হে শ্রীনি, আপনিই নির্বাচনে দাঁড়ান আজ চেন্নাইয়ে বলার জন্য তৈরি বোর্ড সদস্যরা

ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট বোর্ড প্রধানের মতো কারও কারও মনে হচ্ছে, রোম যখন জ্বলছে, তখন সম্রাট নিরোর বেহালা বাজানোর মতোই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন তিনি। এত সব কেলেঙ্কারির আগুনে বোর্ডের ভাবমূর্তি নিয়ত ঝলসাচ্ছে দেখেও নিজের নিষ্ঠুর উচ্চাশা থেকে সরছেন না! ভারতের সেই প্রাক্তন অধিনায়কের মতো কারও কারও আবার মনে হচ্ছে আজ মুদগল কমিটির রিপোর্টের কপিতে নিজের সংশ্লিষ্ট অংশটা ফাঁস হওয়ার পর তিনি পৌঁছে গেলেন অপরাজিত ৯৫ রানে। মঙ্গলবার মাত্র ৫ রান যোগ হলেই সেঞ্চুরি। আবার উঠে পড়বেন ভারতীয় ক্রিকেটের মগডালে।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share:

স্বস্তির দিনে। কান্নুরে রাজা রাজেশ্বর মন্দিরে শ্রীনিবাসন। ছবি: পিটিআই

ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট বোর্ড প্রধানের মতো কারও কারও মনে হচ্ছে, রোম যখন জ্বলছে, তখন সম্রাট নিরোর বেহালা বাজানোর মতোই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন তিনি। এত সব কেলেঙ্কারির আগুনে বোর্ডের ভাবমূর্তি নিয়ত ঝলসাচ্ছে দেখেও নিজের নিষ্ঠুর উচ্চাশা থেকে সরছেন না!

Advertisement

ভারতের সেই প্রাক্তন অধিনায়কের মতো কারও কারও আবার মনে হচ্ছে আজ মুদগল কমিটির রিপোর্টের কপিতে নিজের সংশ্লিষ্ট অংশটা ফাঁস হওয়ার পর তিনি পৌঁছে গেলেন অপরাজিত ৯৫ রানে। মঙ্গলবার মাত্র ৫ রান যোগ হলেই সেঞ্চুরি। আবার উঠে পড়বেন ভারতীয় ক্রিকেটের মগডালে।

নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন ক্রমাগত এমনই প্রহেলিকা হয়ে উঠছেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই তাঁকে ঘিরে আশ্চর্য মেরুকরণ। যা নতুন সপ্তাহে আরও কুয়াশার মধ্যে পড়ল। শ্রীনি কি তাঁর প্রচারযন্ত্রের দাবি অনুযায়ী সত্যি এ দিন মুক্ত হলেন যাবতীয় অভিযোগ থেকে? নাকি তাঁর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেপে যাওয়ার যে অভিযোগ রিপোর্টে রয়েছে, তার জন্য তিনি কঠোর শাস্তির মধ্যে পড়বেন?

Advertisement

দুপুর থেকেই বিভিন্ন চ্যানেল দেখাতে শুরু করে শ্রীনি ম্যাচ ফিক্সিং ও বেটিংয়ের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন তাঁর অনুগামী ক্রিকেট কর্তারা। বলতে থাকেন, আর কী! এ বার তো আগের কথা মতো ২০ তারিখ নির্বাচনী সভা ডেকে ওঁকে বোর্ড প্রেসিডেন্ট বসিয়ে দিলেই হয়। কেউ কেউ আবার বলা শুরু করেন, থাক, এক মাস বাদেই নির্বাচনটা হোক না। উনিই তো হবেন। কিন্তু এখন যেখানে সুপ্রিম কোর্ট পরের শুনানি ২৪ নভেম্বর ডেকেছে, এখন তাড়াহুড়ো করলে আদালত অন্য ভাবে নিতে পারে। চান্স নিয়ে কী লাভ, আজকের পর তো জেতা হয়েই গেল।

শোনা যাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বোর্ড সদস্য এমন মনোভাব নিয়েই মঙ্গলবার ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠকে যাচ্ছেন। তাঁরা সমবেত ভাবে সেখানে বলবেন, আপনিই আবার প্রেসিডেন্ট হোন, হে শ্রীনি। এমনকী সিএবি, যারা বিপক্ষে এত দিন দাঁড়িয়ে ছিল। শ্রীনিকে কিছুতেই পাকা কথা দিচ্ছিল না। তারাও নাকি চেন্নাইয়ে তাঁর হয়ে হাত তুলবে বলেই ঠিক করেছে। বিনিময়ে? বিনিময়ে শ্রীনির দয়াপরবশ হয়ে, সরি শ্রদ্ধাপরবশ হয়ে ডালমিয়াকে পেট্রন ইন চিফ পদে সম্মানিত করতে পারেন সংবিধান বদলে।

চেন্নাই বৈঠকের চব্বিশ ঘন্টা আগে শ্রীনির প্রচার মেশিনারি সুচতুর ভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে তিনি নির্দোষ খবর ছড়িয়ে দেওয়ায়, বিরোধী শিবির আশ্চর্য হয়ে যায়। তারা এই আচমকা প্রতি আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না। ধাতস্থ হয়ে তারা পাল্টা মিডিয়ায় বলতে থাকে, শ্রীনি গড়াপেটা অভিযোগ থেকে ছাড়া পেলেন, এটা তো সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক তথ্য। তাঁর বিরুদ্ধে তো ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠেনি। তা হলে ছাড়া পাওয়ার কথা উঠছে কোথা থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, গড়াপেটা সংক্রান্ত তথ্য লুকিয়ে রাখার আর তা তো সর্বোতভাবে প্রমাণিত।

প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট আইএস বিন্দ্রা এই সময়ে টুইট করা শুরু করেন, শ্রীনি আইসিসি-র আচরণবিধি ভেঙেছে। আইসিসি-র এথিক্স অফিসারের উচিত এখুনি ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

আইপিএল মুখ্যকর্তা সুন্দর রামনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালো রিপোর্ট রয়েছে মুদগল কমিটির। বলা হয়েছে, রাজ কুন্দ্রা ও মইয়াপ্পন যে বেটিং করেছেন নিজের নিজের টিমের উপর, সেই তথ্য আইপিএল প্রধানকে জানিয়েছিলেন গড়াপেটা দমন শাখার অফিসার। কিন্তু সুন্দর রামন তা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, কাউকে সরকারি ভাবে জানানওনি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর আইপিএল এক মরসুমে মোট আট বার তিনি স্বীকৃত বুকিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কমিটির সামনে অবশ্য তিনি সাফাই গেয়েছেন, লোকটি যে বুকি তা নাকি জানতেন না।

শ্রীনির বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই সুন্দরকে তিনি শুধু পদেই বসাননি, এঁদের দ্বারা গড়াপেটার অনুপ্রবেশ ঘটছে দেখেও স্রেফ চেপে গিয়েছেন। একটি প্লেয়ার আইসিসি-র আচরণবিধি ভেঙেছে জেনেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। মানে কভার-আপ অপারেশনে তিনি ভীষণ ভাবে জড়িত। নিজে যতই সরাসরি বেটিংয়ে যুক্ত না হোন, কঙ্কালগুলো চেপে রেখেছেন তিনি।

আর একটা অভিযোগ, কমিটির সামনে মিথ্যে বলেছেন। বলেছিলেন গুরুনাথ নিছক ক্রিকেট উত্‌সাহী। সিএসকে-র সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু মুদগল কমিটি টিম অফিশিয়াল হিসেবে গুরুনাথকেই খঁুজে পেয়েছে। আর তাঁর ভয়েস স্যাম্পল টেস্ট করে ফোনে বুকির সঙ্গে ক্রমাগত কথা বলার লোকটির নমুনা মিলিয়ে দেখেছে, দুটো স্যাম্পলই মিলে যাচ্ছে।

সদস্যরা কড়া ব্যবস্থার সুপারিশ করবেন না সুন্দর রামনের বিরুদ্ধে? রাজস্থান রয়্যালসের সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী এক বছর সাসপেন্ড হয়েছিলেন বুকি তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল, এই তথ্য লুকিয়ে রাখায়। সুন্দরের কেন তা হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে না? আর সুন্দরকে শাস্তি দেওয়া মানেই তো বকলমে শ্রীনি!

বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, যাঁর বিরুদ্ধে এত সব অভিযোগ, তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল এমন মিথ্যে প্রচার কেন? কেন বোর্ড সদস্যরা মঙ্গলবারের বৈঠকে সত্যি কথাটা জানবেন না যে, আদালতের সামনে শ্রীনি মোটেও বিপদমুক্ত নন।

এই পরিস্থিতিতে অবশ্য মনে হচ্ছে না কারও সেটা শোনার মানসিকতা আছে বলে। শ্রীনি গোষ্ঠীর খুব প্রিয়পাত্র ক্রিকেটার এ দিন ভিনরাজ্য থেকে ফোনে বললেন, “উনি নিউ বল খেলছিলেন বলে একটু চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন তো টি পরবর্তী সেশন খেলছেন। আর যদি রান না-ও করেন তা হলেও বোর্ড দেখাচ্ছে ৯৫।”

সদস্যরাও এই পর্যন্ত তেমনই ডগমগ। এখনও তিনি আদালতের খাঁড়ামুক্ত নন। ক্রিকেটদুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে নাম। এইসব প্রশ্ন তুলে কাল বিকেল সাড়ে চারটে থেকে শুরু হওয়া বৈঠকে সদস্যরা শ্রীনিকে আটকে দিতে চাইবেন না তো? রাতে এক বোর্ড সদস্য বললেন, “একজন বলতেই পারে। কিন্তু আজকের পর সমর্থনের জন্য দ্বিতীয় লোকটাও পাবে না।” সত্যি কি তাই হবে? পরিস্থিতি তাই দেখাচ্ছে যদি না আগামী কয়েকটা শুনানিতে আদালত পরিষ্কার কোনও নির্দেশ দেয়!

তিনি যাতে তামিলনাড়ু জুনিয়রে সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁর সেই অন্যতম প্রিয় খেলা টেনিসের ভাষায় অ্যাডভান্টেজ শ্রীনিবাসন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন