কিংশুকের গোললাইন সেভ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
আটলেটিকো কলকাতা ১ (বলজিত্)
কেরল ব্লাস্টার্স ১ (হিউম)
কাচ ঘেরা বক্সে বসে থাকা আটলেটিকো দে কলকাতা কোচ আন্তোনিও হাবাসকে দেখে মনে হচ্ছিল খাঁচাবন্দি পাখি।
ছটফট করছেন। বলজিতের গোলের সময় ডান হাতটা তুলে ‘ইয়েস’ বলে চিত্কার করে উঠলেন। আবার কলকাতার গোল হজমের সময় দু’হাত মাথায়! হোফ্রের সহজতম মিসের সময় হতাশায় চাপড়ও মারলেন কপালে। পাশে বসে দলের আরও দুই নির্বাসিত সদস্য। গোলকিপার কোচ প্রদীপকুমার ভক্তাওয়ার আর অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ফিকরু তেফেরা।
পায়ের উপর খুলে রাখা একটা ফাইলের সাদা কাগজে হাবাস লিখে রাখছিলেন বোরহা, অর্ণবদের প্রতিটা মুভ। ভুলভ্রান্তিগুলোও। হাফটাইমে কোচিং টিমের এক সদস্য এলেন চার ম্যাচ সাসপেন্ড হওয়া কোচের কাছে। কাগজে লিখে তাঁকে কিছু বুঝিয়ে দিলেন হাবাস। তিনি মাথা নেড়ে চলে গেলেন নীচে।
এর পরই নাটকের শুরু। আইএসএলের ম্যাচে দুর্নীতি দমন শাখার ক্যামেরা বসানো রয়েছে যুবভারতীর ভিআইপি গেট থেকে ড্রেসিংরুম, এমনকী মাঠের ভিতরেও। টিমবাসে পৌঁছনো থেকে ম্যাচ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ফুটবলারের গতিবিধি যাতে ধরা পড়ে। সেই ক্যামেরাগুলোরই কোনও একটায় নাকি ধরা পড়েছে, আটলেটিকোর এক টিম-সদস্য হাবাসের কাছ থেকে টিপস নিয়ে মাঠে আটলেটিকোর রিজার্ভ বেঞ্চে দিয়ে আসছেন। যা টুর্নামেন্ট রুলের নিয়মবিরুদ্ধ। আর সেটা নিয়েই শুরু হয়ে যায় হইচই।
আটলেটিকো কর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন দলের দুই স্প্যানিশ ফিজিও হুয়ান আর এডুকে দেখতে প্রায় একই রকম। তাঁদের একজন খুয়ান মাঠে বসে রয়েছেন। অন্য জন হাবাসের পাশে বসা। সে জন্যই নাকি এই ভুল! যে ব্যাখ্যা আইএমজি কর্তারা মেনে নেন শেষ পর্যন্ত।
কিন্তু লিগ শীর্ষে থাকা আটলেটিকো টিম কেন এত খারাপ খেলল তাঁর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। নিয়মানুযায়ী নির্বাসিত কোচ হাবাসের কথা বলার উপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে টিম সূত্রে খবর পাওয়া গেল, হাবাস ক্লান্তিকেই দুষছেন। সকাল সাড়ে এগারোটায় টিম হোটেলের ক্লাসে স্ট্র্যাটেজি বোঝানোর পাশাপাশি বলজিত্-বোরহাদের তিনি বলে দেন, “তোমরা সবাই ক্লান্ত জানি। বারবার বিমানযাত্রার মধ্যেই দু’দিন অন্তর ম্যাচ খেলতে হচ্ছে। তিন পয়েন্ট পেলে ভাল। না হলে আমি চাই অন্তত এক পয়েন্ট নিয়ে ফেরো।” মাঠে তাঁর স্ট্র্যাটেজিতেই খেলল কলকাতা। কিন্তু তেতাল্লিশ দিন আগের সিমিওনে হতে পারলেন না হাবাস। মাঠের বাইরে থেকে জেতাতে পারলেন না দলকে।
পুণে সিটির কাছে ০-২ হার মাঠে বসে দেখতে হল এফসি গোয়ার অন্যতম মালিক বিরাট কোহলিকে। অনুষ্কা শর্মাকে নিয়ে। ছবি: ইন্দ্রনীল রায়
তাতে কী? টুর্নামেন্টের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ ম্যাচ খেলার পরেও আক্ষেপ নেই কলকাতার আটলেটিকোর শিবিরে। বরং এর পর আট দিন পর আবার ম্যাচ, এটা ভেবেই স্বস্তিতে হোফ্রে-শুভাশিসরা।
ট্রেভর মর্গ্যানের কেরলও যেন এক পয়েন্টের জন্য খেলতে নেমেছিল যুবভারতীতে। সচিন তেন্ডুলকরের টিম শূন্য হাতে খেলতে এসেছিল শহরে। তাদের ‘এক পয়েন্ট স্ট্র্যাটেজি’ তবুও মানা যায়। তা বলে নিজের মাঠে কলকাতা সেই রাস্তায় হাঁটবে কেন? কেন বলজিত্ বিপক্ষের বিশ্বকাপার কিপার ডেভিড জেমসকে বোকা বানিয়ে গোল করার পরেও গুটিয়ে গেল হাবাসের দল? গার্সিয়া, ফিকরু, ডেঞ্জিলরা না থাকাতেই কি এই হাওয়া বদল? প্রশ্নটা ম্যাচের পর ঘুরপাক খেল স্টেডিয়ামে।
কেরল ব্লাস্টার্স টিমটা কার্যত নিজে তৈরি করেছেন ট্রেভর মর্গ্যান। সবাই ধরে নিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে মর্গ্যান ফুল ফোটাবেন, তিন-চার বছর আগের মতো। কিন্তু গুরবিন্দর, পেন, নির্মল, মেহতাবরা যে এ ভাবে কাঁটাগাছ হয়ে দাঁড়াবেন কে ভেবেছিল! টিমটার বিদেশিদের দশাও একই রকম। কানাডায় আইস হকি জনপ্রিয় সবার জানা। কিন্তু সেখান থেকে কোনও ফুটবলার ভারতে এসে খেলবেন সেটা অজানা ছিল এত দিন। মিলোস্লাভ গঞ্জালেসের ব্যাকহিল পাসে ইয়ান হিউমের বিশ্বমানের গোলটা দেখার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল কেরল স্ট্রাইকার আসলে স্কটিশ। কানাডার নাগরিক। মাঠ জুড়ে দৌড়ে বেড়ানোর তাগিদ আছে হিউমের ফুটবলে। সেই তাগিদের জেরেই বিরতির আগেই ম্যাচটা ১-১ হয়ে গেল।
পরের অর্ধে নিজেদের গোলের সামনে লকগেট ফেলায় মন দিল দু’টো টিমই। ফলে খেলাটা আরও পানসে হয়ে গেল। তার মধ্যেও নোটবুকে লিখে রাখার মতো কয়েকটা ঘটনা ঘটল। বলজিতের জোরাল শট ক্রসবার লেগে ফিরল। হোফ্রে ওয়ান-টু-ওয়ানে কেরল কিপারকে হারাতে পারলেন না। গোললাইন সেভ করলেন কলকাতার কিংশুক। আর দু’দলের ফুটবলারদের মধ্যে তিন-চার বার ধাক্কাধাক্কি হল।
ম্যাচ শেষে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেলফি যিশুর। সঙ্গে পরমব্রত ও পল্লবী। ছবি: টুইটার
মজার ঘটনাও ঘটল। কেরলের কোচ-কাম-গোলকিপার জেমসকে হাত নেড়ে মাঠের বাইরে চলে আসতে বলছিলেন সহকারী মর্গ্যান। বিশ্বকাপার কিপার রাজি হলেন না। সন্দীপ নন্দীকে তাই দীর্ঘক্ষণ অনুশীলন করিয়েও পাঠাতে হল রিজার্ভ বেঞ্চেই।
বিনোদনের পসরা যত আকর্ষণীয়ই হোক, ভাল ফুটবল দেখতেই কিন্তু আইএসএলের দর্শকরা ভিড় জমাচ্ছেন। আইপিএলে যাঁদের দলে দলে মাঠে আসতে দেখা যায় সেই সমর্থকরাই আসছেন ফুটবল মাঠে। উত্সবের মেজাজে। রঙিন হয়ে। উত্তেজনার আগুন পোহাতে। অমিতাভ-হৃতিক-রণবীর-জনদের দেখতে উদ্বোধনের দিন যত দর্শক এসেছিলেন যুবভারতীতে, বিশ্বকাপজয়ী দেল পিয়েরোর খেলা দেখতে এসেছিলেন তার চেয়েও বেশি। এ দিন গ্যালারিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাজির ছিলেন টলিউডের পরমব্রত-যিশুরা। তবে মাঠের ভেতর দু’টো টিমেই সেই অর্থে এমন কোনও মহাতারকা ছিলেন না, যাঁদের টানে মাঠে আসবেন দর্শক। ফলে মাঠে ভিড় অর্ধেক। পঁয়ষট্টি থেকে এক ধাক্কায় চৌত্রিশে।
আগের রাতেই ধুন্ধুমার বার্সা বনাম রিয়াল দেখার পর কেনই বা আসবেন তাঁরা, এমন পানসে ম্যাচ দেখতে?
আটলেটিকো দে কলকাতা: শুভাশিস, বিশ্বজিত্ (পদানি), অর্ণব, মিগুয়েল, কিংশুক, নাতো, হোফ্রে, বোরহা, লোবো (রাকেশ), বলজিত্, আর্নাল (রফি)।