পরাভূত ও পরাক্রম। ছবি: উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস।
মেরেকেটে ম্যাচ শেষে তাঁকে দেখা গেল পাঁচ মিনিট।
নিয়মমাফিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে করমর্দনের জন্য এক বার। পরেরটাও নিয়ম মেনে, পুরস্কার বিতরণীতে সামান্য কিছুক্ষণ। দৃষ্টিসুখের ব্যাপার দুটো মিলিয়ে মোটে একটা। সচিন রমেশ তেন্ডুলকর তখন হরভজন সিংহের কাঁধে হাত রেখে আপনমনে কী সব বলে চলেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের এসআরটি-কে রীতিমতো ডাকাডাকি করে এক বার হাতটা এগিয়ে দেওয়া আর জবাবে ক্রিকেট-ঈশ্বরের হালকা পিঠ চাপড়ানি।
ব্যস, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে আর দেখা গেল না।
দেখা দেবেনই বা কাকে? কোন যুক্তিতে? শহরে জামাইষষ্ঠীর উৎসবের দিনে কোনও জামাইকে তাঁর মতো পর্যদুস্ত হতে হয়েছে বলে মনে হয় না। ক্যাপ্টেন কুল বলে ক্রিকেটবিশ্ব এত দিন তাঁকে জানত। জানত, লোকটার প্রচণ্ড চাপে বরফশীতল নার্ভ রেখে যেতে পারার ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা আছে। মজা করে কেউ কেউ বলত, এমএসডির ব্রেন ম্যাপিং দরকার। যে চাপের হিমশৈলে পড়লে আর পাঁচ জনের দফারফা হয়, সেই একই চাপে এই ভদ্রলোক মস্তিষ্ককে এয়ার কন্ডিশন্ড রেখে দেন কী ভাবে?
ইডেনের আইপিএল ফাইনাল শুধু দু’বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল না। মুম্বইকে একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আবারও চ্যাম্পিয়ন করে কেকেআর-সিএসকের রেকর্ডের সমান অংশীদার করল না। কোনও এক রোহিত গুরুনাথ শর্মার প্রতি অপার ‘প্রেম’ নিবেদনে থেমে থাকল না। রবিবাসরীয় আইপিএল ফাইনাল আরও একটা জিনিস করে দিয়ে গেল।
ব্র্যান্ড এমএসডিকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল।
বাহবা মেন্টরের। রবিবার ইডেনে দলের সঙ্গে সচিন তেন্ডুলকর। ছবি: উৎপল সরকার।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও তা হলে চাপে পড়েন! মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও তা হলে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে রক্তমাংসের ক্যাপ্টেনদের মতো ভুল করেন! দুশো তাড়া করতে নামলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নার্ভও তা হলে ডাহা ফেল মারতে পারে!
শেন ওয়ার্ন সিদ্ধান্তটা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ওয়ার্নির এক সময়ের ‘মহাশত্রুর’ শিশুর সারল্যে দু’হাত ছুড়ে পিচের দিকে উল্লাসের দৌড় কিংবদন্তি লেগস্পিনারের থিওরিতে সিলমোহর দিয়ে গেল। টস জিতে এমন ব্যাটিং উইকেট দেখেও কি না ধোনি ফিল্ডিং নিলেন! বললে কেউ বিশ্বাস করবে, সিএসকে গোটা ম্যাচে ছিল কি না মোটে এক ওভার! পার্থিব পটেলের রান আউটের সময়টুকুর কথা হচ্ছে। কিন্তু ওটুকুই। এমএসডির গর্বের স্পিন অ্যাটাকের কেউ এর পর দু’ওভারের বেশি বল করার বিশ্বাস অর্জন করতে পারলেন না। রবিচন্দ্রন অশ্বিন দু’ওভারে একুশ। রবীন্দ্র জাডেজা দু’ওভারে ছাব্বিশ। পবন নেগি দু’ওভারে আঠারো। সর্বমোট ছ’ওভারে ৬৫। পেসারদের অবস্থা বিস্তারিত লিখে অহেতুক নিউজপ্রিন্ট খরচ অর্থহীন। একটাই উদাহরণ যথেষ্ট। টিমের এক নম্বর পেসার আশিস নেহরা চার ওভারে চল্লিশের উপর দিয়ে গেলেন।
কিন্তু আইপিএল অতীত বলে, সিএসকের এমন অবস্থা নতুন নয়। দুশো তাদের আগেও তাড়া করতে হয়েছে। তারা জিতেওছে। নতুন হল, রবিবার ফাইনালে তাদের সম্পূর্ণ নখদন্তহীন হয়ে আছড়ে পড়া। বোলিংয়ে, ফিল্ডিংয়ে, ব্যাটিংয়ে। বুড়ো মাইক হাসি আর টগবগে ব্রেন্ডন ম্যাকালামের পার্থক্য কতটা, খুব স্পষ্ট বুঝে গেলেন এমএসডি। বুঝলেন, চাইলেই সবাই ব্র্যাড হগ হতে পারে না। ম্যাচটায় কী হতে চলেছে, সেটা বোঝার জন্য সিএসকে ব্যাটিংয়ের কুড়ি ওভার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। সাত ওভারের মধ্যেই আস্কিং রেটটা তেরোয় চলে গেল। আর দক্ষ ওপেনারের অভাবে সিএসকে টের পেতে লাগল, স্কোরবোর্ডে দুশো কী বিষম বস্তু। সুরেশ রায়না এত ভাল স্পিন খেলেন। হরভজন যে ভাবে তাঁকে আউট করলেন, চোখে লাগবে। ডোয়েন স্মিথকে দেখে মনে হল হার্দিক পাণ্ডিয়া নন, মুম্বই ডাগআউটে বসে থাকা শেন বন্ডকে খেলছেন।
আর এমএসডি স্বয়ং? পারলে তিনিই পারতেন। চার বছর আগের ওয়াংখেড়ে ফাইনালের মতো নিজেকে তুলে এনেছিলেন চারে। কিন্তু মাঝে তো চারটে বছর বেরিয়েও গিয়েছে। ব্যাট নামার আগে মালিঙ্গার স্লোয়ার ইয়র্কার এখন মিডল স্টাম্প উড়িয়ে দেয়। চোখের সামনে দেখতে হয় গ্যালারির দিকে মুখ করে বুক চাপড়ে, কলার উঁচিয়ে দর্শকদের তাতাচ্ছেন কোনও এক হরভজন সিংহ। দেখতে হয়, সে দিনের ছেলে হার্দিক পাণ্ডিয়া ক্যাচ ধরে চুলে এমন ঔদ্ধত্য নিয়ে হাত বোলাচ্ছেন, যা এত দিন ব্র্যান্ড সিএসকের একচেটিয়া ছিল। শুনতে হয়, পার্থিব পটেল আজকের পর নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন।
আর তাঁর ঘুম— সেটা হবে তো?
বাইশ গজে তো হারলেনই, আবেগের ম্যাচটাও যে ধোনি ইডেনে রেখে গেলেন। ভাল করে বললে, রেখে গেলেন দুই মরাঠির কাছে। এক জন নতুন প্রজন্মের। এক জন তার ঠিক আগের।
এক জন রোহিত শর্মা। দ্বিতীয় জন সচিন তেন্ডুলকর।
মুম্বই টিমটার উত্থানের পিছনে শোনা গেল তেন্ডুলকরের চেয়ে বেশি ভূমিকা রিকি পন্টিংয়ের। আইপিএল আটের পঞ্চম ম্যাচে প্রথম জিতে জায়ান্ট স্ক্রিনে ‘উইনার্স মুম্বই ইন্ডিয়ান্স’ লেখাটা দেখার পর যে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল মুম্বই সংসারে, তাকে আরও মেজে ঘষে, অস্ট্রেলীয় কাঠিন্য মিশিয়ে ফাইনালে সিএসকের মতো প্রতিপক্ষকে তুবড়ে দেওয়ার মানসিকতা আমদানি করেছেন পন্টিং। কিন্তু অস্ট্রেলীয় বিশ্বজয়ী অধিনায়ক নয়, রবিবারের ইডেনে আবেগের মুখ তেন্ডুলকর। হাই তোলা থেকে গাল চুলকোনো ক্যামেরা যখনই ধরেছে, ইডেনে আদিম ‘সচিন সচিন’ আওয়াজ ফিরে এসেছে। ম্যাচ শুরুর আগে তিনি প্র্যাকটিস উইকেটে পুরনো সেই লেগস্পিনটা করেছেন, করতালির শব্দব্রহ্মে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে ইডেন।
রোহিত শর্মা? ইডেনে রোহিত শর্মা নামলে নিশ্চয়ই তাঁর কিছু একটা হয়। রোহিত শর্মা নামলে ইডেনেরও নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়। এ মাঠের ইতিহাস বলে, দশক পিছু সে একজনকে তুলে এনে সম্রাটের সিংহাসনে বসিয়েছে। কখনও সেই সম্রাটের নাম মহম্মদ আজহারউদ্দিন। কখনও ভিভিএস লক্ষ্মণ। কখনও বেতাজ বাদশার নাম রোহিত শর্মা। টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি, ওয়ান ডে-র বিশ্বরেকর্ড, ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরি, আইপিএল সেঞ্চুরি, দু-দুটো আইপিএল ট্রফি ছোঁয়া সবই তাঁর এখানে। সিএসকের কপাল ভাল, রোহিত আজ সেঞ্চুরি করেননি। যা করতে পারতেন। করলে লাঞ্ছনা যে বাড়ত, বলা নিষ্প্রয়োজন। আসলে এ মাঠের নিয়মটাই একটু অদ্ভুত। ব্যক্তি, ধর্ম, প্রাদেশিকতা নির্বিশেষে ইডেন নিজের খেয়ালে বেছে নেয় এক-এক জনকে। মুক্তহস্তে তাকে অঞ্জলি অর্পণ করে। দেয় যা যা দেওয়া সম্ভব। আর ঘরের ছেলেকে ঘরের মাঠে প্রথম সেঞ্চুরির জন্য দাঁড় করিয়ে রাখে কেরিয়ারের গোধুলি লগ্ন পর্যন্ত।
এমন বেখেয়াল ইডেনে ক্যাপ্টেন কুলও নার্ভ আর রাখতেন কী করে?