দুরন্ত: ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে কোহালির ভারত। শনিবার। এপি
কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৮২-র সেই বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ। সে বার প্রতিপক্ষ যদিও ভারত ছিল না, অ্যাসেজের ম্যাচ চলছিল। জেতার জন্য ২৯২ রান তাড়া করে শেষ উইকেটে অ্যালান বর্ডার এবং জেফ থমসনের জুটি ৭০ রান যোগ করে ফেলেছিল। বর্ডার ব্যাট করতে এলেই ইংল্যান্ডের অধিনায়ক বব উইলিস ফিল্ডিং ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন বাউন্ডারি লাইনে। বর্ডার ধৈর্য ধরে খেলে যাচ্ছিলেন এবং শেষ বলে রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন। স্কোরার পরে জানিয়েছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেটের জুটি ২৯টি খুচরো রান ত্যাগ করেছিল। প্রায় অসম্ভব দেখানো জয়কে সে দিন ১০ রানের গণ্ডির মধ্যে এনে ফেলেছিলেন বর্ডার-থমসন। শেষ পর্যন্ত স্লিপে খোঁচা দিয়ে বাঁচতে বাঁচতেও আউট হয়ে যান থমসন এবং এক অবিশ্বাস্য, রুদ্ধশ্বাস জয়ের সামনে এসেও তরী ডোবে অস্ট্রেলিয়ার। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন থমসন যে, দীর্ঘকাল সেই অভিশপ্ত বক্সিং ডে টেস্ট নিয়ে কথা বলতে পারেননি।
সে দিনের মতো অকল্পনীয় কিছু ঘটানোর কাছাকাছি এখনও আসেননি প্যাট কামিন্স। কিন্তু মেলবোর্নে প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা পরিবেশে ভারতীয় পেস ও স্পিন আক্রমণের সামনে যে ভাবে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি টেস্টকে পঞ্চম দিনে টেনে নিয়ে গেলেন, তা টেলএন্ডারদের সর্বকালের সেরা বীরত্ব প্রদর্শনীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি, ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালিকেও দেখা গেল কামিন্স হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করার পরে স্লিপে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। আট উইকেট পড়ে যাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী আম্পায়ারেরা অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত সময় আধ ঘণ্টা বাড়াতে পারেন। যদি তার মধ্যে খেলা শেষ হয়ে যায়, তা হলে আর পঞ্চম দিনে আসার ঝক্কি রইল না। কিন্তু নেথান লায়নকে নিয়ে কামিন্স সেই বাড়তি আধ ঘণ্টাও খেলে দিলেন। তার মধ্যে আবার কোহালি দ্বিতীয় নতুন বলও নিয়ে ফেলেছিলেন। দেখা গেল মাঠ ছেড়ে বেরনোর সময় ফের হাততালি দিচ্ছেন কোহালি। যতই মাঠে উত্তপ্ত কথাবার্তা চলুক, বীরত্বের কদর করতে জানেন বীর অধিনায়ক।
