রাজধানীতে আটলেটিকো কোচ। সোমবার। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়া
আটলেটিকো দে কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সাড়ে তিন মাস। তার ভেতরেই তাঁকে ঘিরে নানা গুঞ্জন। তিনি নাকি বদরাগী। ক্ষ্যপাটে গোছের। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা না-পসন্দ। তবে অনেক অনুরোধের পর আনন্দবাজারকে সাক্ষাত্কার দিতে রাজি হয়ে গেলেন আইএসএলে কলকাতা দলের স্প্যানিশ কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। দোভাষী মিগুয়েলকে পাশে নিয়ে দিল্লির এক পাঁচতারা হোটেলে বসলেন সোমবার দুপুরে। ভারতে আসার পর এই প্রথম এত অকপট তিনি। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে বলতে মনে হল, আদ্যন্ত পেশাদার মানুষটি আসলে কাজ পাগল। সিরিয়াস এবং নিজের সংকল্পে অটল!
প্রশ্ন: মাত্র এগারোটা ম্যাচ খেলেছেন। তার মধ্যেই আপনার টিমে নাকি নানা ঝামেলা চলছে?
হাবাস: ঝামেলা! কার সঙ্গে কার! কারা রটাচ্ছে এ সব? আমার টিমে কোনও সমস্যা নেই। সবাই পেশাদার ফুটবলার। একে অন্যকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা থাকবেই। কিন্তু সবার শেষে আমরা একটা টিম। দল হিসেবেই খেলছি।
প্র: অনেকেই বলছে, আপনি নাকি লুই গার্সিয়ার কথায় টিম করেন?
হাবাস: (গম্ভীর মুখ) আমি কারও কথায় টিম করি না। আমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা। আমার কাছে ভারতীয় বা স্প্যানিশ সবাই সমান। অন্য কোনও বিদেশিও আলাদা গুরুত্ব পায় না। যে ভাল পারফর্ম করবে তাকে প্রথম এগারোয় রাখব। যে পারবে না বাদ যাবে। সে যে-ই হোক।
প্র: ক্লাইম্যাক্স, মামুনুল, মহম্মদ রফিরা তো একটাও ম্যাচে সুযোগ পাননি এখনও!
হাবাস: (হেসে) সে তো বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদেও অনেক ফুটবলার গোটা মরসুম খেলার সুযোগ পায় না। বললাম তো, ম্যাচ জেতার জন্য যা-যা করতে হয় করব। তাতে কে বসল, কে নামল তা নিয়ে ভাবি না। তোয়াক্কাও করি না।
প্র: ফিকরু আসল সময়েই গোল করতে পারছেন না? মাঠে যেন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছেন! ওঁর সঙ্গে আলাদা কথা বললেন?
হাবাস: সব সময়ই কথা হয়। তবে কী কথা হয় বলব না। ফিকরু চেষ্টার ত্রুটি করছে না। আমরা গোলের প্রচুর সুযোগ তৈরি করছি, কিন্তু গোল হচ্ছে না। আর তার জন্য ফিকরু একা কেন দায়ী হবে? বোরহা, হোফ্রেরাও সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। ইউরোপে শুধু একা স্ট্রাইকার গোল করে না কি? তবে এটা মনে রাখবেন, আমরা ভাল খেলছি বলেই দশ রাউন্ড পর্যন্ত টানা এক নম্বরে ছিলাম।
প্র: ফিকরু আর গার্সিয়ার মধ্যে তো মাঠেই তর্কাতর্কি হচ্ছে? ঝামেলা কি মিটেছে?
হাবাস: কই, ওদের মধ্যে কোনও ঝামেলা নেই তো? আমি অন্তত জানি না। ফিকরু ছাড়া আমার হাতে কোনও পজিটিভ স্ট্রাইকার নেই। কলকাতার সঙ্গে দু’বছরের চুক্তি রয়েছে আমার। এটা এখনই বলে রাখছি, পরের বার টিম করার সময় দু’জন পজিটিভ স্ট্রাইকার নেব। দু’জন স্ট্রাইকার থাকলে ফর্মেশন তৈরি করা সহজ হয়। অনেক অঙ্ক করা যায়।
প্র: তা হলে ওয়ান স্ট্রাইকারের জায়গায় জোড়া স্ট্রাইকারে খেলবেন?
হাবাস: সেটা এখন বলে লাভ নেই। তবে এটুকু বলছি দলে একজন মাত্র স্ট্রাইকার থাকার জন্যই নিজেদের ডিফেন্স আগে আঁটোসাঁটো করে তবেই আক্রমণে ঝাঁপাতে হচ্ছে। আমার কোচিং দর্শন হল গোল খেলে টিমের আস্থা চলে যায়। গোল না খেলে পাল্টা আক্রমণে গিয়ে গোল করার কথা ভাবা যায়।
প্র: তা হলে কালও দিল্লির বিরুদ্ধে সেই ৪-২-৩-১? ফিকরু একা সামনে!
হাবাস: হতে পারে। টিমেও সামান্য পরিবর্তন করতে পারি। দেখা যাক। আজ তো প্র্যাকটিসই করতে পারলাম না। মাত্র আধঘণ্টার জন্য মাঠ দিয়েছিল। কী করাব? দশ মিনিট তো গা গরম করতেই চলে যায়। তার পর থাকে মাত্র কুড়ি মিনিট। সে জন্য সকালে দু’ঘণ্টা শুধু জিম করেছে টিম।
প্র: পরের বার কি ফিকরুকে টিমে রাখবেন? গার্সিয়াকে?
হাবাস: সেটা এ বারের টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর ঠিক করব। তবে এটাও বলছি, আইএসএলে যত মার্কি ফুটবলার আছে, তার মধ্যে আমার টিমের গার্সিয়াই সবচেয়ে ভাল খেলছে। চোটের জন্য ওকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, বিশ্রাম দিয়ে খেলাতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বসাতেও হচ্ছে। কিছু করার নেই। ডেঞ্জিল নেই। বলজিত্কে রাইট ব্যাক খেলাতে হচ্ছে। কী করব?
প্র: সেমিফাইনালের কথা চিন্তা করেই কি আরও বেশি করে এ ভাবে খেলিয়ে সুস্থ রাখার চেষ্টা করছেন গার্সিয়াকে?
হাবাস: সেমিফাইনাল, ফাইনাল নিয়ে ভাবছিই না। এখন শুধু দিল্লি ম্যাচ থেকে তিন পয়েন্ট তোলার কথা ভাবছি। তিনটে ম্যাচ বাকি আছে আমাদের। সেমিফাইনালে ওঠার জন্য এখনও তিন-চার পয়েন্ট চাই। কাল জিতলে তখন বাকি দু’টো ম্যাচ থেকে লাগবে আর এক পয়েন্ট। সে জন্য আরও বেশি জেতার জন্য ঝাঁপাব কাল।
প্র: আইএসএলে আসা জিকো, কাপদেভিয়ার মতো ফুটবলবিশ্বের প্রাক্তন নক্ষত্রদের অভিযোগ, রিজার্ভ বেঞ্চে আপনার মতো খারাপ আচরণ করতে ওঁরা নাকি কোনও কোচকে দেখেননি!
হাবাস: (দোভাষীর দিকে হেসে তাকিয়ে) ওরা এ সব বলছে নাকি? বলুক। বলে যাক। ইউরোপের কোচেরা মাঠে কী করে ওরা কি দেখে না? শুনুন, মাঠে নিজের টিমকে উদ্বুদ্ধ করতে যা করার করব। এটা ইমোশনাল ইনভল্ভমেন্ট। প্যাশন। পুরো টিমকে মাঠে পুশ করতে হয়। এটা কোচের কাজ। আমি এটা করবই।
প্র: আপনার টিমেও কিন্তু অনেকে গোপনে বলে থাকেন, আপনি বদমেজাজি, প্রচণ্ড কড়া। স্কুলের হেডমাস্টারের মতো আচরণ করেন!
হাবাস: জেতার জন্য যা করতে হয় করব। যে কোনও মূল্যে জিততে হবে। কোচের কাজ টিমের মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে আনা। তাতে কে কী বলল, ভাবল কিছু যায়-আসে না।
প্র: টিমে বারবার এত পরিবর্তন? টিমটা তো থিতুই হচ্ছে না?
হাবাস: আমি ম্যাজিক জানি না। পরপর খেলা। ইনজুরি, কার্ড-সমস্যা। সবাইকে সুস্থ রাখতে হচ্ছে। সে জন্য টিম বদলাতে হচ্ছে। কী করব?
প্র: কিন্তু বলিভিয়ার লোক তো বলে আপনি ম্যাজিশিয়ান। ওদের দেশকে কোচিং করিয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনালে তুলেছিলেন। গ্রুপে উরুগুয়ের মতো টিমকে হারিয়ে...!
হাবাস: (হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে) আর একটা কথা বললেন না তো! আমার কোচিংয়ে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে আঠারোয় তুলে এনেছিলাম বলিভিয়াকে। সে এক সোনালি সময় কেটেছে!
প্র: ভ্যালেন্সিয়ার কোচিং টিমে থাকার সময় লা লিগায় দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আপনারা। বলিভিয়া, না ভ্যালেন্সিয়া কোন সাফল্যটাকে সেরা বাছবেন?
হাবাস: দু’টো দু’রকম। দু’টোই সেরা স্মৃতি। তবে একটা কথা বলছি, বলিভিয়ার সঙ্গে ভারতের মিল খুঁজে পাই নানা ভাবে।
প্র: ভারতের জাতীয় কোচের পদ এই মুহূর্তে ফাঁকা। ট্রেভর মর্গ্যান, পিটার রিডের মতো আইএসএলের অনেক টিমের কোচই আবেদন করেছেন ওই চাকরির। আপনি করবেন না কি?
হাবাস: তাই? জানি না তো! ওঁরা করেছেন? কলকাতার সঙ্গে আমার সামনের বছরও চুক্তি আছে। তবে আমি পেশাদার। দেখা যাক।
প্র: সবাই বলছে চেন্নাইয়ান আর কলকাতা ফাইনাল হবে?
হাবাস: লোকে বলছে। আমি বলছি না। আমার কাছে দিল্লি ম্যাচ জেতাই এখন লক্ষ। এক গোল, দু’গোল...ক’গোল হল তা নিয়ে ভাবি না। এক গোলেও তিন পয়েন্ট, দু’গোলেও তাই। আমার স্লোগান আমরা একটা টিম। আমাদের জেতার ক্ষমতা আছে। যে কোনও মূল্যে জিততে হবে।
প্র: আপনার আদর্শ কোচ?
হাবাস: সিমিওনে। ওর আটলেটিকো মাদ্রিদের খেলা আমার দারুণ লাগে।