মেসিদের গ্রহে

কোচের মগজাস্ত্র আর টিমগেমে আটলেটিকো এখন ‘গ্রেট ওয়াল’

বর্তমান ফুটবল মানেই আক্রমণের জয় জয়কার। তুমি দুর্দান্ত ডিফেন্ডার হতে পারো। দারুণ গোলকিপার হয়ে দলকে প্রতিদিন বাঁচাতে পারো। কিন্তু দিনের শেষে কারও নজরে সে সব পড়বে না।

Advertisement

সোহম দে

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৫:২৬
Share:

বর্তমান ফুটবল মানেই আক্রমণের জয় জয়কার। তুমি দুর্দান্ত ডিফেন্ডার হতে পারো। দারুণ গোলকিপার হয়ে দলকে প্রতিদিন বাঁচাতে পারো। কিন্তু দিনের শেষে কারও নজরে সে সব পড়বে না।

Advertisement

কারণ ক্লাইম্যাক্সে শিরোনাম ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন তিনিই, যাঁর নামটা গোলস্কোরারের পাশে থাকবে।

গোটা মরসুম তুমি দারুণ খেললে। পনেরোটা অ্যাসিস্ট করলে। একশোটা ক্লিয়ারেন্স। উনিশটা সেভ। কিন্তু ব্যালন ডি’অর তাদের হাতেই উঠবে যাঁরা মরসুমে পঞ্চাশ গোল করবে।

Advertisement

গো লস্কোরারদের নিয়ে যতটা হইচই, ডিফেন্ডারদের নিয়ে ছবিটা পুরো উল্টো। যারা দুর্দান্ত খেললেও শেষমেশ সবাই ভুলত্রুটিটাই বড় করে দেখেন।

বিশ্বফুটবল যখন স্ট্রাইকার-বন্দনায় মগ্ন, ডিফেন্সের মর্যাদা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে আটলেটিকো মাদ্রিদ। দিনের পর দিন। ম্যাচের পর ম্যাচ।

মেসি-রোনাল্ডো ডিফেন্ডারদের রাতে ঘুম কেড়ে নিতে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন সোনার ফরোয়ার্ডদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে আটলেটিকো। মেসি হোক বা রোনাল্ডো, আটলেটিকো দেওয়ালের সামনে পড়লে কেউ কোনও উত্তর খুঁজে পান না। অতৃপ্ত মুখ। নিচু মাথা। যেন ভুলভুলাইয়ার মধ্যে আটকে গিয়েছেন। যেখানে ঢুকে তো যাওয়া যায়, কিন্তু বেরনোর রাস্তা পাওয়া কঠিন। খুবই কঠিন।

রিয়াল মাদ্রিদ একটার পর একটা ড্র করে চলেছে। সেল্টা ভিগোর বিরুদ্ধে বার্সেলোনা চার গোল হজম করেছে। সেখানে আটলেটিকো দুর্গে বোমাবাজি করার সুযোগ পায়নি বিপক্ষ ফরোয়ার্ডরা। লা লিগায় মাত্র দুটো গোল হজম করে শীর্ষে আটলেটিকো। সাত ম্যাচে পাঁচটায় কোনও গোল খায়নি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও বায়ার্নের মতো হেভিওয়েট দলকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।

কিন্তু আটলেটিকো তো আর হঠাৎ করে কোনও স্ফুলিংয়ের মতো উঠে জ্বলে ওঠেনি। বরাবরই স্পেনের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ছিল তারা। যারা রিয়াল-বার্সার দ্বৈরথের আগুনে ঢাকা পড়ে থাকত। তা হলে কী এমন ম্যাজিক হল যে আটলেটিকো রাতারাতি এমন একটা দল হয়ে দাঁড়াল যারা স্পেনের দুই গোলিয়াথকে প্রতি মরসুম চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ট্রফি জিতছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে উঠছে।

ভারতের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করছেন, সেই ম্যাজিকের নাম দিয়েগো সিমিওনে। যাঁর মগজাস্ত্রের সৌজন্যেই ডিফেন্স সংগঠন এত আঁটসাঁট। ‘‘আটলেটিকো ডিফেন্স একটা নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজিতে চলে। ওদের মাঝমাঠও ডিফেন্সে ট্র্যাক ব্যাক করে সাহায্য করে। যার ফলে প্রাইমারি মার্কার কেটে গেলেও সাহায্যে থাকে দু’তিন জন,’’ বললেন মনোরঞ্জন।

