লোকেশ রাহুল। ছবি: বিসিসিআই।
লোকেশ রাহুল। ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপ থেকে ভারতীয় ক্রিকেট দলে ক্রমশ গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে তাঁর। বলা যেতে পারে ঋষভ পন্থের দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে রাহুলের ক্রিকেটজীবন। বদলেছেন রাহুল নিজেও। গত দু’বছরে নিজের ব্যাটিং বদলে ফেলেছেন কর্নাটকের উইকেটরক্ষক-ব্যাটার।
এ বার আইপিএলের শুরুতে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন রাহুল। পিতৃত্ব তাঁর দায়িত্ব বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে। হয়তো স্ত্রী আথিয়া শেট্টি সন্তানসম্ভবা হওয়ার সময় থেকেই নিজেকে বদলাতে শুরু করেছেন রাহুল। ব্যক্তিগত ভাবে ধ্রুপদী ব্যাটিং পছন্দ করেন। নিজেও তেমনই ব্যাটিং করতে চান। রাহুল সেই বিরল ধরনের ব্যাটার, যিনি ব্যাটিং অর্ডারের যে কোনও জায়গায় মানিয়ে নিতে পারেন। ইনিংস শুরু বা মিডল অর্ডার বা লোয়ার মিডল অর্ডার— রাহুল সর্বত্র পরীক্ষিত, নির্ভরযোগ্য এবং সফল।
একটা সময় পর্যন্ত রাহুলকে মূলত লাল বলের ক্রিকেটের জন্য বিবেচনা করা হত। গত এক দিনের বিশ্বকাপ রাহুল সম্পর্কে সেই ধারণা বদলে দিয়েছে। লাল বলের মতো সাদা বলের বিরুদ্ধেও সমান সাবলীল তিনি। মাঠের সব দিকে শট মারতে পারেন। পেসার এবং স্পিনারদের সমান দক্ষতায় সামলাতে পারেন। রান তোলার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। উইকেটের পিছনেও দলকে নিরাপদ রাখেন।
২০২৫ সালের আইপিএলের রাহুল এবং ২০২৪ সালের আইপিএলের রাহুল এক ব্যক্তি। কিন্তু এক ব্যাটার নন। গত বছর আইপিএলে বেশ কিছু ম্যাচে ২৫০র কাছাকাছি বা বেশি রান উঠেছিল। রানের সেই বন্যা দেখেও রাহুল নিজের ক্রিকেট দর্শনে অবিচল ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘স্ট্রাইক রেট আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্ট্রাইক রেট বিষয়টাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’ পিচ আঁকড়ে বড় রানের ভাল ইনিংস তৈরিকেই অগ্রাধিকার দিতেন। সে সময় ব্যাটার রাহুলের এই মানসিকতা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আদর্শ। কিছুটা হয়তো এক দিনের ক্রিকেটের জন্যও। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য নয়। ২০ ওভারের ক্রিকেটে বলের থেকে রান বেশ কিছুটা বেশি হবে, এটাই প্রত্যাশিত। লখনউ সুপার জায়ান্টসের তৎকালীন অধিনায়ক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন না। অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক ক্রিকেটের চাহিদার দ্বন্দ্বে নিজের শিক্ষাকেই এগিয়ে রাখতেন।
রাহুল বদলে গিয়েছেন। নিজের ব্যাটিং দর্শন বদলে ফেলেছেন। নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে রাহুলের পরিবর্তনের পিছনে। ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর তাঁকে টেস্ট দল থেকেও বাদ দিয়ে দেন। রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দলের এবং পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী ব্যাট করতে পারেন না। তবে অস্ট্রেলিয়া সফরে রোহিত শর্মার অনুপস্থিতিতে ওপেন করতে নেমে রান পাওয়ায় পরিস্থিতি আবার বদলে যায়। যদিও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রাহুলকে ব্যাট করতে পাঠানো হয় পাঁচ নম্বরে। অনভ্যস্ত জায়গায় ব্যাট করেও পাঁচটি ম্যাচে ১৪০ রান করেন তিনি। সে সময় রাহুল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আমি অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট ম্যাচে ওপেন করেছিলাম। সকলেই জানে, অস্ট্রেলিয়ায় নতুন বল সামলানো কতটা কঠিন। তার পরই মিডল অর্ডারে ব্যাট করতে নামাটা একটু কঠিন হয়। আমার কোনও অভিযোগ নেই। গত চার-পাঁচ বছর ধরে সাদা বলের ক্রিকেট এ ভাবেই খেলছি। ব্যাটিং অর্ডারের উপরে বা নিচে ব্যাট করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আমাকে যেখানেই খেলতে বলা হোক, খুশি মনেই খেলি। এটা নিজের খেলাকে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে আমায়। নিচের দিকে ব্যাট করায় আগের থেকে অনেক বেশি বাউন্ডারি মারতে পারছি।’’
ভারতীয় দলে টিকে থাকার তাগিদেই নিজেকে বদলাতে হয়েছে রাহুলকে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘নতুন কিছু নয়। ২০০০ সাল থেকেই আমি পাঁচ নম্বরে ব্যাট করছি। অনেকে হয়তো ব্যাপারটা ভুলে যান। কোনও সিরিজ়ে ভাল পারফর্ম করি বা কোনও সিরিজ়ে বিশ্রাম পাই একটা প্রশ্ন ওঠেই। তা হল, আমি ব্যাটিং অর্ডারের কোথায় খেলব। সাজঘরে বসে মাঝে মাঝে ভাবি, আর কী করতে পারি? যখন যেখানে খেলতে বলা হয়েছে, সেখানেই খেলেছি। ভাল পারফর্ম করেছি। এটা রোহিতও মানে।’’
রাহুল কতটা বদলেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে এ বারের আইপিএলে। চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে ৭৭ রান এবং রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে অপরাজিত ৯৩ রানের ইনিংস খেলেছেন আগ্রাসী মেজাজে। পাঁচ বলের জন্য ক্রিজ়ে এলেও তিন থেকে চারটি বল পাঠাচ্ছেন মাঠের বাইরে। আগ্রাসী ব্যাটিং করার জন্য অবশ্য অবিবেচকের মতো শট খেলছেন না। ক্রিকেটীয় শট খেলেও দ্রুত রান করছেন। চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব ত্রুটি এবং ঝুঁকিহীন ব্যাটিং করতে। নিজের আগ্রাসী ব্যাটিং নিয়ে রাহুল বলেছেন, ‘‘ক্রিকেটজীবনের একটা পর্যায়ে এসে চার, ছয় মারার মজা হারিয়ে ফেলেছি। নিজের ব্যাটিংকে আরও আরও নিখুঁত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে সেটা আটকে গিয়েছে। আসলে ক্রিকেট খেলাটাই বদলে গিয়েছে। বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে যত বেশি সম্ভব বাউন্ডারির মারতে হয়। যারা বেশি সংখ্যক চার-ছয় মারতে পারে, তারাই জেতে।’’
রাহুল সাধারণ ভাবে মুখচোরা স্বভাবের। নিজের সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না। নিজের কাজটুকু ঠিক ভাবে করতে পারলেই খুশি হন। সাফল্যে যেমন খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হন না, তেমন ব্যর্থতায় ভেঙেও পড়েন না। দুটিকেই সহজ ভাবে নেন। ক্রিকেটজীবনে প্রতিক্রিয়ার ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করেন। সেই রাহুলই এ বার বেঙ্গালুরুর মাটিতে বিরাট কোহলিদের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে উচ্ছ্বাসে গর্জে উঠেছিলেন। বোঝাতে চেয়েছিলেন, বেঙ্গালুরুর ২২ গজে তিনিই শেষ কথা বলবেন। এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম তাঁর নিজের জায়গা।
ভারতীয় দলের প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়ার অনিশ্চয়তা। সুযোগ পেলে ব্যাটিং অর্ডারের অনিশ্চয়তা। আইপিএলে প্রয়োজনীয় আগ্রাসী ব্যাটিং করতে না পারা। সব মিলিয়ে রাহুলের ক্রিকেটজীবনই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। পন্থের দুর্ঘটনা এবং ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর সামনে। সেই সুযোগ হাতছাড়া হতে দেননি। তিন ধরনের ক্রিকেটে মানানসই ব্যাটিং করছেন। নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করছেন দেশের অন্যতম সেরা টেকনিক্যাল ব্যাটার।