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। এক কান দিয়ে ঢোকাই, অন্য কান দিয়ে বার করে দিই। কলকাতা দলে আমার কাজ হল বিপক্ষকে গোল করা থেকে আটকানো। পেনাল্টি রোখার চেষ্টা করা। সেই কাজটুকু করে চলেছি মাত্র।
প্র: ধারাবাহিকতা দেখানোর জন্য ফুটবলমহল আপনাকে ‘সেভজিৎ’ বলছে। ধারাবাহিকতার রসায়নটা কী?
দেবজিৎ: ও সব নাম মিডিয়ার দেওয়া। তবে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে আমি সব সময় খুঁতখুঁতে। বিশ্বাস করুন, যতগুলোই সেভ করি না কেন, নিজে সন্তুষ্ট হতে পারি না। প্রত্যেক ম্যাচের পর বারবার মনে হয়, এর থেকেও ভাল করতে পারতাম। মনে মনে বলি, পরের ম্যাচে আমাকে আরও ভাল করতে হবে। নিজের খেলা ভিডিওতে দেখি। যে ভুলগুলো করেছি, ভিডিও দেখে শুধরোনোর চেষ্টা করি।
প্র: মালুদার মতো বিশ্বকাপার পেনাল্টি মারতে আসছেন। গোলে আপনি। মনের অবস্থা সেই সময় ঠিক কেমন ছিল আপনার?
দেবজিৎ: ও রকম সিচুয়েশনে কিছুই ভাবার-বোঝার সময় পাওয়া যায় না। অন্য সব পেনাল্টি বাঁচানোর জন্য যেমন মরিয়া থাকি, মালুদার শটের সময়ও তাই ছিলাম। ওই সময় আমার চোখ থাকে বল-এ। পেনাল্টি যে ফুটবলার মারছে তার মুভমেন্টে। আর একটা কথা এখানে বলি, রবিবার যেমন একটা পেনাল্টি বাঁচিয়েছি, তেমনই মাথায় রাখছি, দু’টো ফিল্ড গোলও খেয়েছি। সেটা না হলেই ভাল হত।
প্র: কিন্তু সব সময় তো গোলকিপারের দোষে টিম গোল খায় না!
দেবজিৎ: কিন্তু টিম গোল খেলে গোলকিপারের মানসিক যন্ত্রণাটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই হয়। আমার তো খুব খারাপ লাগে। বারবার মনে হয়, আমার জন্যই টিম গোল খেয়ে গেল। তবে সেই যন্ত্রণাটাই আমাকে পরের ম্যাচে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। আরও ভাল খেলতে প্রেরণা জোগায়।
প্র: এটিকে সেমিফাইনাল পৌঁছতে পারবে?
দেবজিৎ: কেন পারবে না! এখনও অনেক ম্যাচ বাকি। আর আমরা তো খুব খারাপ জায়গায় নেই। তবে হ্যাঁ, দিল্লি ম্যাচটা আমাদের জেতা উচিত ছিল। দিল্লি থেকে তিন পয়েন্ট নিয়ে ফিরতে পারলে সুবিধে হত।
প্র: কত পয়েন্ট পেলে আপনারা সেমিফাইনালে যাবেন মনে করছেন?
দেবজিৎ: এটা এই মুহূর্তে বলা খুব শক্ত। এক-একটা ম্যাচের পর যে ভাবে লিগ টেবলের চেহারা বদলে যাচ্ছে! তবে আমার নিজের হিসেব, ২১ পয়েন্ট পেলে আমরা সেমিফাইনালে উঠব। তবে পরে এই হিসেব পাল্টাতেই পারে।
প্র: আপনি মোহানবাগান গোলের নীচে আই লিগে সফল। আইএসএলেও দারুণ খেলছেন এটিকে-তে। দু’টোর কোনটা আপনার কাছে বেশি চ্যালেঞ্জিং?
দেবজিৎ: দু’টো টুর্নামেন্ট একেবারে আলাদা। তবে দু’টোই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। সমান চ্যালেঞ্জের। মাঠে ভাল পারফরম্যান্স করতে হবে, এটাই আমার শেষ কথা। এমনকী প্র্যাকটিস ম্যাচও সমান গুরুত্ব দিয়ে খেলি।
প্র: আপনি পুরোপুরি পেশাদার প্লেয়ারের মতো বলছেন!
দেবজিৎ: পেশাদার তো হতেই হবে। তবে ফুটবল খেলাটা আমার কাছে শুধু পেশা নয়। আবেগ, ভালবাসারও জায়গা। ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি অদ্ভুত টান আমার। বাবার হাত ধরে প্রথম উত্তরপাড়ার নেতাজি ব্রিগেড ক্লাবে গিয়েছিলাম। তখন আমি বয়স তেরো কী চোদ্দো। সেই থেকে আমার জীবনটা একেবারে পাল্টে গেল। ওই ক্লাবের মূলমন্ত্র ছিল, ফুটবল খেললে একশো ভাগ সিরিয়াসলি খেলবে। বড় ক্লাবে খেলতেই হবে, এ রকম মানসিকতা নিয়ে তৈরি হবে। আমি তখন থেকে বড় ক্লাবে খেলার, ভাল খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমাদের ওখানকার সৌমিকদা (দে) তখন ইস্টবেঙ্গলে খেলছে। ওর উদাহরণও দেওয়া হত আমাদের। এখনও সুযোগ পেলেই ওখানে প্র্যাকটিস করি।
প্র: বাবা আপনাকে নিশ্চয়ই খুব উৎসাহ দিতেন?
দেবজিৎ: বাবা-মা দু’জনেই সব সময় আমার পাশে থেকেছে। তবে আমি যখন মাধ্যমিক দেব, সে সময় বাবা মারা যায়। তার পরেও মা কখনও আমাকে সংসারের কোনও কিছুর মধ্যে জড়ায়নি। সব সময় বলত, মন দিয়ে ফুটবল খেল। প্রতি মুহূর্তে উৎসাহ দিয়েছে। হয়তো এ সব ঘটনাগুলো আমাকে আরও মানসিক ভাবে শক্তিশালী করেছে।
প্র: দেবজিৎ মানেই যেন প্রত্যাবর্তন। বারবার। আপনি তো লড়াই করে ফিরে আসার প্রতীক হয়ে যাচ্ছেন!
দেবজিৎ: কী রকম?
প্র: ইস্টবেঙ্গলে সুযোগ না পাওয়া। মোহনবাগানে এসে শিল্টন পালের চোটের জন্য হঠাৎই প্রথম একাদশে সুযোগ ঘটা। তার পরে অসাধারণ পারফরম্যান্স। মাঝে আবার চোটের জন্য মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল। চোট থেকে ফিরে আবার অনবদ্য গোলকিপিং।
দেবজিৎ: আমি হার্ডওয়ার্কে বিশ্বাস করি। ভাল কিছু করতে হলে প্রচুর খাটতে হয়। সেই চেষ্টাই করি। আমার জীবনে ফুটবলই শেষ কথা। ফুটবলের বাইরে কিচ্ছু ভাবি না। আর প্রতি মুহূর্তে চাই, বেটার থেকে বেস্ট হতে। কিন্তু কিছুতেই যেন বেস্ট হয়ে ওঠা হচ্ছে না!
প্র: সঞ্জয় সেন আর জোসে মলিনার কোচিংয়ের মধ্যে কী তফাত খুঁজে পেলেন? মলিনা নিজেও একজন প্রাক্তন গোলকিপার।
দেবজিৎ: আমি তফাত খোঁজার কে? যোগ্যতাই বা কী? আমি যে কোচের কাছে যখন থাকি তাঁর নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করি। কারণ, আমার কোচই আমাকে সবথেকে ভাল চেনেন। আর মলিনা নিজে গোলকিপার ছিলেন বলে সেটা আমার জন্য আরও ভাল হয়েছে। উনি নিয়মিত আমাকে কিপিংয়ের নানা টিপস দেন। ভুলত্রুটি নিজে হাতে বুঝিয়ে দেন। তবে সঞ্জয় স্যারও একই কাজ করেন মোহনবাগান। তা ছাড়া এটিকেতে শুধু মলিনা নন, গোলকিপার কোচও সাহায্য করেন।
প্র: আইডল গোলকিপার কে?
দেবজিৎ: সন্দীপ নন্দী। সব সময় ওর থেকে পরামর্শ নিই। ফোনে আমাদের প্রায়ই কথা হয়।
প্র: পরের ম্যাচ নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। ওদের মাঠে গিয়ে হারিয়ে এসেছিলেন। এ বার কী মনে হচ্ছে?
দেবজিৎ: আমাদের সব ম্যাচ জিততে হবে। নর্থ-ইস্টের বিরুদ্ধে তিন পয়েন্ট ছাড়া ভাবছি না। এখন সব পয়েন্ট আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
প্র: এটিকেতে আপনাকে একজন বিদেশি গোলকিপার (দানি মাল্লো), একজন সিনিয়র ভারতীয় গোলকিপার (শিল্টন) তাড়া করছেন সব সময়। প্রথম এগারোয় নিজের জায়গা হারানোর ভয় নেই আপনার?
দেবজিৎ: একেবারেই না। শিল্টনদার সঙ্গে তো ক্লাব ফুটবলে এক টিমে অনেক দিন খেলছি। আর দানি (মাল্লো) তো সব সময় উৎসাহ দেয় আমাকে। আর আমি ভাল খেললে কোচ খেলাবেন। না হলে বসিয়ে রাখবেন। ফুটবলদুনিয়ায় এটাই সার সত্য। পারফর্মারদের প্রত্যেক দিন পারফর্ম করতে হয়। সেটাই মাথায় রাখি।