India vs England 2025

ভারত হারেনি, ইংল্যান্ডও হারেনি! জিতেছে ক্রিকেট, গুলি ভরা ‘গান টিম’ নিয়ে আবির্ভাব এক অধিনায়কের

ধর্তব্যের মধ্যে না থাকা যে তরুণ দল নিয়ে লন্ডনের বিমানে উঠেছিলেন গৌতম গম্ভীর, সেই দল বারুদে ঠাসা ছিল। যে বারুদ ইংল্যান্ডের মেঘলা, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতেও দাউদাউ করে জ্বলতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ০৯:১৪
Share:

ভারতীয় টেস্ট দল। ছবি: পিটিআই।

ইংল্যান্ডের মাটিতে পাঁচ টেস্টের সিরিজ়। কঠিন লড়াইয়ের নেতৃত্বে নতুন অধিনায়ক। দলে বেশ কিছু অনভিজ্ঞ মুখ। সঙ্গে লাল বলের ক্রিকেটে ‘ব্যর্থ’ কোচ। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চাননি ভারতীয় দলকে। শুভমন গিলের সেই দলই সমানে সমানে লড়াই করেছে বেন স্টোকসদের বিরুদ্ধে। একাধিক বার পিছিয়ে পড়েছে। তা-ও সিরিজ় হারেনি। পাত্তা না পাওয়া তরুণ দলটার লড়াকু চরিত্রে মুগ্ধ ক্রিকেটবিশ্ব।

Advertisement

২০০৭ সালের পর ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জেতেনি ভারত। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, রবিচন্দ্রন অশ্বিনেরা পারেননি। তাঁদের মতো বিশ্বের প্রথম সারির ক্রিকেটারদের অবসরের পর শুভমনদের নিয়ে যদি-কিন্তুর দোলাচল হয়তো অমূলক ছিল না। তার উপর মহম্মদ শামি ছিলেন না। জসপ্রীত বুমরাহও গোটা সিরিজ় খেলার মতো ফিট ছিলেন না। আস্থা রাখা একটু কঠিন। দেশের মাটির স্পিন সহায়ক পিচ হলেও একটা কথা ছিল। ইংল্যান্ডের মাটিতে, সে দেশের আবহাওয়া এবং সবুজ পিচ— সব কিছু বিবেচনা করে শুভমনের দলকে নিয়ে তেমন আশাবাদী হতে পারেননি অনেকেই।

যাঁরা পারেননি, তাঁরা মাঠে নেমে খেলেননি। যাঁরা পারেননি, তাঁরা শুভমনদের মতো করে ভাবেননি। যাঁরা পারেননি, তাঁরা ভারতীয় ক্রিকেটের সাপ্লাই লাইনের খবর রাখেননি। তাই ভারতের তরুণ দলকে এগিয়ে রাখতেও পারেননি। শুভমনেরা এ সব কিছুই পেরেছেন। তাই সিরিজ় হারেননি। জেতেননিও। স্টোকসদের তাঁদের ঘরের মাটিতে আটকে দিয়েছেন। ওভালে ইংল্যান্ডের প্রায় নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। সে জন্যই সিরিজ় শেষে শুভমন বলতে পেরেছেন, তাঁর দলটা লড়াকু। তাঁর ভাষায় ‘গান টিম’।

Advertisement

কোহলি, রোহিত, অশ্বিনেরা প্রাক্তন হয়েছেন। তবু শ্রেয়স আয়ারের মতো দেশের অন্যতম সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটার দলে নেই! সরফরাজ খানকেও বিবেচনা করা হয়নি। তার উপর ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে ০-৩ ব্যবধানে এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ১-৩ ব্যবধানে সিরিজ় হারের চাপ। সন্দেহ নেই, চ্যালেঞ্জটা কঠিন ছিল। বেশ কঠিন। ইংল্যান্ড টেস্ট দল হিসাবে হেলাফেলা করার মতো নয় একেবারেই। বিশ্বের অন্যতম সেরা। সেই দলের বিরুদ্ধে নিজেকে হয়তো পরীক্ষায় বসাতে চেয়েছিলেন গম্ভীর। তিনি জানতেন, ইংল্যান্ডের কাছে সিরিজ় হারলে টেস্ট দলের কোচের চাকরি খোয়াতে পারেন। ডাকাবুকো গম্ভীর চ্যালেঞ্জ নিতে চেয়েছিলেন। হয়তো অনভিজ্ঞ অধিনায়কের নেতৃত্বে তরুণ দলটাকেও আগুনে ঝলসে নিতে চেয়েছিলেন। নিষ্ঠুর পেশাদার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকার ক্ষমতা তরুণদের আছে কি না, পরখ করে নিতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি, অতীত সাফল্য আর তারকা ভাবমূর্তি ভাঙিয়ে ভারতীয় সাজঘরের ‘অটোমেটিক চয়েস’ হওয়ার প্রচলিত ধারণাও শেষ করতে চেয়েছিলেন।

