ম্যাচ শেষে বন্ধু। রবিবার। ছবি: উত্পল সরকার
এ রকম স্তব্ধতার গান কখনও শোনেনি যুবভারতী!
দিল্লির পাভেল ইলিয়াসের অনেকটা বাঁক খাওয়া আন্তর্জাতিক মানের গোলটার পর যা বাজল। ১-১ হওয়ার ধাক্কা নিরন্তর বয়ে চলা মেক্সিকান ওয়েভের গ্যালারিকে শান্ত করে দিল মুহূর্তে। আইএসএলে মসৃণ ভাবে দৌড়নো আটলেটিকো দে কলকাতার থমকে যাওয়া দেখে সব কিছু যেন মূক। নিস্তব্ধ।
মোহন-ইস্টের সৌজন্যে এত দিন গোলের পর এক দিকে আলো আর অন্য দিকে অন্ধকার নেমে আসাই ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহদাকার স্টেডিয়ামের বৈশিষ্ট্য। একটাই দলের জন্য গণ-আকুতি কখনও দেখেনি বহু ঘটনার সাক্ষী যুবভারতী।
বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ফুটবলারকে নব্বই মিনিট এ রকম শো-পিস হয়ে থাকাও কি কখনও দেখেছে যুবভারতী?
দেল পিয়েরোকে রবিবার যেমন দেখলেন হাজার ষাটেক দর্শক।
ম্যাচ শুরুর সাত মিনিটে হলুদ কার্ড দেখেন। ইনজুরি টাইমে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বকাপজয়ী তখন ক্লান্ত। অবসন্ন। একটা হাততালিও বরাদ্দ হল না তাঁর জন্য।
অথচ ইতালিয়ান মায়াস্ত্রো-র ম্যাজিক দেখার জন্যই তো এসেছিলেন হাজার হাজার দর্শক।
এ দিন অমিতাভ বচ্চন আর নেই মাঠে। উদ্বোধনী ম্যাচের মতো সচিন-হৃতিক-অভিষেক-রণবীর চমকও নেই। নেই প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার নাচও। তবুও এত দর্শক হাজির! শনিবার বিকেলে আটলেটিকোর এক বড় কর্তা আক্ষেপ করছিলেন, “আমাদের শহরের লোকেরা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ছাড়া এখনও কিছু বোঝে না। টিকিট বিক্রি ভাল নয়।” সেই তিনিই ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে চওড়া হাসি নিয়ে হাজির, “প্রচুর দর্শক আসছে। উদ্বোধনের মতোই লোক ঢুকছে মাঠে।”
রবিবাসরীয় যুবভারতী। বাঁ দিকে ফিকরুর কাছে আটকে যাওয়া দেল পিয়েরো। ছবি: উত্পল সরকার
বদলে যাওয়া ফুটবল-সংস্কৃতির হাত ধরে নামী মডেলের গাড়ি চড়ে মাঠে আসা নব্য ফুটবলপ্রেমীরা সেই অর্থে কিছুই কিন্তু পেলেন না এ দিন। একটা আন্তর্জাতিক মানের গোল দেখা ছাড়া। তা-ও সেটা আবার তাঁদের প্রিয় কলকাতা টিমকেই হজম করতে হল।
অথচ তাঁরা দেখতে এসেছিলেন দু’টো জিনিস। কলকাতার জয়ের হ্যাটট্রিক আর দেল পিয়েরো-ম্যাজিক। কিন্তু কোথায় কী? এক সময় যে কিংবদন্তি ইতালিয়ান ফরোয়ার্ডের খেলা দেখে মুগ্ধ হত মানুষ, গ্যালারিতে উঠত ঝংকার, যাঁর টানে দু’বছর আগেও ভর্তি হয়ে যেত জুভেন্তাসের গ্যালারি, একের পর এক গান লেখা হত যাঁকে নিয়ে, এ দিন সেই দেল পিয়েরোর পা থেকে গোটা ম্যাচে বেরোল শুধু একটাই দুর্দান্ত পাস। আর শুরুতে এক বার তিন জনকে ড্রিবল করে কলকাতার বক্সে ঢুকে পড়া।
নব্বই মিনিটে আর কী দেখা গেল প্রাক্তন ফুটবল-নক্ষত্রের পা থেকে? দু’টো ভুল পাস। একটা বিশ্রী ফ্রিকিক। একবার বল রিসিভ করতে গিয়েও পারলেন না। শেষের দিকে এক বার মারামারিতেও জড়িয়ে পড়লেন! রেফারির বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুনও উগরে দিলেন ম্যাচ শেষে। যা তিনি কখনও করেছেন কি না সন্দেহ!