নিজেও বড়মাপের ডিফেন্ডার ছিলেন। তাই অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন, ডিফেন্স করা ফুটবলের অন্যতম কঠিন কাজ। কারণ ডিফেন্ডারদের ম্যাচ রিডিং ক্ষমতাটা থাকতে হয়। পজিশনিং ঠিক রাখতে হয়। কোথায় বিপদ হতে পারে সেটা আগেভাগেই অনুমান করতে হয়। আটলেটিকো ডিফেন্ডারদের মধ্যে সেই সবই আছে। মনোরঞ্জন যোগ করেন, ‘‘গদিন, গিমেনেজ বা সাভিচও। এরা সবাই কিন্তু নির্দিষ্ট কম্বিনেশনে খেলে। সিমিওনের দল সাজানোর মধ্যেই সেই সব পরিষ্কার। ও আমন্ত্রণ জানায় বিপক্ষকে। কিন্তু শট নেওয়ার কোনও জায়গা দেয় না।’’

পরিসংখ্যান মিথ্যা বলে না। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখা যাবে গত তিন বছরে ম্যাচ পিছু গোলের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমেছে। ক্লিনশিটের সংখ্যা বেড়েছে। গত মরসুমে মে মাসের শুরু পর্যন্ত মোট ৪৭ ম্যাচে ৩১টায় গোল খায়নি। ভাবা যায়। যেখানে গড়ে প্রতি মরসুমে রোনাল্ডো-সুয়ারেজদের গোলসংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেখানে বুফন, দি জিয়ার মতো গোলকিপাররাও ক্লিনশিটের জন্য হা-হুতাশ করছেন, সেখানে আটলেটিকোর রক্ষণ প্রতি বছরই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সুতোও গলতে দিচ্ছে না।

খেলোয়াড় জীবনে নিজেও খুব কড়া ট্যাকলার ছিলেন সিমিওনে। আটলেটিকোর দায়িত্ব নিয়েও নিজের সেই লৌহ মানসিকতায় আটলেটিকো-কে মুড়ে দিয়েছেন ‘চোলো’। সিমিওনে বুঝেছেন তাঁর দলে কোনও মেসি বা রোনাল্ডো নেই। তাই টিমগেমের উপর জোর দিয়েছেন। দলের ভিত তৈরি করেছেন ডিফেন্সের উপর। গদিন বা গিমেনেজ সেই বিখ্যাত সেন্টার ব্যাকদের মতো নয়। কিন্তু সিমিওনে এই সমস্ত অনামী ফুটবলারদের মধ্যেই প্রতিযোগিতার মশলা ভরে দিয়েছেন। যাঁর ফর্মেশনে ফুলব্যাক থেকে ফরোয়ার্ড লাইন— সবাই ক্রমাগত উপর-নীচ করবে।

প্রাক্তন আই লিগ জয়ী কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য সেটাই মনে করছেন। ‘‘আটলেটিকোর টিমগেমই সব কিছুর পিছনে। গ্রিজম্যানের মতো আক্রমণাত্মক ফুটবলারও বারবার নীচে নামে। ফুলব্যাকরা কোণাকুনি কভার করে। পুরোটাই একটা প্ল্যানের উপর,’’ বললেন সুব্রত।

ডিফেন্সের দৌলতেই তো আটলেটিকো এখন সাহস পাচ্ছে বাকি ক্লাবগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর। দিয়েগো কোস্তা বা গ্রিজম্যানের মতো স্ট্রাইকার পেয়েছে আটলেটিকো। কিন্তু সিমিওনের মতো কোচই সবচেয়ে বড় পাওনা। যাঁর হাত ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়া প্রতিটা ট্রফিই এসেছে ক্লাবে। ভাগ্য সহায় থাকলে ক্লাব ছাড়ার আগে সিমিওনে সেটাও দিয়ে যাবেন ক্লাবকে।

রিয়াল-বার্সার মতো মহাতারকা নেই। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের মতো আর্থিক অবস্থা নেই। কিন্তু একটা ডিফেন্স আছে। যাদের অনায়াসে বলাই যায়— দ্য গ্রেট ওয়াল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন