বিতর্ক: জাতীয় সঙ্গীত কেন সব ম্যাচে, উঠছে প্রশ্ন। ফাইল চিত্র
রিও অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে উঠে পিভি সিন্ধু যখন পদক নিচ্ছিলেন তখন বাজছিল জাতীয় সঙ্গীত। সিন্ধুর সঙ্গে তাতে গলা মেলাচ্ছিলেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত সব ভারতীয়।
অভিনব বিন্দ্রা, সাক্ষী মালিকরা ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠে অলিম্পিক্সের পদক গলায় ঝোলানোর সময় নিয়ম মেনে উঠেছিল তেরঙ্গা পতাকা। বেজেছে জাতীয় সঙ্গীত। এটাই নিয়ম।
দেশের জার্সিতে যখন কোনও আন্তর্জাতিক টুনার্মেন্টে মাঠে নামেন বা পদক জেতেন ক্রিকেটার, ফুটবলার বা অন্য খেলার ক্রীড়াবিদরা তখনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাজতে শোনা যায় দেশের জাতীয় সঙ্গীত।
কিন্তু ক্রিকেটের দ্বিপাক্ষিক সিরিজে, কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা পরিচালিত ফুটবল টুর্নামেন্ট বা ফেডারেশনের ক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্টে কেন বাজানো হবে জাতীয় সঙ্গীত? বিভিন্ন খেলায় চালু হওয়া প্রো লিগেও বাজানো হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত। অথচ সেখানে দেশের প্রতিনিধিত্ব কেউ করছে না, খেলছে নিজেদের ক্লাব বা শহরের হয়ে।
খেলার মাঠে যত্রতত্র এভাবে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো কি ঠিক? এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কায় চলতি দু’দেশের সিরিজের প্রতিটি ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো নিয়ে সে দেশের ক্রিকেট প্রশাসন নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, নতুন টুনার্মেন্টের শুরুর ম্যাচেই শুধু বাজানো হোক দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত। এ রকমই কি হওয়া উচিত?
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘যেখানে সেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বেআইনী। এই গান বাজানোর একটা নিয়ম আছে। সম্মান প্রদর্শনের নির্দিষ্ট রীতি আছে। মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টে বাজাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। খেলার মাঠে তো হয়-ই না। গ্যালারিতে অনেক দর্শক বসে থাকেন জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময়।’’ পাশাপাশি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যানের মন্তব্য, ‘‘১৫ অগস্ট বা ২৬ জানুয়ারি পাড়ায় পাড়ায় দেখি খেলার সময় হিন্দি গানের পর ওই গান বাজাচ্ছে। কেউ উঠেও দাঁড়াচ্ছে না।’’
অশোকবাবুর সঙ্গে একমত আর এক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামলবাবুর বক্তব্য ‘‘যেখানে দেশ খেলছে না সেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজবে কেন? মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা বেঙ্গালুরু যে-ই খেলুক, সে তো দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে না। তা হলে আই লিগ বা আইএসএলে বাজানোটা ঠিক হচ্ছে না।’’ শ্যামলবাবু এক সময় মোহনবাগান ক্লাব পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তাতেও তাঁর বক্তব্য, ‘‘ক্লাব এবং দেশের ম্যাচ এক হতে পারে না। দুটোর আবেগই আলাদা। একটা সীমারেখা টানা দরকার।’’
আরও পড়ুন: এমএস দেখাল, কেন ওকে দরকার
অলিম্পিক্সে বা এশিয়াডে যখন দেশের জার্সিতে নামতেন তখন ‘জনগণমন’ শুনে বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ঝরত চুনী গোস্বামী বা গুরবক্স সিংদের। জানাচ্ছেন ওঁরা। দুই কিংবদন্তীই চান, ‘‘খেলার মাঠে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর ক্ষেত্রে নিয়ম বেঁধে দেওয়া হোক। না হলে জাতীয় সঙ্গীতের গুরুত্বই তো থাকছে না।’’
এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ী ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবল অধিনায়ক চুনী বলছিলেন, ‘‘আই লিগ বা আই এসএলে কেন জাতীয় সঙ্গীত বাজবে? এর সঙ্গে দেশের সম্পর্ক কী? যেখানে জাতির আবেগ জড়িয়ে থাকবে সেখানেই এটা বাজানো হোক।’’ তাঁর অনুযোগ, ‘‘অলিম্পিক্স, এশিয়াডে যখন খেলতে গিয়েছি তখন এটা বাজলে শরীরে আলোড়ন উঠত। কারণ আমরা সবাই ছিলাম ভারতীয়। সবাই একসঙ্গে গাইতাম। কিন্তু ক্লাবের ম্যাচে সনি নর্দে বা আল আমনাদের দেখি চুপ করে থাকে। আসলে ওরা তো বুঝতেই পারে না কী বাজছে। এটা লজ্জার।’’
টোকিও অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী হকি দলের সদস্য গুরবক্স সিংহ কিন্তু মনে করেন যেখানে রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রীর মতো পদাধিকারী উপস্থিত থাকবেন, সেখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজুক। ‘‘আমি তো বেটন কাপের ফাইনালে বাজাতাম। রাজ্য হকি সচিব থাকার সময়। তবে মঞ্চে তখন থাকতেন রাজ্যপাল বা কোনও মন্ত্রী।’’ বলার পাশাপাশি এশিয়াডে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়কের মন্তব্য, ‘‘কবাডির টুর্নামেন্টে কলকাতা-জয়পুর টিমের ম্যাচের আগে যদি জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’’
চুনী বা গুরবক্সের সঙ্গে একমত নন অ্যাথলেটিক্সের কিংবদন্তি মিলখা সিংহ। ‘‘সব খেলার মাঠেই বাজুক না জাতীয় সঙ্গীত, ক্ষতি কী? ক্লাবের খেলায় বাজলে কোনও ক্ষতি তো নেই। দেশের প্রতি তো এটা শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে,’’ লুধিয়ানা থেকে বললেন মিলখা। কিন্তু ওই গান বাজালে তো উঠে দাঁড়াতে হয়, সেটাই তো করে না অনেকেই? মিলখা বলেন, ‘‘এই গান বাজানোর আগে বলে দিতে হবে সবাইকে।’’ সেটা কি সম্ভব? বিশেষ করে ব্যস্ত রাস্তায় বা খোলা মাঠে? মিলখা প্রশ্ন শুনে নীরব থাকেন।