দু’হাজার চোদ্দোর ২৫ নভেম্বর ভারতীয় ক্রিকেটে মোড় ঘোরানো দিন হিসেবে থেকে যাবে? ক্রিকেট সমর্থকরা কি এই দিনটা তেমনই সশ্রদ্ধ স্মরণ করবে, যেমন করে বিখ্যাত সব ক্রিকেট বিজয়ের দিন-টিন?
দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের কিছু ক্রিকেট কর্তা এখনই আবেগে ভেসে যাওয়ার কারণ দেখছেন না। সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়াও দেবেন না। যতক্ষণ না সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট কোনও অর্ডার বেরোচ্ছে, নিছক আদালতের পর্যবেক্ষণে উল্লসিত হতে রাজি নন। যদিও তাঁরা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকবেন মঙ্গলবার দুপুর দু’টো থেকে। এতটুকু তো গোটা দেশ বুঝছে, যদি কখনও হওয়ার হয় তা হলে এখনই! যদি এ বারও না হয়, তা হলে আর হবে না।
মিডিয়ার চোখে, জনতার চোখে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন সুপ্রিম কোর্টে এ দিন শুধু চূড়ান্ত অপদস্থই হননি, নীতিগত ভাবে নাকচই হয়ে গিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতদ্বারা। কিন্তু শ্রীনির পক্ষ এবং বিপক্ষ বোর্ডের কোনও গোষ্ঠীই এটাকে চূড়ান্ত নির্ণায়ক মানতে রাজি নয়।
প্রাক্তন দুই বোর্ড প্রেসিডেন্ট বললেন, এর আগেও সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি পট্টনায়ক উগ্রতম ভাবে তিরস্কার করেছিলেন শ্রীনিকে। বলেছিলেন, এই লোকটার জন্য দমবন্ধ করা এমন গা-গুলোনো পরিবেশ। অথচ এর পর অর্ডারে সেই পর্যবেক্ষণের মনোভাব আদৌ প্রতিফলিত হয়নি। শ্রীনিকে মোটেও আটকায়নি সুপ্রিম কোর্ট আইসিসি প্রধান হতে।
সে বার পরিত্রাণ পাওয়া থেকেই বোধহয় ক্রিকেট-প্রশাসনিক মহলে শ্রীনি সম্পর্কে এই ধারণাটা ছড়িয়ে গিয়েছে যে, শেষ বল অবধি না দেখে বিচার কোরো না। বোর্ডের এক সদস্য এ দিন ফোনে বললেন, “খুব জোরালো অ্যাপিল সন্দেহ নেই। কিন্তু আম্পায়ার তো হাত তোলেনি।” আবার তীব্র শ্রীনি-বিরোধী দেশের মধ্যাঞ্চলের কেউ কেউ বলছেন, “না আঁচালে বিশ্বাস নেই ঠিকই। তবে এ দিন আদালতে বিচারপতিরা যা করেছেন তাতে রায়ের স্বাভাবিক পরিণতি শ্রীনির বিরুদ্ধেই যাওয়া উচিত।”
আদালতের কাছে শ্রীনি আবেদন করেছিলেন, তাঁর ওপর থেকে বোর্ড প্রধান হিসেবে দাঁড়াবার আইনি নিষেধাজ্ঞা যেন তুলে নেওয়া হয়। কারণ মুদগল রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে কিছুই পাওয়া যায়নি। সর্বোচ্চ আদালত তাতে এমন কড়া প্রতিক্রিয়া দিতে পারে অনেকেই ভাবেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল বরাবরের মতো গেম আর সেট জিতে নিয়ে এ বার তৃতীয় পরিণতির দিকে এগোচ্ছেন শ্রীনি।
অথচ বিচারপতি ঠাকুর এবং বিচারপতি খলিফুল্লাহ্-র দুই সদস্যের বেঞ্চ তীব্র কটাক্ষে শ্রীনির উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা দেশে ক্রিকেটকে খুন করেছেন। বলেন, আপনি কি করে ধরছেন যে আপনাকে আমরা বোর্ডে নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য ছেড়ে দিয়েছি? একই সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট-বস্ এবং সিএসকে প্রধান হওয়া নিয়েও আদালত মন্তব্য করে, এটা পরিষ্কার স্বার্থের সংঘাত।
বোর্ড আইনজীবী বারবার বলার চেষ্টা করেন, ভারতীয় বোর্ড চলে কো-অপারেটিভ সোসাইটির নিয়মে। তার নিজস্ব গঠনতন্ত্র। নিজস্ব সংবিধান। সেখানে পাশ হয়ে থাকলে তা আইনগত দিক দিয়েও সিদ্ধ। বিচারপতিরা এই সময় রেগে গিয়ে বলেন, “প্রশাসনিক জিনিসে আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন বুঝলাম। অপরাধ যেখানে সংগঠিত হয়েছে, সেটাও কি আপনারা দেখবেন নাকি আমরা দেখব?” ধাতানি খেয়ে বোর্ড আইনজীবী চুপ করে যান।
সোমবার রাতে নয়াদিল্লি থেকে আদিত্য বর্মা বললেন, “তা-ও তো লন্ডন থেকে বিমানবিভ্রাটের জন্য হরিশ সালভে এ দিন দেরিতে পৌঁছেছেন। মঙ্গলবার উনি থাকছেন।” সালভে এর আগে মইয়াপ্পন প্রসঙ্গে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নাম তুলে বোর্ড-দ্বারা প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েছিলেন। এ দিন কিন্তু তাঁর অবর্তমানে নলিনী চিদম্বরম ফের ভারত অধিনায়ককে আলোচনায় টেনে আনেন।
বলেন, “রিপোর্টে নাম না লেখা দু’নম্বর প্লেয়ার হল ধোনি। যার ঘরে মইয়াপ্পন গিয়ে সিএসকে টিম ঠিক করত। মুদগল কমিটি সব প্রমাণ পেয়েছে।” বলামাত্র হাঁ-হাঁ করে ওঠেন বোর্ড আইনজীবী। বলেন, “স্যর, কথা ছিল কোনও প্লেয়ারের নাম ফাঁস করা হবে না। উনি কী করে ধোনির নাম আনছেন?” নলিনী তখন বলেন, “বলতে তো হবেই যে ভারত অধিনায়ক সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত কমিটির সামনে সত্য কথার বলার শপথ নিয়ে পরিষ্কার মিথ্যে বলেছে। এ তো গুরুতর অভিযোগ।” লিস্টে থাকা তিন নম্বর প্লেয়ার নিয়েও আলোচনা ওঠে। ইনি বাঁ হাতি। নিজে বেটিং করেননি কিন্তু তাঁর ঘরে গার্লফ্রেন্ড ঢুকে নাকি এক বুকিকে সেই সেল থেকে ফোন করেছিল।
মঙ্গলবার ভারত অধিনায়ক নিয়ে আলোচনা ফের করার অনুমতি পাওয়া যাবে কি না, অনিশ্চিত। তবে হরিশ সালভে অবশ্যই তুলতে চাইবেন। ক্রিকেটমহল ভেবে পাচ্ছে না, মইয়াপ্পন নিছক ক্রিকেট-উৎসাহী, ধোনির এই বক্তব্য খুলে-আম মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ার রেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এর জন্য কি তিনি কোনও শাস্তির মুখে পড়তে পারেন? নাকি বিশ্বকাপের কথা ভেবে ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দেবে আদালত?
আদিত্য বর্মা ঘোষণা করতে শুরু করেছেন, শ্রীনির আজ শেষ রজনী। তাঁর সঙ্গে একমত না হয়েও শ্রীনি-পক্ষরা হিসেবপত্তর শুরু করেছেন তিনি অনুমতি না পেলে তা হলে প্রার্থী কে?
অভাবিত ভাবে দৌড়ে চলে এসেছেন জগমোহন ডালমিয়া। পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্য তাঁর সঙ্গে নেই এমন অবস্থাতেই। কারণ অরুণ জেটলি। এখনও জেটলিই রিমোট কন্ট্রোলে শ্রীনির বোর্ড চালান। তা ডালমিয়া বাদে জেটলি কাউকে বিশ্বাস করতে রাজি নন। যদিও রাজীব শুক্ল নিজের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে রাজি করাবার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কেউ কেউ আগাম অফার দিয়েছেন, রাজীব সচিব, ডালমিয়া প্রেসিডেন্ট। যা শুনে মধ্যাঞ্চলের বিখ্যাত কর্তা বলছেন, “তা হলে কিন্তু ইলেকশন হবে।”
সব মিলিয়ে জমজমাট বললেও কম বলা হয়। নামেই মঙ্গলবার আদালতকক্ষ। সুদূর অতীতে যেমন লোকে উত্তেজক টেস্ট ম্যাচের শেষ দিন টিভিতে না দেখতে পাওয়ার ছটফটানি নিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকত, ইন্ডিয়ার শেষ অবধি কী হল? জিতল না হারল?
২৫ নভেম্বর সেই স্মৃতিকে ফেরত আনছে। এক হিসেবে ঐতিহাসিক তো বটেই। তা শ্রীনি-রাজ বিলুপ্ত হোক বা থাকুক!