ঋষভ পন্থ অবশ্য ওই প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা পরিবেশে যশপ্রীত বুমরার হাতে নতুন বল থাকা অবস্থায় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে, তাঁরা এ দিনই আউট হয়ে গেলে ভাল করবেন। পন্থ ব্যাট করার সময় উইকেটের পিছন থেকে সারাক্ষণ তাঁকে উত্যক্ত করে গিয়েছেন টিম পেন। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক এ দিন ব্যাট করতে আসার সময়ে ‘রিটার্ন গিফ্ট’ দিলেন তিনি। শর্ট লেগে তখন ফিল্ডিং করছেন মায়াঙ্ক আগরওয়াল। তাঁর দিকে তাকিয়ে পন্থ বলতে থাকেন, ‘‘আমাদের এক জন নতুন অতিথি এসেছে রে। অস্থায়ী অধিনায়ক বলে কখনও কিছু শুনেছিস তুই?’’ বল করছিলেন রবীন্দ্র জাডেজা। একটা বল হতেই ফের পন্থের তির, ‘‘একে আউট করার জন্য কিস্যু করতে হবে না। শুধু বলটা করে যাও জাড্ডু।’’ এক বল পরে আবার, ‘‘ও আর কিছুই করতে পারে না। শুধু বকবক করে। হি ক্যান ওনলি টক।’’ এক বার আম্পায়ার এসে কথা বললেন পন্থের সঙ্গে। সেখানে কোহালিও এলেন। কিন্তু ভারতীয় উইকেটকিপারের স্লেজিং থামেনি। তাঁরা ব্যাট করার সময় লায়ন অনেক কথা বলেছিলেন। পার্থে পন্থ এবং হনুমা বিহারীকে ছুটি কাটাতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ দিন পন্থ পাল্টা শুনিয়ে দিলেন, ‘‘কাল আর শুধু শুধু আসতে চাই না আমরা। আজই সেরে ফেলো তো।’’
আরও পড়ুন: ঘূর্ণির দেশ থেকে গতির তোপধ্বনি
কামিন্সের ধৈর্য আর প্রত্যয়ে অবশ্য ফাটল ধরাতে পারেনি কোনও স্লেজিং। মেলবোর্নে দ্বিতীয় ইনিংসে তিনিই একমাত্র অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান, যিনি একশোর উপরে বল খেলেছেন। গোটা সিরিজে এখনও পর্যন্ত মোট ৩৯০ বল খেলে ফেলেছেন, যা তাঁর দলের প্রধান ব্যাটসম্যানদের লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। ১০৩ বলে করা ৬১ নট আউট দলের মধ্যে সেরা। মাইকেল ভন অসাধারণ একটা টুইট করেছেন। যা অস্ট্রেলীয় ব্যাটিংয়ের বর্তমান অবস্থাকে দারুণ ভাবে তুলে ধরছে। ‘‘আট নম্বর ব্যাটসম্যান যদি টেকনিক্যাল দিক থেকে সেরা হয়, তা হলে বুঝতে হবে সেই দলে গুরুতর কোনও সমস্যা আছে।’’
স্কোরকার্ড
ভারত ৪৪৩-৭ ডি. ও ১০৬-৮ ডি.
অস্ট্রেলিয়া ১৫১ ও ২৫৮-৮
ভারত (আগের দিন ৫৪-৫ এর পরে দ্বিতীয় ইনিংস)
মায়াঙ্ক আগরওয়াল বো কামিন্স ৪২
ঋষভ পন্থ ক পেন বো হেজলউড ৩৩
রবীন্দ্র জাডেজা ক খোয়াজা বো কামিন্স ৫
মহম্মদ শামি ন. আ. ০
অতিরিক্ত ৭
মোট ১০৬-৮ ডি.
পতন: ১-২৮ (হনুমা, ১২.৬), ২-২৮ (পূজারা, ১৪.২), ৩-২৮ (কোহালি, ১৪.৬), ৪-৩২ (রাহানে, ১৬.১), ৫-৪৪ (রোহিত, ২২.৫), ৬-৮৩ (মায়াঙ্ক, ৩২.৬), ৭-১০০ (জাডেজা, ৩৬.৩), ৮-১০৬ (ঋষভ, ৩৭.৩)।
বোলিং: মিচেল স্টার্ক ৩-১-১১-০, জশ হেজলউড ১০.৩-৩-২২-২, নেথান লায়ন ১৩-১-৪০-০, প্যাট কামিন্স ১১-৩-২৭-৬।
অস্ট্রেলিয়া (দ্বিতীয় ইনিংস)
হ্যারিস ক মায়াঙ্ক বো জাডেজা ১৩
ফিঞ্চ ক কোহালি বো বুমরা ৩
খোয়াজা এলবিডব্লিউ বো শামি ৩৩
শন মার্শ এলবিডব্লিউ বো বুমরা ৪৪
ট্রাভিস হেড বো ইশান্ত ৩৪
মিচেল মার্শ ক কোহালি বো জাডেজা ১০
টিম পেন ক ঋষভ বো জাডেজা ২৬
প্যাট কামিন্স ব্যাটিং ৬১
মিচেল স্টার্ক বো শামি ১৮
নেথান লায়ন ব্যাটিং ৬
অতিরিক্ত ১০
মোট ২৫৮-৮
পতন: ১-৬ (ফিঞ্চ, ১.২), ২-৩৩ (হ্যারিস, ৯.২), ৩-৬৩ (খোয়াজা, ২০.৬), ৪-১১৪ (শন মার্শ, ৩২.২), ৫-১৩৫ (মিচেল, ৩৯.১), ৬-১৫৭ (হেড, ৫০.৩), ৭-১৭৮ (পেন, ৬১.৩), ৮-২১৫ (স্টার্ক, ৭০.৫)।
বোলিং: ইশান্ত শর্মা ১২-০-৩৭-১, যশপ্রীত বুমরা ১৭-১-৫৩-২, রবীন্দ্র জাডেজা ৩২-৬-৮২-৩, মহম্মদ শামি ২১-২-৭১-২, হনুমা বিহারী ৩-১-৭-০।
এত কিছুর পরেও বর্ডার ও থমসনের সেই রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের মতো জয়ের কাছাকাছি চলে আসতে পারে অস্ট্রেলিয়া, কেউ অত দূর ভাবছে না। জিততে গেলে এখনও কামিন্সদের ১৪১ রান করতে হবে। কোহালিদের চাই দু’টো উইকেট। রবিবার সকালে তরতাজা অবস্থায় ফিরে, নতুন বল হাতে বুমরাদের বাকি কাজ সারতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। যদি কোনও কারণে সেটা আটকে যায়, ইডেনের সেই ঐতিহাসিক টেস্টকেও তা হলে ছাপিয়ে যাবে মেলবোর্ন। অস্ট্রেলীয় ভক্তরা অবশ্য সারা দিনের মেঘলা আকাশ দেখে আশায় রয়েছেন যে, রবিবার যদি বৃষ্টি ভেস্তে দেয় ভারতের জয়। তখন কামিন্সের এই ইনিংস সেরা লোকগাথায় পরিণত হবে। অ্যাশেজের সেই রুদ্ধশ্বাস টেস্টে শেষ দিনে বর্ডার এবং থমসনের জুটির জেতার জন্য দরকার ছিল ৩৭ রান। তাতেও সকাল-সকাল মাঠে হাজির হয়ে গিয়েছিল কুড়ি হাজার দর্শক। এখানে দরকার ১৪১। তবু রবিবার কী রকম ভিড় হয়, দেখার। প্রথম দু’তিন দিন ধরে অস্ট্রেলীয় সমর্থকদের নানা কটূক্তি সহ্য করার পরে এ দিন ভারতীয় দর্শকেরা তাঁদের ক্রিকেট দলের মতোই ফর্মে ছিলেন। সারাক্ষণ ধরে গেয়ে গেলেন ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’। তাঁদের সঙ্গে এমনকি, কিছু অস্ট্রেলীয় সমর্থককেও গলা মেলাতে শোনা গেল। তাঁরা গাইতে থাকলে, ‘‘জিতেগা ভাই জিতেগা।’’ ব্যান্ড, তেরঙ্গা আর শঙ্খধ্বনি নিয়ে হাজির ছিল ‘ভারত আর্মি’। তারা আবার গান ধরল, ‘‘টু ওয়ান, টু ওয়ান।’’
আরও পড়ুন: প্রতি টেস্টে ২০ উইকেট নিতে পারে ভারত: দ্রাবিড়
সারমর্ম হচ্ছে, ২-১ হচ্ছে মেলবোর্নে। তার পর চলো, দেখা হবে সিডনিতে। এখানে জিতলে ইতিহাসের হাতছানি কোহালির দলের সামনে। স্বাধীনতার সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া সফর করছে ভারত। আজ পর্যন্ত কোনও অধিনায়ক এ দেশ থেকে টেস্ট সিরিজ জিতে ফিরতে পারেননি। কামিন্স যতই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করুন, যতই বর্ডার-মাইকেল হাসিরা মনে করুন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট নতুন এক অলরাউন্ডারকে আবিষ্কার করেছে, বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির উপরে একটা হাত মনে হচ্ছে রেখেই ফেলেছেন কোহালি। ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা— মাথায় রেখেও লিখে ফেলা যায়, মেলবোর্নে মেঘলা আকাশের মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে জয়ের উজ্জ্বল সূর্য।