গম্ভীর আসলে কী চেয়েছিলেন, তা তিনিই জানেন। তাঁর চাওয়া আর ক্রিকেটপ্রেমীদের পাওয়ার সম্পর্ক সব সময় সমান্তরাল রেখায় চলে না। ক্রিকেটপ্রেমীরা জয় ছাড়া বোঝেন না। ভারতের মতো দেশে বুঝতেই চান না। গম্ভীরের কাছে জেতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। দেশের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতা। ফল সব সময় পক্ষে না-ও আসতে পারে। তা বলে চেষ্টার খামতি তিনি মানবেন না।

নিজের ক্রিকেট দর্শন শুভমনদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গম্ভীর। তোমরা মাঠে লড়ে যাও, বাকি লড়াইটা আমি বুঝে নেব। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোচের এমন লড়ে যাওয়ার মানসিকতা ক্রিকেটারদের চাপ কমিয়ে দিতে বাধ্য। অনুশীলনের শুরুতে শুভমনেরা যখন মাঠে দৌড়ন, সঙ্গে গম্ভীরও দৌড়ন। শুভমনদের সঙ্গে নিজেও ওয়ার্মআপ করেন। তাঁর নির্দেশে নেট বোলার হয়ে যেতে হয় মর্নি মর্কেলকে! কোচ গম্ভীর অন্য ধাঁচের মানুষ। ক্রিকেটারদের জন্য লড়েন। দলের জন্য লড়েন। মৌরসিপাট্টার বিরুদ্ধে লড়েন। না হলে ওভালের দীর্ঘদেহী পিচ প্রস্তুতকারক লি ফর্টিসের সঙ্গে ওরকম মাস্তানি করতে পারতেন না।

কোচ গম্ভীর রাস্তা দেখিয়েছেন নিশ্চয়ই। মাঠে পারফর্ম করতে হয়েছে ক্রিকেটারদেরই। তাঁরা সফল হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন। উচ্ছ্বাসে মেতেছেন। হতাশায় মচকেছেন। তবু লড়াই ছাড়েননি। ভেঙে পড়েননি। ফোকাস নড়তে দেননি। দল হিসাবে লড়েছেন। ব্যাট হাতে বা বল হাতে প্রত্যেকে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করেছেন। ঋষভ পন্থ হাতের আঙুলে, পায়ের পাতায় চোট নিয়েও ব্যাট করতে নেমেছেন! তরুণ অধিনায়ক শুভমন যখন আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্কে পারেননি, তখন এগিয়ে এসেছেন লোকেশ রাহুল, রবীন্দ্র জাডেজার মতো সিনিয়র। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যতটা ব্যাট-বলের লড়াই, ততটাই মনস্তাত্ত্বিক। দুই লড়াইয়েই পাশে থেকেছেন তাঁরা।

ইংল্যান্ড সফরে ভারত যে দুটো টেস্ট জিতেছে, সেই দুটোতেই পাওয়া যায়নি বুমরাহকে। তাঁর অভাব বুঝতে দেননি মহম্মদ সিরাজ, আকাশদীপ, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণেরা। ঠিক যেমন কোহলি-রোহিতের অভাব বোঝা যায়নি শুভমন, যশস্বী জয়সওয়াল, রাহুল, পন্থ, জাডেজা, ওয়াশিংটন সুন্দরদের জন্য। যায়নি বলেই দু’বার পিছিয়ে পড়েও সিরিজ়ে সমতা ফেরাতে পেরেছেন শুভমনেরা। বিশেষ করে ওভাল টেস্ট। ড্র করারও সুযোগ ছিল না। সিরিজ় হার এড়াতে হলে জিততেই হবে। সেই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রথম ইনিংস শেষ ২২৪ রানে! এই ক্রিকেটারদেরই ২০ ওভারের ম্যাচে নামিয়ে দিলে এর চেয়ে বেশি রান তুলে দেবেন হয়তো। সেখানে টেস্টে ২২৪ রান! শুরুতেই কোণঠাসা। কিন্তু দলটা যে আত্মবিশ্বাসেও ঠাসা। ইংল্যান্ডকে প্রথম ইনিংসে ২৪৭ রানে আটকে দিয়ে ম্যাচে ফিরে আসেন শুভমনেরা। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ৩৯৬। বড় ইনিংসের ভিত গড়ে দিয়েছিল তৃতীয় উইকেটে যশস্বীর সঙ্গে নৈশপ্রহরী আকাশদীপের ১০৭ রানের জুটি। আকাশদীপের ব্যাট থেকে ৬৬! না, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও কখনও এক ইনিংসে এত রান করেননি বাংলার জোরে বোলার। তার পর রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ৩৬৭ রানে শেষ করে দেওয়া। শেষ দিন ৪ উইকেট হাতে নিয়ে ৩৫ রান তুলতে পারেননি ইংরেজরা। আসলে তুলতে দেননি সিরাজেরা। ম্যাচে তাঁর ৯ উইকেট। প্রসিদ্ধের ৮ উইকেট। টান টান উত্তেজনার ওভালে ৬ রানে জয়। ২০ ওভারের ক্রিকেটে এত কম ব্যবধানে ম্যাচের নিষ্পত্তি দেখতে অভ্যস্ত ক্রিকেটপ্রেমীরা। টেস্টে নন। তরুণ ভারতীয় দল তা-ও করে দেখাল।

টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে অভিষেক সিরিজ়ে গিলও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যাটার শুভমনের ৭৫৪ রান ছাড়াও অধিনায়ক হিসাবে পারফর্ম করেছেন। একটা টেস্টেও টস জিততে পারেননি। তাতে হতাশ হননি। বরং টস হারার ক্ষতি সামলেছেন ক্রিকেট মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। বোলার পরিবর্তন বা ফিল্ডিং সাজানোর ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রয়োজনে যথেষ্ট আগ্রাসী হয়েছেন। সীমারেখা মেনে স্টোকসদের স্লেজিংয়ের উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন কোহলি-রোহিতের পর ভুল লোককে বেছে নেওয়া হয়নি অধিনায়ক হিসাবে।

ক্রিকেটে চালু একটা কথা রয়েছে। ম্যাচ জেতায় ব্যাটারেরা, সিরিজ় বা প্রতিযোগিতা জেতায় বোলারেরা। ওভাল টেস্টটা বোলারেরাই জেতালেন। যে পাঁচ জনকে নিয়ে গম্ভীর বোলিং আক্রমণ সাজিয়েছিলেন, তাঁরাই জেতালেন। বল হাতে তো বটেই। ব্যাট হাতেও। লর্ডসে ২২ রানের হারা টেস্টেও ব্যাট হাতে নাছোড় লড়াই করেছিলেন বোলারেরাই।

ধর্তব্যের মধ্যে না থাকা যে তরুণ দল নিয়ে লন্ডনের বিমানে উঠেছিলেন গম্ভীর, সেই দলে হয়তো দেখনদারি আগুন ছিল না। তবে বারুদে ঠাসা ছিল। যে বারুদ ইংল্যান্ডের মেঘলা, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াতেও দাউদাউ করে জ্বলতে পারে। আত্মবিশ্বাসের অভাব তো ছিলই না। এই সিরিজ় সেই আত্মবিশ্বাসও অনেকটা বাড়িয়ে দেবে। শুধু জয় নয়, প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে জেতার কথা ভাববে। যে কোনও পরিস্থিতিতে, যে কোনও মাঠে জেতার জন্য লড়বে।

২০২৫ সালে ভারতীয় দলের সূচিতে বিদেশে আর টেস্ট নেই। ঘরের মাঠে টেস্ট রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ২০২৬ সালের অগস্টে শ্রীলঙ্কা এবং ডিসেম্বরে নিউ জ়িল্যান্ডে টেস্ট খেলতে যাবেন শুভমনেরা। ইংল্যান্ড সিরিজ়ের প্রতিটি টেস্ট লড়াইয়ে রপ্ত করে দিয়েছে শুভমনদের। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে পরের টেস্ট খেলতে নামবেন তাঁরা। খেলা শুরুর আগেই সমীহ আদায় করে নিতে পারবেন। কারণ স্টোকসদের ‘বাজ়বল’ ক্রিকেটের সামনে ধারাবাহিক ভাবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন তাঁরা। মনে রাখার মতো উত্তেজক টেস্ট সিরিজ় উপহার দিয়েছেন। যে সিরিজ়ে ভারত বা ইংল্যান্ড হারেনি। জিতেছে ক্রিকেট। জন্ম হয়েছে এক টেস্ট অধিনায়কের এবং তাঁর হার না-মানা দলের।

ভারতের নতুন টেস্ট দলটা গড় বয়সে পিছিয়ে থাকতে পারে। গড় অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকতে পারে। তবে ২২ গজের লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকে না। দলটা শুধু তরুণ নয়, লড়াকু। প্রথম পরীক্ষাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ। টেস্ট কোচ গম্ভীরের জিয়ন কাঠি। যে ‘গান টিম’-এর নেতা ২৫ বছরের শুভমন গিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement