শহরে তিন কন্যা। শ্যুটিংয়ের হিনা, বক্সিংয়ের মেরি ও স্কোয়াশের দীপিকা। ছবি: উত্পল সরকার
মাঝে আর এক বছর! তার পরেই ২০১৬ অলিম্পিক শেষে অবসর নেবেন। রিংয়ের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে সরিয়ে নেবেন নিজেকে। কোচ হিসাবে শুরু করবেন নতুন জীবন। এবং সেটা ইম্ফলে নিজের অ্যাকাডেমিতে।
ভারতীয় খেলাধুলোয় মেয়েদের আইকন মেরি কম যখন মঙ্গলবার দুপুরে আনন্দবাজারের কাছে একান্তে নিজের বক্সিং জীবন সমাপ্তির দিনক্ষণের চমকপ্রদ ঘোষণা করছেন তখনও তাঁর গলায় আক্ষেপ আর আফসোস।
“আমি নিশ্চিত, সিনেমাটা না হলে, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ‘মেরি কম’ না করলে আপনি আমার ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করতেন না,” বলতে বলতে যেন কিছুটা বিব্রত হয়েই হেসে ফেললেন পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
পাহাড়ি মেয়ে, তাই মুখাবয়ব আর চোখ দেখে সহজে বোঝা যায় না মনের ভেতর কী অনুভূতি চলছে। কিন্তু চেষ্টা করলে মালুম হয়, একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা এখনও প্রতিদিন তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। দেশের সব রাষ্ট্রীয় সম্মান, এশিয়াডে সোনা, অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পাওয়ার পরেও! “বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার পর সোনা জিতেছি। বিশ্বাস করুন, তার পরেও প্লেনে, ট্রেনে বা রাস্তায় কেউ আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়নি কখনও। আমাকে তো কেউ চিনতই না। আসলে মেয়েদের বক্সিংটাই তো ছিল ব্রাত্য। কিন্তু আমার জীবন নিয়ে সিনেমা বেরনোর পর পুরো ব্যাপারটা বদলে গিয়েছে। আমার সঙ্গে সবার সেলফিতে ছবি তোলার আবদার রাখতে রাখতে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। যেখানেই যাই লোকজন ঘিরে ধরে।”
মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের চাষির মেয়ে থেকে মেরি কমের জীবনের ক্যানভাস এখন দেশ জুড়ে ছড়িয়ে। চব্বিশ ঘণ্টা আগের রানিকুঠির স্কুলে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন নিগ্রহ থেকে বক্সিং ফেডারেশনের নতুন নিয়ম: মেয়ে ক্রীড়াবিদদের মাতৃত্ব পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা মেয়েদের নিয়ে যেখানে যত বিতর্ক সব প্রশ্নে তাঁর মন্তব্যের জন্য মুখিয়ে থাকে মিডিয়া। দেশের মেয়ে ক্রীড়াবিদরা জানতে চান ‘ম্যাগনিফিশিয়েন্ট মেরি’-র মনোভাব।
শহরের স্কুলের ঘটনা পুরো জানার পর তাঁর মন্তব্য, “আরও বেশি সুরক্ষা দরকার মেয়েদের। বিশেষ করে স্কুলে-কলেজে, বাসে-ট্রামে।” যার পর তাঁর উল্টো মন্তব্যও বেরিয়ে আসে দেশ জুড়ে মেয়ে বক্সারদের ‘অপমানজনক’ পরীক্ষার সামনে দাঁড় করানোর প্রশ্নে। বক্সিং ফেডারেশন নতুন নিয়ম করেছে, প্রতিযোগিতায় নামতে হলে অবিবাহিত এমনকী ছাত্রীদেরও পরীক্ষা দিতে হবে মাতৃত্বের।
“এতে দোষের কী আছে জানি না। কেন বিতর্ক হচ্ছে তা-ও বুঝতে পারছি না। সামান্য মূত্র পরীক্ষাতেই যেখানে সব ধরা পড়ে, তাতে এত বিতর্ক কীসের। বরং এতে তো মা আর তাঁর বাচ্চা, দু’জনেরই ভাল। স্বীকার করছি, আমি এখনও পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাল করে খোঁজ করিনি। শুধু আমাদের, না কি সব খেলায় এটা চালু হয়েছে তা-ও জানি না। তবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার জন্য আট জনকে শুনলাম এই পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছে। আমি যদি যেতাম তা হলে মাতৃত্বের পরীক্ষা দিতাম কোনও বিতর্ক না তুলে। ”
কিন্তু আপনি তো তিন সন্তানের মা। পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতেই পারেন। অবিবাহিত মেয়েরা কেন মাতৃত্বের পরীক্ষা দেবেন? “সেটা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করা দরকার। কিন্তু এটা তো খুবই সাধারণ টেস্ট এখনকার যুগে।”
চোটের জন্য পরের সপ্তাহে কোরিয়ায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন মেরি। বলছিলেন, “রিও অলিম্পিকের জন্য এই টুর্নামেন্টে যাওয়াটা জরুরি ছিল। গত অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। অবসর নেওয়ার আগে রিও অলিম্পিকে সোনা জিততে চাই”
ইনচিওনে সদ্য এশিয়াড সোনা জেতার পরেও সাফ্যলের তীব্র খিদে একত্রিশ বছরের মেয়ের! যা এ দেশের বহু পেশাদার ক্রীড়াবিদেরই থাকে না। বলছিলেন, “শুধু বক্সিং নয়, কবাডি, শ্যুটিংয়ের মতো খেলাতেও একটু নজর দিক সবাই। এই যে কলকাতায় এসেছি, এখানে এখন আইএসএল ফুটবল নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে। এর পর ক্রিকেট হবে। এই দুটো খেলা নিয়েই সব আগ্রহ। অন্য খেলায় মিডিয়ার নজর পড়লে কিন্তু আরও মেরি কম উঠে আসবে। যারা পদক আনবে। আর পদক জেতার পরেও ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ ভুগবে না। ফুটবল বা ক্রিকেট কিন্তু কোনও দিন অলিম্পিক পদক আনতে পারবে না। তা হলে তা নিয়ে এত হইচই কেন?”
মেরি কলকাতায় এসেছিলেন একটি সংস্থার সংবর্ধনা নিতে। সঙ্গে দেশের আরও তিন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ স্কোয়াশের গ্ল্যামারকুইন ক্রিকেটার দীনেশ কার্তিকের হবু স্ত্রী দীপিকা পাল্লিকাল, দন্ত চিকিত্সক-শ্যুটার হিনা সিধু এবং প্যারা এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী গিরিশা হোসেঙ্গা। যাঁদের প্রত্যেকের জীবনেই রয়েছে চমকপ্রদ নানা গল্প। কিন্তু সব ছাপিয়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মেরি-ই। একান্ত সাক্ষাত্কারের শর্ত ছিল, কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না। তবু এই প্রশ্নটা এসেই পড়ল।
আপনার তিন সন্তানকে কি বক্সিং রিংয়ে নামানোর ইচ্ছে আছে? রিংয়ে আগুনে মেজাজে যিনি প্রতিপক্ষকে হেলায় হারান, সেই মেরি মুহূর্তে দায়িত্বশীল মা হয়ে ওঠেন। “ছেলেরা যদি চায় মার মতো হতে তা হলে আপত্তি নেই। তবে আমি ওদের উপর কিছু চাপিয়ে দেব না।”