শিল্পী: সবুজ-মেরুন জার্সিতে চুনী গোস্বামী ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল প্রবল। ময়দান আজও স্মৃতিচারণ করে তাঁর অনবদ্য ড্রিবল নিয়ে। ফাইল চিত্র
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ মানেই খেলোয়াড় জীবন থেকে আমরা শুনে আসছি এটা সম্মানের লড়াই। ফুটবল মাঠে ঘটি-বাঙালের লড়াই। সেই ম্যাচে আমি খেলে গিয়েছি মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন জার্সি গায়েই।
মজার ব্যাপার এটাই যে আমাদের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার যশোদল গ্রামে। জন্মেছিও পূর্ববঙ্গে। বাবা যখন কলকাতায় চলে আসেন তখন ১৯৪২ সাল। আমার বয়স চার বছর। সেই অর্থে আমি বাঙাল। কিন্তু বাঙাল হয়েও এই ঐতিহ্যের ম্যাচে আমি ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছি ঘটিদের ক্লাব মোহনবাগানের হয়ে। কারণ আমার বেড়ে ওঠা লেখাপড়ায় হাতেখড়ি, ফুটবলের সঙ্গে সখ্য তৈরি হওয়া, তার পুরোটাই এ পার বাংলার জলহাওয়ায়।
১৯৫৪ সালের ২৯ মে মোহনবাগানের হয়ে ইস্টার্ন রেলের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমেই গোল করেছিলাম আমি। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম বড় ম্যাচের স্মৃতি আজ অনেকটাই ঝাপসা। ১৯৫৫। সাল সেটা ছিল ফিরতি লিগের খেলা। ম্যাচের আগের দিন জানতে পেরেছিলাম আমি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলতে নামব। চিন্তায় সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।
আসলে চিন্তাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার গুরু বলাইবাবু। বলেছিলেন, ‘‘মোহনবাগান থেকে বদ্রু (বন্দ্যোপাধ্যায়) অলিম্পিক্সে যাবেই। ও তো খেলবে রাইট ইনে। লেফ্ট ইনে যারা তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, তারাও খেলবে তোমার বিরুদ্ধে। ওরা চাইবেই তোমাকে দমিয়ে রাখতে। ওদের ছাপিয়ে ভাল খেলতে হবে তোমাকে। মনে থাকে যেন কথাটা।’ এতেই আমার চাপটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। খুব সম্ভবত বলাইদা ইস্টবেঙ্গলের কিট্টুর কথা বলেছিলেন। সেই রাতেই আমি একটা ডার্বি খেলে ফেলেছিলাম। তবে তা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে। হয়তো সেই স্বপ্নে একটা গোলও করেছিলাম।
তবে পরদিন মাঠে নেমে সব চিন্তা মাথা থেকে কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। মাঠে নামার পরে সংকল্প ছিল, আজ ভাল খেলতে হবেই। তবে আমার প্রথম ডার্বি ম্যাচে কোনও গোল করতে পারিনি। খেলাটিও শেষ হয়েছিল গোলশূন্য ভাবে। তবে ম্যাচের পরদিন সংবাদপত্রের পাতায় আমার খেলার প্রশংসা হয়েছিল।
ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ডার্বি ম্যাচে প্রথম গোল পেলাম ১৯৫৭ সালের ডুরান্ড কাপ সেমিফাইনাল। ম্যাচটা মনে আছে এই কারণেই যে দু’বারই ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে গিয়েছিল। আমি গোল করে ২-২ করি। তবে আমার প্রথম ডার্বি গোলের ওই ম্যাচে শেষ লগ্নে গোল করে ফাইনালে যায় ইস্টবেঙ্গল।
তেষট্টি সালে কলকাতা লিগের ডার্বি ম্যাচে আমরা প্রথম পর্বে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ হারিয়েছিলাম। সেই ম্যাচে মোহনবাগানের প্রথম গোলটা আমারই। কিন্তু পরের ডার্বি ম্যাচের আগে আমাদের মধ্যে একটা আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল। আমরা ভাবলাম, এ বারও ইস্টবেঙ্গলকে উড়িয়ে দেব। কিন্তু সেই খেলায় আমরা ০-২ হেরে গিয়েছিলাম। সেই ম্যাচের আগের দিন ইস্টবেঙ্গল শ্রীলঙ্কা থেকে উড়িয়ে এনেছিল নূর নামের এক ফুটবলারকে। খেলার দিন আইএফএ অফিসে গিয়ে নাম নথিবদ্ধ করে মাঠে নেমেছিল সে। ওর দাপটেই সে দিন ম্যাচ হেরেছিলাম আমরা।
