গৌতম গম্ভীর (বাঁ দিকে) ও অজিত আগরকর। —ফাইল চিত্র।
শুভমন গিল, শ্রেয়স আয়ার, রিঙ্কু সিংহ, ঋষভ পন্থ, লোকেশ রাহুল, মহম্মদ সিরাজ....তালিকাটা লম্বা। মঙ্গলবার যখন সাংবাদিক বৈঠকে ভারতের প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর এশিয়া কাপের দল ঘোষণা করবেন, তখন কি এই নামগুলো শোনা যাবে? এটাই এখন প্রশ্ন। আবার একটা দল নির্বাচন করতে মাথার চুল ছিঁড়তে হতে পারে গৌতম গম্ভীরদের। কাকে নেবেন, কাকে ছাড়বেন? জায়গা তো মাত্র ১৫ জনের। অথচ লড়াইয়ে রয়েছেন অন্তত ২৪ জন। তাঁরা প্রত্যেকেই যে কোনও দলে সুযোগ পাবেন। কিন্তু ভারতের টি-টোয়েন্টি দলে এখন এত বিকল্প, গম্ভীরের কাছে বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আনন্দবাজার ডট কম খুঁজে দেখল এশিয়া কাপের দল কেমন হতে পারে। কারা সুযোগ পাবেন ১৫ জনের তালিকায়? প্রতিটা বিভাগ ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা হল, কাদের নিলে সেরা দল তৈরি করতে পারবেন গম্ভীরেরা।
ওপেনিং—
প্রথমেই নজর দলের ওপেনিংয়ে। গত দুটো সিরিজ়ে ওপেন করেছেন অভিষেক শর্মা ও সঞ্জু স্যামসন। দু’জনেই সফল। অভিষেক আইসিসি ক্রমতালিকায় বিশ্বের সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটার। সুতরাং তাঁকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই নেই। পাশাপাশি তিনি স্পিন বলটাও ভালই করেন। সঞ্জু আবার শেষ ছ’টা টি-টোয়েন্টিতে তিনটে শতরান করে ফেলেছেন। তাঁকে বাদ দেওয়ার সাহস কি দেখাতে পারবেন গম্ভীর, আগরকর? পরিস্থিতি এমন যে, যশস্বী জয়সওয়ালের মতো ওপেনারের জায়গা হচ্ছে না প্রথম একাদশে। তিনি বিকল্প ওপেনার হিসাবে ১৫ জনের দলে থাকবেন।
সঞ্জুকে আবার প্রথম একাদশে দেখছেন না বাংলার প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বললেন, “আমার দলে সঞ্জু খেলছে না। আমি ওপেনার হিসাবে অভিষেকের সঙ্গে যশস্বীকে খেলাব। যশস্বী বহু বছর ধরে দেখিয়েছে ছোট ফরম্যাটে ও কতটা বিধ্বংসী। ওকে খেলানো উচিত।”
বাংলার আর এক প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক প্রণব রায় অবশ্য কাকে দলে নেওয়া উচিত, সে বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি জানিয়েছেন, দল নির্বাচনের সময় কোন কোন দিকে খেয়াল রাখা উচিত নির্বাচকদের। তিনি বললেন, “খেয়াল রাখতে হবে কোন ক্রিকেটারের শক্তি কী। টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞদের খেলা নয়। এখানে যত বেশি অলরাউন্ডার থাকবে তত ভাল। দেখতে হবে কোনও ব্যাটার কতটা ভাল ফিল্ডার। কারণ, ফিল্ডিং অনেক সময় তফাত গড়ে দেয়। আবার প্রতিপক্ষের দিকেও নজর রাখা উচিত। কোন পিচে খেলা হবে সেটাও দেখবেন নির্বাচকেরা। সব দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নির্বাচকদের।”
মিডল অর্ডার—
এশিয়া কাপের দল নির্বাচনে গম্ভীরদের সবচেয়ে সমস্যায় ফেলবে মিডল অর্ডার। কাকে ছেড়ে কাকে খেলাবেন তাঁরা। এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টিতে ভারতের মিডল অর্ডারে খেলার যোগ্য শুভমন গিল, সাই সুদর্শন, তিলক বর্মা, সূর্যকুমার যাদব, শ্রেয়স আয়ার ও রিঙ্কু সিংহ। এমনিতে এই ছ’জনের মধ্যে সর্বাধিক তিন জনকে খেলানো যেতেই পারে। কিন্তু দু’জনের বেশি কারও সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এই ছ’জনের কেউই অলরাউন্ডার নন। টি-টোয়েন্টিতে বা বলা ভাল গম্ভীরের দলে শুধুমাত্র ব্যাটার বা বোলারের গুরুত্ব কম। অলরাউন্ডারের গুরুত্ব বেশি। গত দুটো সিরিজ়ে তিলক ও সূর্য খেলেছেন। সূর্য টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক। কয়েক দিন আগে ফিটনেস টেস্ট পাশ করেছেন তিনি। ভবিষ্যতে তিন ফরম্যাটে এক জনকেই অধিনায়ক করার পরিকল্পনা করেছেন গম্ভীর। কিন্তু এখনই তা হচ্ছে না। সুতরাং, সূর্যকুমার খেলবেনই। তিলক আবার পারফরম্যান্সের জোরে সূর্যের থেকে তিন নম্বর জায়গা ছিনিয়ে নিয়েছেন। ফলে তাঁকেও বাইরে রাখা মুশকিল।
শুভমন ভারতের টেস্ট দলের অধিনায়ক। পাশাপাশি আইপিএলে গুজরাত টাইটান্সের অধিনায়কও তিনি। গত আইপিএলে শুভমন ও তাঁর জুটি সুদর্শন দুরন্ত খেলেছেন। কমলা টুপি জিতেছেন সুদর্শন। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, দু’জনেই এই রান করেছেন ওপেন করে। ভারতের এই দলে ওপেনিংয়ে তাঁদের জায়গা নেই। ফলে মিডল অর্ডারেও তাঁদের রাখার সম্ভাবনা কম। এই পরিস্থিতিতে ১৫ জনের দলে জায়গা পাচ্ছেন না শুভমন ও সুদর্শন। গত আইপিএলে নজর কেড়েছেন শ্রেয়স। দলকে ফাইনালে তুলেছেন তিনি। তার পরেও এই দলে তিনি জায়গা পাচ্ছেন না। রিঙ্কু গত দু’বছর ভারতের ফিনিশারের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু গম্ভীর স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁর দলে কারও জায়গা নির্দিষ্ট নেই। প্রয়োজনে তা বদল হবে। গত দু’বছর আইপিএলে রিঙ্কুর ব্যাটে রান নেই। ফলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এশিয়া কাপের দল থেকেও বাদ পড়বেন রিঙ্কু।
শুভমন একটু সময় নিয়ে খেলেন। সেই দিকটা ভাবার কথাও বলেছেন প্রণব। তিনি বললেন, “শুরু থেকে সকলে চালিয়ে খেললে অনেক সময় ১০ ওভারে দল অল আউট হয়ে যেতে পারে। তাই এমন ব্যাটার দরকার যে দলকে খেলাবে। সে এক দিকে টিকে থাকবে। বাকিরা আক্রমণাত্মক খেলবে। নির্বাচকদের খেয়াল রাখতে হবে, সেরা ১৫ ক্রিকেটার বাছতে হবে। সে ক্ষেত্রে শুধু একটা দিক দেখলে হবে না। সব দিকে নজর রাখতে হবে।”
সম্বরণ তাঁর দলে শুভমন ও শ্রেয়সকে রাখছেন। তিনি বললেন, “শুভমন এখন স্বপ্নের ফর্মে আছে। হতে পারে লাল ও সাদা বলের ক্রিকেট আলাদা, কিন্তু আমার দলে ও থাকবে। ওকে আমি তিন নম্বরে খেলাব। আমার দলে শ্রেয়সও থাকবে। ওদের অভিজ্ঞতাও তো দেখতে হবে।” রিঙ্কুকে তাঁর ১৫ জনের দলে রাখলেও কলকাতা নাইট রাইডার্সের ক্রিকেটার যে তাঁর প্রথম একাদশে থাকবেন না তা জানিয়ে দিয়েছেন বাংলার শেষ রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক।
