আন্তোনিও হাবাসের রোষানলে পড়ার সময়ের আগুনে মুখাবয়বটা চব্বিশ ঘণ্টা পরেও ভুলতে পারছেন না ওই কর্তা। সোমবার বিকেলেও তা জ্বলজ্বল করছে তাঁর চোখের সামনে।
রবিবাসরীয় রাতে ধুন্ধুমার ম্যাচে জিকোর টিমকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার পর উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে আটলেটিকো দে কলকাতার এক মাঝারি কর্তা স্প্যানিশ কোচকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কোচ এই জয়ের পরে একটা ছোট পার্টি তো হোটেলে হতেই পারে। গোয়ার মতো টিমকে চার গোল!
শুনে দ্যুতি-হিউমদের কোচ এতটাই রেগে যান যে বলে ওঠেন, ‘‘পার্টি! কীসের পার্টি? ওটা হতে পারে শুধু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রাতে। এখনও তো আমরা সেমিফাইনালেই উঠিনি।’’
একই রকম ঘটনা ঘটেছিল মুম্বইয়ে। পরপর তিনটে ম্যাচ হারের পর সুনীল-সনিদের মুম্বইকে ভোকাট্টা করে দিয়েছিল কলকাতা। হ্যাটট্রিক করেছিলেন ইয়ান হিউম। হোটেল কতৃর্পক্ষ ওই জয় সেলিব্রট করতে কেক নিয়ে এসেছিলেন। হিউমকে দিয়ে কাটাবেন বলে তৈরি ছিল ছুরিও। টিম বাস হোটেলে ফেরার পর হিউমের হাতে ছুরি তুলে দিতেই প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন হাবাস। দৌড়ে গিয়ে সেটা কেড়ে নিয়ে হিউম-সহ পুরো টিমকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঘরে। কলকাতার হেড মাস্টারের ধমক থেকে বাঁচতে পারেননি হোটেল কর্মীরাও।
আন্তোনিও হাবাস যে আপসহীন, জেদি এবং চূড়ান্ত পেশাদার, এটা এখন সবারই জানা। কিন্তু তিনি যে কতটা বাস্তবের জমিতে হাঁটেন, সেটা এখনও অজানা অনেকেরই। রবিবার রাতে গাড়িতে ওঠার আগে তাঁকে একান্তে বলতে শুনেছি, ‘‘ঠিক কত পয়েন্ট হলে সেমিফাইনালে পৌঁছনো যাবে, বিশ্বাস করুন সেটা এখনও বুঝতে পারছি না। লড়াইটা এ বার বেশ কঠিন। প্রথমে ভেবেছিলাম ২১-২২ হলে হয়ে যাবে। এখন মনে হচ্ছে ২৪ চাই।’’ ঘিরে ধরা একদল সই শিকারির আবদার মিটিয়ে সাদা শার্টের অন্ধভক্তের পরের মন্তব্য ছিল, ‘‘টিমটাকে এখন শান্ত রাখতে হবে। কুল, কুল। এই জেতাটা ভুলে যেতে হবে। সামনের দু’টো ম্যাচ জিততেই হবে।’’
হাবাস যা বলছেন, তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে লিগ টেবলের অঙ্কও। সেই অঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছে, হাবাস অ্যান্ড কোম্পানির কাছে সেমিফাইনাল যদি হয় নয়াদিল্লি স্টেশন, তা হলে টিমের বর্তমান অবস্থান গাজিয়াবাদ।
শুধু হাবাস নন। প্রায় একই রকম অবস্থা রবের্তো কার্লোস, জিকো, ডেভিড প্ল্যাট, সিজার ফারিয়াসদের টিমেরও। অঙ্কের হিসাবে এখনও কেউ যেমন শেষ চারে নিশ্চিত নয়, তেমন আবার কেউ ছিটকেও যায়নি। তবে আপাতত মনে হচ্ছে কলকাতা-সহ আইএসএলের অন্তত পাঁচটা দল শেষ চারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আছে। এরা— দিল্লি, গোয়া, পুণে, নর্থইস্ট এবং কলকাতা।
আট দলের যে কোনও লিগই অনেকটা সাপ-লুডোর মতো হয়। হাবাসের দলের সামনে দু’টো সাপের মুখ ওঁত পেতে বসে। বিপদে ফেলার জন্য। ডেভিড প্ল্যাটের এফসি পুণে এবং আনেলকার মুম্বই সিটি এফসি। সহজ অঙ্ক— শেষ চার নিশ্চিত করতে একটা জয় আর একটা ড্র হলেই চলবে। কিন্তু যদি দু’টো ম্যাচই ড্র হয়, সে ক্ষেত্রে অন্য দলের ফলের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে।
শুক্রবার পুণেকে হারাতে পারলে কলকাতা পৌঁছে যাবে ২৩ পয়েন্টে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। পুণে কোচ ডেভিড প্ল্যাট ম্যাচটা নিয়ে এতটাই সিরিয়াস যে, রবিবার টিভির উপর ভরসা না রেখে নিজে চলে এসেছিলেন কলকাতা-গোয়া ম্যাচ দেখতে। কিন্তু পুণে ম্যাচ জিতে গেলেও কি কলকাতা নিশ্চিত? অঙ্কের বিচারে একেবারেই না। সনি-সুনীলদের বিরুদ্ধে ৪ ডিসেম্বরের ম্যাচ অন্তত ড্র করতেই হবে। কিন্তু দু’টো ম্যাচ কলকাতা হেরে গেলে? অতলান্ত খাদ আর অন্ধকার অপেক্ষা করে থাকবে গত বারের চ্যাম্পিয়নদের জন্য।
সুবিধা-অসুবিধার দাঁড়িপাল্লায় অবশ্য কলকাতার দিকেই এখন পাল্লা ঝুঁকে বেশি।
কলকাতার সুবিধা, তারা এখন লিগ শীর্ষে। যা টিমের মোটিভেশন বাড়াবেই। অর্ণব-নাতোদের বাকি দু’টো ম্যাচই ঘরের মাঠে। এগারো জন ফুটবলারের পাশাপাশি হাবাসের হয়ে মাঠে থাকবে সমর্থকদের শব্দব্রহ্মও। কলকাতার আরও সুবিধা হল, পুণে ম্যাচে নামার আগে এমন একটা ম্যাচ রয়েছে যার ফল বাড়তি সুবিধা এনে দিতেই পারে হিউমদের। সেটা হল, শেষ চারের লড়াইয়ে থাকা এফসি গোয়া বনাম নর্থইস্ট। যে ম্যাচটা ড্র হলে বা নর্থইস্ট হারলে অ্যাডভান্টেজ কলকাতা।
আর কলকাতার অসুবিধা? তারা সব টিমের চেয়ে দু’একটা করে ম্যাচ বেশি খেলে ফেলেছে। আট দলের মধ্যে কলকাতাই সব থেকে বেশি (১২) ম্যাচ খেলেছে। দিল্লি এবং মুম্বই খেলেছে ১০টা করে। বাকি পাঁচটি দল খেলেছে ১১টা। পয়েন্টের ব্যবধান এত কম যে, একটা ম্যাচে হার-জিত ওলট-পালট করে দিতে পারে সব কিছু। যেমন সপ্তাহখানেক আগেই মনে হচ্ছিল, মুম্বই টিমটা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। এখন তারা কোথায়? সাত নম্বরে। বিদায়ের পথে। সুব্রত পালের মুম্বইকে সাত গোল দেওয়ার পর জিকোর গোয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল অশ্বমেধের ঘোড়া। কলকাতার কাছে সেই টিম ধুলিসাৎ। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে জিকোকে শুনতে হয়েছে, এই বিশ্রী হারের পর ঘুরে দাঁড়িয়ে সেমিফাইনালে যেতে পারবেন? মাথা নিচু করে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি বলে দিয়েছেন, ‘‘সেটা তো আর একটা ম্যাচ। কাজটা কঠিন। খেলতে হবে নর্থইস্টের মতো টিমের বিরুদ্ধে। এখনও কিন্তু কোনও টিম নিশ্চিত নয়।’’
টানা হারের পর একটা সময় হাবাসের টিমকেও তো ফেলে দেওয়া হয়েছিল খরচের খাতায়। ‘আমাদের টিম, আমাদের স্বপ্ন’ থিম নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল কটাক্ষ। চেন্নাই আর গোয়া বধের পর অবশ্য বদলে গিয়েছে সব কিছু। সবাই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন, হাবাস ম্যাজিকে এ বারও টিম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে।
আইএসএলের নিয়মে কোচ বা ফুটবলারদের উপর কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে কোট করা যাবে না এই শর্তে তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, গোয়ার বিরুদ্ধে কলকাতার ম্যাচ দেখার পর সবাই ধরে নিয়েছেন হাবাসের টিম আটকে গেলে সেটা অঘটন হবে।
হাবাস তাঁর ফুটবলারদের সোমবার ছুটি দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে বসে পড়েছেন অঙ্ক কষতে। তাঁর দলের কর্তাদের মতোই। প্রকাশ্যে না হলেও সবারই ধারণা, তিন নম্বর হয়ে গত বারের মতো উঠবে কলকাতা। মুখোমুখি হবে দিল্লির।
গত বার ১৯ পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিল হাবাসের টিম। এ বার ইতিমধ্যেই ২০। তাতেও নিশ্চিত নয় শেষ চারে যাওয়া। তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদর ওঠার মতো অঙ্ক কষেই যেতে হচ্ছে আন্তোনিও হাবাসকে।
৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁকে কত বিনিদ্র রাত যে কাটাতে হবে!