জীবনে সম্ভবত প্রথম বার তাঁর টিমের কোচকে সাংবাদিক সম্মেলনে শুনতে হল, “দেল পিয়েরো পারছিলেন না, তা-ও মাঠে রেখে দিলেন?” আমতা আমতা করলেন দিল্লি কোচ ভেল্দোভেন। “ওর নাম আর খেলার ওজনটা ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।”
মারাদোনা যুবভারতীতে এসেও খেলেননি। জিকোও না। তবে মেসি, অলিভার কানরা খেলেছেন। তাঁদের খেলা শেষে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দিয়েছেন শহরের ফুটবলপ্রেমীরা। সেই মহার্ঘ উচ্ছ্বাস ছুঁয়েই দেখা হল না তাঁর। ফুটবল-সূর্য হয়েও দূরেই রয়ে গেলেন দেল পিয়েরো। ছুঁতে পারলেন না কলকাতার হৃদয়। রবিবাসরীয় যুবভারতী বুঝিয়ে দিল, ফুটবল সিভি আপনার যতই ভাল হোক না কেন, মাঠে পারফর্ম না করতে পারলে দর্শকদের মনে জায়গা পাওয়া যাবে না। আইএসএল সম্ভবত এও বুঝিয়ে দিচ্ছে, শুধু তারকা দেখার জন্য দর্শক মাঠে আসছে না। আসছে, ভাল ফুটবল দেখার জন্য।
নয় বছর পর মুখোমুখি হয়েও লুই গার্সিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধও নেওয়া হল না বর্তমান দিল্লি ডায়নামোস অধিনায়কের। অথচ খেলা শুরুর আগে ওয়ার্ম আপ সেরে ড্রেসিংরুমে ঢোকার মুখে দেখা গেল প্রাক্তন জুভেন্তাস মহাতারকা জড়িয়ে ধরেছেন স্পেনের বিশ্বকাপার গার্সিয়াকে। দু’একটা কথা হল। হাসি বিনিময়ও।
কিন্তু ইতালির সর্বকালের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতাকে দেখে মুখটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল কলকাতার আটলেটিকোয় গার্সিয়ার সতীর্থ হোসে রে-র। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জুভেন্তাসের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচটায় লিভারপুল রিজার্ভ বেঞ্চেও কোচ তাঁকে জায়গা দেননি। কিন্তু এ দিন কলকাতা কোচ আন্তোনিও হাবাস টিম মিটিংয়ে হোসে রে-র উপরই দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেল পিয়েরোকে আটকানোর। কিন্তু মেগাতারকার হাল এতটাই খারাপ ছিল যে, কলকাতার স্টপারকে তেমন ঝক্কি পোয়াতে হয়নি।
দু’দলের ঝামেলা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
কিন্তু লাল কার্ডের ঝক্কি তো তাড়া করে ফিরছে কলকাতার কোচকে। গুয়াহাটিতে বোরহা ফার্নান্দেজকে হারিয়েছিলেন। সেখানে লাল কার্ড দেখেছিলেন বিদেশি মিডিও। এ দিন বোরহা না থাকায় কলকাতার মাঝমাঠ আগের মতো কার্যকর হল না। বোরহার জায়গায় পদানি নেমে সুপারফ্লপ। বোরহার সঙ্গে সেই জুটি ভেঙে যাওয়ায় নাটোকেও দিশাহারা মনে হল। পদানি-নাটোর যুগলবন্দি অনুরণন তুলতে পারল না। আর চোট পাওয়া গার্সিয়ার জায়গায় নেমে রাকেশ মাসি পুরো ডোবালেন। মহমেডান টিমেও যাঁর জায়গা হয়নি, তিনি আর কী-ই বা করতে পারেন? দেল পিয়েরোকে ফাউল করে ম্যাচে দ্বিতীয় হলুদ কার্ডের জেরে লাল কার্ড দেখলেন। হাবাস সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বিরক্তি প্রকাশও করলেন মাসির অযথা লাল কার্ড দেখা নিয়ে।
একই রকম বিরক্ত আটলেটিকো কলকাতার কর্তারা। ম্যাচ সংগঠন করতে গিয়ে তাঁরা পদে-পদে সমস্যায় পড়ছেন। এ দিন ম্যাচের আগে হঠাত্-ই স্টেডিয়ামের লোকজন কাজ বন্ধ করে দেন পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভে। তাঁদের অভিযোগ, স্টেডিয়ামের এক কর্মী গ্যালারির একটি অংশে কাজ করতে গিয়ে পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়েছেন। মিনিট পনেরো ঝামেলা চলে। পরে আলোচনায় সমস্যা মেটে।
গোল হলেই মাঠের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আকাশে উড়ে যাচ্ছে হাউই। দল নামার সময় বাজছে ঢাক। চারিদিকে উত্সবের মেজাজের আবহাওয়া। দলে-দলে আটলেটিকো দে কলকাতার লাল-সাদা জার্সি পরে মাঠে আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। এক দল-এক টিমের জন্য। যা কখনও দেখেনি যুবভারতী।
কিন্তু আলোর নীচে অন্ধকারও থাকছে! উদ্বোধনের দিন জলে ভেসেছিল ড্রেসিংরুম। এ দিন আবার রাজ্য সরকারের দুই পৃথক দফতরের মধ্যে গণ্ডগোল। যা ভেস্তে দিতেই পারত ম্যাচ।
আইএসএলের হাত ধরে ভারতীয় ফুটবলের সংস্কৃতি হয়তো বদলাবে। কিন্তু কলকাতার কর্ম-সংস্কৃতি কবে যে বদলাবে!