আমাদের সময় ডার্বি ম্যাচ ঘিরে দুই প্রধানের রেষারেষি থাকলেও পারস্পরিক সৌজন্যবোধ একবিন্দুও টোল খায়নি। এ প্রসঙ্গে ১৯৬৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অতুল্য ঘোষ তখন আইএফএ সভাপতি। শিল্ড ফাইনালে খেলবে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল। খেলার তারিখ নিয়ে ইস্টবেঙ্গল প্রথমে আপত্তি জানায় তাদের কয়েক জন ফুটবলারের চোট থাকায়। হাতে সময় বেশি ছিল না। তাই আইএফএ ফাইনালের তারিখ পরিবর্তন করেনি। প্রতিবাদে ইস্টবেঙ্গলও খেলার দিন মাঠে হাজির হল না। মোহনবাগান ‘ওয়াক ওভার’ পেল। আইএফএ আমাদের শিল্ড বিজয়ী ঘোষণা করে দিল। এ ভাবে না খেলেই মোহনবাগানের শিল্ড জয় অতুল্যদার পছন্দ হয়নি। তিনি আমাদের ক্লাবের কর্তা ধীরেন দে-কে ডেকে বললেন, ‘‘ওহে ধীরেন, না খেলে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয় আবার কেমন জয়? তাও শিল্ড ফাইনালে? এতে কি তোমাদের ক্লাবের গৌরব বাড়বে? তোমরা যদি রাজি থাকে, তা হলে আমি ফের ফাইনাল ম্যাচটি করার চেষ্টা করতে পারি।’’ ধীরেনদা শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। পুরো দল নিয়ে কয়েক দিন পরে ইস্টবেঙ্গল খেলতে নামল। আমাদের হারিয়ে শিল্ড জিতল ওরাই।
বিয়ে করার পরেই চৌষট্টি সালে ডার্বি ম্যাচে গোল পাই। ম্যাচটায় আমরা জিতেছিলাম ৩-১। ম্যাচের পরে মোহনবাগান ড্রেসিংরুমে বলাইদা রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘‘দেখলি তো ঘটি মেয়েকে বিয়ে করার গুণ।’’
অনবদ্য: কড়া ট্যাকলেও চুনীকে আটকাতে বারবার ব্যর্থ হতেন প্রতিপক্ষের ফুটবলারেরা। ফাইল চিত্র
তবে ডার্বি আমার কাছে চিরস্মরণীয় ১৯৬৭ সালের জন্য। তখন খেলা ছাড়ার দিকে চলে এসেছি। ১৯৬৭ সালের মরসুম মোহনবাগানের ভাল যায়নি। লিগ হারাতে হয়েছিল। ৩০ জুলাই, ইডেনে মহমেডানের কাছে হারের পরেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম লিগ আসছে না। শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হল যে লিগের খেলায় যদি আমরা ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারি, তা হলে মহমেডান লিগ চ্যাম্পিয়ন হবে। আর আমাদের হারালে চ্যাম্পিয়ন হবে ইস্টবেঙ্গল। ক্লাবেই কয়েক জন বলতে শুরু করলেন, ‘‘চুনী কিছুতেই গা লাগিয়ে খেলবে না। আমাদের লিগ জয়ের আশা থাকলে তাও খেলত, আমাদের যখন সম্ভাবনা নেই, আর জিতলেই চ্যাম্পিয়ন হবে ইস্টবেঙ্গল, তখন সত্যিকারের চুনীকে পাওয়া যাবে না মাঠে।’’ এতে আমার রোখটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ৬ অগস্টের সেই ম্যাচে ইডেনে খেলা শুরুর পরেই নামল বৃষ্টি। মাঠে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় রেফারি ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেন। ফের এক মাস পরে ১০ সেপ্টেম্বর ম্যাচের দিন ধার্ষ হল।
ইস্টবেঙ্গলে তখন গোলে পিটার থঙ্গরাজ। ছাড়াও সুনীল ভট্টাচার্য, নইমুদ্দিন, প্রশান্ত সিংহ, পরিমল দে, হাবিব। এটাই আমার জীবনের শেষ ডার্বি। ম্যাচটায় মোহনবাগান জিতেছিল আমার গোলেই। দ্বিতীয়ার্ধে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বল পেয়ে পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে থেকে বাঁক খাওয়ানো শট নিয়েছিলাম। তাতেই পরাজিত হয় থঙ্গরাজ। গোলের পরে ইডেনে মোহনবাগান সমর্থকরা চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। তার মিনিটখানেক পরেই চিৎকার উঠল মহমেডান মাঠ থেকে। ভাবলাম ওই মাঠেও হয়তো গোল হল। পরে জানলাম, আমার গোলেই ওদের আনন্দ। ম্যাচ শেষে মোহনবাগানের সমর্থকদের সঙ্গে মহমেডান সমর্থকরাও আমাকে কাঁধে নিয়ে সে দিন নেচেছিল।
সে দিন রাতে বাড়ি ঢুকেই পেলাম পাড়া মাত করা মোগলাই খানার গন্ধ। প্রচুর বিরিয়ানি, কাবাব। পাঠিয়েছেন মহমেডান ক্লাবের কর্তা ও সমর্থকরা। প্রায় পঞ্চাশ জনের খাবার। কিন্তু এত খাবার কে খাবে? পাড়ার ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের ডাকলে ভাবতে পারে মজা করছি। তাই ওদের আর ডাকতে যাইনি। শেষ পর্যন্ত মোহনবাগানের বন্ধুদের ডেকেই সেই নৈশভোজ সেরেছিলাম আমার যোধপুর পার্কের বাড়িতে।
মুখোমুখি দুই প্রধান
ম্যাচ: ৩৬৫
ইস্টবেঙ্গল জয়ী: ১২৭
মোহনবাগান জয়ী: ১১৮
ড্র: ১২০