উইকেটরক্ষক—
সঞ্জু ওপেন করলে তিনিই উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলাবেন। কিন্তু দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক কে? লড়াইয়ে রয়েছেন চার জন। ঋষভ পন্থ, লোকেশ রাহুল, ধ্রুব জুরেল ও জিতেশ শর্মা। চার নামের মধ্যে অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে পিছিয়ে জিতেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম বিচার করলে সবচেয়ে এগিয়ে। গত আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে ফিনিশারের দায়িত্ব সামলেছেন। ভাল খেলেছেন তিনি। গম্ভীর টি-টোয়েন্টির দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইপিএলকে গুরুত্ব দেন। ফলে জিতেশের খেলার সম্ভাবনা বেশি। পন্থ ও জুরেল টেস্টে নিয়মিত হলেও টি-টোয়েন্টিতে নন। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শেষ খেলেছিলেন পন্থ। রাহুলও আইপিএলে টপ অর্ডারে খেলেন। মিডল অর্ডারে তাঁর জায়গা নেই।
তবে সম্বরণের দলে পন্থ খেলবেন। তিনি বললেন, “পন্থের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিজেকে ও প্রমাণ করেছে। আমার দলে ও উইকেটরক্ষক। দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক সঞ্জু।” তবে ইংল্যান্ডে পাওয়া পন্থের পায়ের চোট কতটা সেরেছে সেই বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি। ফলে তাঁর খেলার সম্ভাবনা কম।
অলরাউন্ডার—
ভারতীয় দলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। যা পরিস্থিতি তাতে চার জনের জায়গা পাকা। হার্দিক পাণ্ড্য এই দলের বড় শক্তি। তাঁর ব্যাটিং-বোলিং ভারতকে জেতায়। পাশাপাশি দ্বিতীয় পেসার অলরাউন্ডার হিসাবে রয়েছেন শিবম দুবে। নীতীশ কুমার রেড্ডি ফিট থাকলে তিনিই খেলতেন। কিন্তু নীতীশ ফিট না থাকায় শিবমের খেলা প্রায় নিশ্চিত। পাশাপাশি দুই স্পিনার অলরাউন্ডার অক্ষর পটেল ও ওয়াশিংটন সুন্দর। অক্ষর এখন দলের সহ-অধিনায়ক। তবে তিনি কতটা ফিট তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বাংলার আর এক প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, “অক্ষর কিন্তু আঙুলের চোটে আইপিএলের শেষ দুটো ম্যাচ খেলতে পারেনি। ও কতটা ফিট জানি না। তবে ফিট থাকলে অক্ষর খেলবেই। পাশাপাশি ওয়াশিংটন খেলবে। ওরা খেললে ভারতের ব্যাটিং গভীরতা বাড়বে। টি-টোয়েন্টিতে সেটা খুব দরকার।”
বিশেষজ্ঞ স্পিনার—
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মাঠে স্পিন যে কোনও দলের বড় অস্ত্র। চলতি বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ পেসার খেলিয়েছিলেন গম্ভীর। তাঁর অতিরিক্ত স্পিনার খেলানোর পরিকল্পনা কাজে লেগেছিল। এশিয়া কাপেও দু’জন বিশেষজ্ঞ স্পিনার থাকবেন। কুলদীপ যাদব ও বরুণ চক্রবর্তী। দু’জনেই রিস্ট স্পিনার। কব্জির মোচড়ে যে কোনও পিচে বল ঘোরাতে পারেন। কুলদীপ বাঁহাতি চায়নাম্যান। বরুণ ডানহাতি রহস্য স্পিনার। তবে দু’জনের একসঙ্গে খেলার সম্ভাবনা নেই। কারণ, তাঁরা ব্যাটটা পারেন না।
শরদিন্দু জানালেন, আমিরশাহিতে এখন কী রকম উইকেট থাকবে। তিনি বললেন, “একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। ওখানে এখন নতুন উইকেট। ফলে সেখানে বন বন করে বল ঘুরবে না। তাই গুচ্ছের স্পিনার মনে হয় খেলাবে না। অক্ষর ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে বরুণ ও কুলদীপের মধ্যে এক জনকে জুড়ে দেওয়া হবে।” ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার দৌড়ে রয়েছেন রবি বিশ্নোইও। তিনি গত কয়েকটা সিরিজ়ে নিয়মিত খেলেছেন। কিন্তু চার জনের বেশি স্পিনার ভারত রাখবে না। ফলে বাদ পড়তে হবে তাঁকে।
বড় নামের পিছনে ছুটতে নিষেধ করেছেন প্রণব। তাঁর কথায়, “টি২০ এমন খেলা যেখানে শুধু বড় নাম দেখলে হবে না। দেখতে হবে কার্যকরী ক্রিকেটার কারা। অনেক বোলার আছে যারা দ্রুত দু’-তিন ওভার করে দেবে। বোঝাও যাবে না কী ভাবে ওভার পেরিয়ে গেল। এই ধরনের বোলার টি২০-তে খুব দরকার।” তিনি অবশ্য আলাদা করে কারও নাম করেননি।
বিশেষজ্ঞ পেসার—
হার্দিক ও শিবম খেলায় দু’জনের বেশি পেসার প্রথম একাদশে থাকবেন না। জসপ্রীত বুমরাহ জানিয়েছেন তিনি ফিট। সুতরাং তিনি দলের প্রথম পছন্দ। গত কয়েক বছরে নতুন ও পুরনো বলে টি-টোয়েন্টি দলে নিজের জায়গা পাকা করেছেন অর্শদীপ সিংহ। ফলে তিনিও খেলবেন। তৃতীয় পেসার হিসাবে থাকবেন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ। গত আইপিএলে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি। প্রসিদ্ধের সঙ্গে লড়াই কেকেআরের হর্ষিত রানার। তবে এখন যা পরিস্থিতি তাতে প্রসিদ্ধ এগিয়ে।
ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন মহম্মদ সিরাজ। ওভাল টেস্ট জিতিয়েছেন তিনি। সেই সিরাজকেও দলের বাইরে বসতে হবে। কারণ, ছোট ফরম্যাটে বুমরাহ, অর্শদীপ, প্রসিদ্ধের থেকে পিছিয়ে তিনি। ফলে এই দলে তাঁর জায়গা হচ্ছে না। আরও এক পেসারের কথা বললেন শরদিন্দু। বাংলার আকাশদীপ। পাশপাশি শরদিন্দুর মনে হয়েছে, আকাশদীপ হয়তো পুরো ফিট নয়। তিনি বললেন, “ও তো দলীপ থেকেও নাম সরিয়ে নিয়েছে। মনে হচ্ছে এখনও পুরো ফিট নয়। না হলে ওকে ভাবা যেত। কারণ, আকাশদীপ ব্যাটটাও ভাল করে।” তবে এখন যা পরিস্থিতি তাতে এই দলে তিনি জায়গা পাবেন না।
এশিয়া কাপে ভারতের ১৫ জনের দল— অভিষেক শর্মা, সঞ্জু স্যামসন, যশস্বী জয়সওয়াল, তিলক বর্মা, সূর্যকুমার যাদব, হার্দিক পাণ্ড্য, শিবম দুবে, জিতেশ শর্মা, অক্ষর পটেল, ওয়াশিংটন সুন্দর, কুলদীপ যাদব, বরুণ চক্রবর্তী, জসপ্রীত বুমরাহ, অর্শদীপ সিংহ ও প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ।