চুনী বড় ম্যাচে আমার বিরুদ্ধে কখনও গোল করতে পারেনি

মোহনবাগানে খেলেননি কখনও। ডার্বিতে গোল করে জিতিয়েছেন ইস্টবেঙ্গলকেই। ফের দরজায় কড়া নাড়ছে ডার্বি। স্মৃতি হাতড়ালেন তুলসীদাস বলরামশহর উত্তাল হয়ে উঠেছে ম্যাচ ঘিরে। যেখানেই যাচ্ছি, সবাই বলছে ম্যাচটা জিততেই হবে। দু’দিন আগে থেকেই টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। গোলের জন্য ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমার পা-ও ধরে ফেলত রাস্তা ঘাটে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:৫৩
Share:

কিংবদন্তি: ময়দানে এক প্রদর্শনী ম্যাচে তুলসীদাস বলরাম। ক্লাব ও দেশের হয়ে বলরামের একাগ্রতা ছিল দেখার মতো। সেকেন্দরাবাদ থেকে কলকাতায় খেলতে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন লাল-হলুদ সমর্থকদের নয়নের মণি। ফাইল চিত্র

যতদূর মনে পড়ছে সে বার আমি ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক। সালটা ১৯৬১। মোহনবাগানকে হারাতে পারলেই আমরা কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন। লিগ টেবলের যা পরিস্থিতি জিততে পারলে তিন-চারটে ম্যাচ বাকি থাকা সত্ত্বেও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাব আমরা। মনের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা। জিততে পারব তো? লিগ পাব তো? প্রতিদিন অনুশীলনের পর নারাইন, আমি, কান্নান, বালসুব্রামনিয়ম, মুসা আলোচনায় বসি, কীভাবে ওদের হারানো যাবে তার অঙ্ক কষতে। তখন কোচ রাখার রেওয়াজ ছিল না কোনও ক্লাবে। নিজেরাই অনুশীলন করতাম। জ্যোতিষচন্দ্র গুহ, বোমকেশ বসুরা আমাদের সঙ্গে কথা বলে নিয়ে দল বাছতেন। ট্যাকটিক্স, স্ট্র্যাটেজি—এসব কেউ বোঝাতোও না। তা সত্ত্বেও সব ম্যাচের থেকে ‘বড় ম্যাচ’ ছিল আলাদা। তখনও ডার্বি শব্দটা বাজারে আসেনি। বড় ম্যাচই বলা হতো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচকে।
শহর উত্তাল হয়ে উঠেছে ম্যাচ ঘিরে। যেখানেই যাচ্ছি, সবাই বলছে ম্যাচটা জিততেই হবে। দু’দিন আগে থেকেই টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। গোলের জন্য ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমার পা-ও ধরে ফেলত রাস্তা ঘাটে। উল্টো দিকে জার্নেল সিংহ পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে। দাড়িওয়ালা জার্নেলকে আমি কেন, তখনকার এশীয় মহাদেশের সব স্ট্রাইকারই ভয় পেত। এত মারত! মোহনবাগানে জার্নেলের সঙ্গে সুশীল গুহ, কেম্পাইয়া, নারসিয়া, অরুময়নইগম। লিগের সর্বোচ্চ স্কোরার সে বার আমি। তবুও উল্টোদিকে যারা, তাদের কথা ভেবে চিন্তায় রয়েছি। রাতের ঘুম হচ্ছে না। ওদের ফরোয়ার্ডে চুনী গোস্বামীর সঙ্গে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ম্যাচ এগিয়ে আসছে। একদিন অফিসে বসে আছি। আমার এক সহকর্মী এসে বললেন, ‘‘জার্নেলের ডান পায়ের গোড়ালিতে চোট আছে। ও খোঁড়াচ্ছে। তুমি গোলের জন্য ওই পা-টা টার্গেট করো।’’ হাতে যেন চাঁদ পেলাম। আমি মাঠে নামার পর থেকেই বল চাইছিলাম সতীর্থদের কাছ থেকে। হঠাৎ পেয়েও গেলাম বল। এ বার দৌড় শুরু করলাম। জার্নেলের ডান দিক দিয়ে অর্থাৎ আমি বাঁ দিক ধরে বল নিয়ে এগোচ্ছি। জার্নেল ট্যাকল করতে ভয় পাচ্ছে। আমি এগোচ্ছি আর ও পিছোচ্ছে। পিছোতে পিছোতে ভয়ে ও নিজেদের গোলকিপার সনৎ শেঠের প্রায় ঘাড়ের উপর উঠে পড়ল। সেই সুযোগে গোল করে দিলাম। প্লেসিং শটে। পরে জার্নেল আমাকে বলেছিল, ‘‘তুই প্রচণ্ড চালাকি করলি। আমি কাউকে বুঝতে দিইনি আমার ডান পায়ে চোট আছে। তুই সেটা জেনে গিয়েছিলি। ওটাই টার্গেট করে জিতে গেলি।’’ বিশ্বাস করুন, দেশ-বিদেশে প্রচুর গোল করেছি। ট্রফি পেয়েছি। সম্মানও। কিন্তু জার্নেলের মতো স্টপারের কাছ থেকে পাওয়া এই ‘প্রশংসা’ আমার কাছে সেরা সম্মান। তার কারণ ওটা ছিল বড় ম্যাচ। যা জেতার জন্য আমাদের সমর্থকরা পাগল হয়ে যেত। লিগ বা আই এফ এ শিল্ড জিতেছি অথচ ডার্বি জিতিনি, এর কোনও দামই ছিল না সমর্থকদের কাছে। কলকাতার মাঠে ডার্বির মাহাত্ম্যই যে আলাদা। সে বার আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম শুধু নয়। আমি ২৩ গোল করেছিলাম। লিগের দুটো ডার্বিতেই সে বার আমার গোল ছিল। সেরা গোলদাতার সঙ্গে সেরা ফুটবলারও হয়েছিলাম।
অনেক ভেবেচিন্তে সেকেন্দরাবাদ থেকে কলকাতায় এসেছিলাম মহমেডানে খেলব বলে। ১৯৫৬-৫৭তে ভারতের হয়ে ‘ফার ইস্ট ট্যুর’- এ যাওয়ার আগে কলকাতার তিন প্রধান ক্লাবের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আমার দুই বন্ধু অলিম্পিয়ান নুর মহম্মদ আর আজিজ বলল, ‘‘ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানে খেল। অন্য আনন্দ পাবি।’’ ওরাই নারাইন, কান্নান এবং আমাকে নিয়ে ইস্টবেঙ্গলের তখনকার কর্তা প্রয়াত জ্যোতিষবাবুর কাছে গিয়েছিলেন। সইও করে দিলাম। তারপর বহু বার প্রয়াত ধীরেন দে এবং মোহনবাগানের প্রস্তাব পেয়েছি। কিন্তু দল বদলাইনি। ধীরেন দে-র মুখের উপর বলে এসেছিলাম, ‘‘আমাকে পাবেন না। আমি ইস্টবেঙ্গলেই খেলব।’’ কলকাতায় আসার আগে বাংলার এই আগুনে ম্যাচ নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। কিন্তু ১৯৫৭-তে প্রথম বার খেলতে নেমেই টের পেলাম বিশ্বের যেখানে যত ম্যাচই খেলে বেড়াই, ডার্বির গুরুত্ব সবার থেকে আলাদা। আমি ছোটবেলায় অন্য বাঙালিদের মতো ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান সমর্থক হয়ে জন্মাইনি। কিন্তু লাল-হলুদ জার্সি পরার পর বুঝতে পারলাম ডার্বির গুরুত্ব কী? পুরো বাংলাই তো দু’ভাগ হয়ে যেত। ঘরের ঠাকুমা বা মাসিমা ফুটবল না জানলেও বাঙাল-ঘটিতে ভাগ হয়ে যেত। আমি হায়দরাবাদি হয়ে বাঙাল-ই থেকে গেলাম সারা জীবন। ঘটি হতে পারলাম না। কেন জানি না মোহনবাগানকে হারাতে পারলে অন্য আনন্দ পেতাম। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আমাকে যেভাবে ভালবাসত, তাকে অমর্যাদা করতে পারব না বলেই কখনও ওদের দুঃখ দিতে পারিনি। ছাড়িনি ক্লাব। রেলে চাকরির সুবাদে বি এন আরে যোগ দিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। কিন্তু ওখানে গিয়েও মোহনবাগানের বিরুদ্ধে অনেক গোল আছে আমার। তা দেখে লাল-হলুদ সমর্থকরা আমাকে নিয়ে মেতে উঠত। কারণ ওদের লিগ পেতে সুবিধা হত।

Advertisement

ত্রয়ী: ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা তিন তারকা। (বাঁ দিক থেকে) চুনী, পিকে ও বলরাম।

বড় ম্যাচের আগে নিজেদের মতো করে নিজেরা তেতে যেতাম। আমি যে বার অধিনায়ক, সে বারের ফিরতি ডার্বির একটা ঘটনার কথা বলছি। মাঠে আমরা ম্যাচের আগে ওয়ার্ম-আপ করছি। হঠাৎ দেখলাম দু’দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মাঠে ঢোকার পর প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এক ভদ্রলোক। অ্যাম্বুলেন্স, স্ট্রেচার নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন স্বাস্থ্য কর্মীরা। ওই লাল-হলুদ সমর্থককে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। বেচারা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় টিকিট পেয়েও খেলা দেখতে পেলেন না। আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম, যে করেই হোক মোহনবাগানকে হারাতে হবে। ওই সমর্থক যেন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে খোঁজ করলে শোনেন যে তাঁর দলই জিতেছে। সেই শপথেই কাজ হল। ম্যাচটা জিতেছিলাম। গোল করেছিলাম আমি। বয়স হয়েছে। অনেক কথাই ভুলে গিয়েছি। কিন্তু ভুলতে পারি না একটা কথা, তা হল আমি যে পাঁচ বছর লাল-হলুদ জার্সি পরে খেলেছি চুনী গোস্বামী কখনও ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল করতে পারেনি।

Advertisement

আই লিগের শেষ পাঁচ সাক্ষাৎকার
২ এপ্রিল ২০১৬: ইস্টবেঙ্গল ২ (দো দং হিউম ২) মোহনবাগান ১ (কাতসুমি ইউসা)
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭: ইস্টবেঙ্গল ০ মোহনবাগান ০
৯ এপ্রিল ২০১৭: মোহনবাগান ২ (সনি নর্দে, আজহারউদ্দিন)- ইস্টবেঙ্গল ১ (রওলিন বর্জেস)
৩ ডিসেম্বর ২০১৭: মোহনবাগান ১ (কিংসলে) ইস্টবেঙ্গল ০
২১ জানুয়ারি ২০১৮: মোহনবাগান ২ (দিপান্দা ডিকা ২) ইস্টবেঙ্গল ০

চুনী, পিকে (বন্দ্যোপাধ্যায়), আমি অসংখ্য ম্যাচ খেলেছি দেশের জার্সিতে। এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছি। দু’টো অলিম্পিক্সে খেলছি। মারডেকা খেলছি। সবই বন্ধু হিসাবে। সেখানেও তিন জনে একাকাট্টা হয়ে লড়াই করেছি। জিতেছি, হেরেছি। দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। কিন্তু দেশ ছেড়ে ক্লাব জার্সির লড়াইতে এলেই যেন সব ওলটপালট হয়ে যেত। তখন চুনী আমার প্রতিপক্ষ হয়ে যেত। এই বিরাশি বছর বয়সে এসে ফুটবল থেকে আমি অনেক দূরে, কবে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ তারও খোঁজ রাখতে পারি না সব সময়। তখনও বারবার মনের মধ্যে আলোড়ন তোলে কথাগুলো-- চুনী কিন্তু আমার বিরুদ্ধে গোল করে কখনও আনন্দ করতে পারেনি। আমি যেটা করেছি। ডার্বির এটাই মাহাত্ম্য। কালের নিয়মে, বয়সের ভারে আমার অনেক সাফল্য মুছে গিয়েছে মাথা থেকে। চলে গিয়েছে দেশের হয়ে এবং ইস্টবেঙ্গলে খেলে করা ১৩০ গোলের অনেক স্মৃতি। কিন্তু যেন দ্বীপের মধ্যে জেগেও থাকে একটাই কথা—ডার্বিতে চুনী আমাকে পিছনে ফেলতে পারেনি।

অনুলিখন: রতন চক্রবর্তী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন