পরাজিত নায়ক। লাহোরে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারের যন্ত্রণা নিয়ে মাঠ ছাড়ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার। ছবি: আইসিসি।
‘কিলার মিলার’!
গত কয়েক বছরে এই দু’টি শব্দই তাঁর পরিচয়। নেপথ্যে ডেভিড মিলারের খুনে ব্যাটিং। যে ব্যাটের সুইংয়ে একের পর এক বল উড়ে গিয়ে পড়ে বাউন্ডারির বাইরে। যে ব্যাটের সুইংয়ে বিধ্বস্ত হয় প্রতিপক্ষ বোলারদের আত্মবিশ্বাস। কিন্তু এর পরেও জয়ের তিলক কি সব সময় আঁকা হয় কপালে? না, হয় না। মিলারের হয়নি। গত কয়েক বছরে বার বার এই ছবি দেখা গিয়েছে। ইডেনে এক দিনের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল হোক বা বুধবার লাহোরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, ক্রিকেটের ট্র্যাজিক নায়ক হয়েই থেকে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাটার। শতরান করেও হারের দুঃখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাঁকে! বার বার।
বুধবার নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৬৩ রান তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকার একের পর এক ব্যাটার যখন সাজঘরে ফিরছেন, তখনও একা কুম্ভ হয়ে দাঁড়ালেন মিলার। একটা সময় দেখে মনে হচ্ছিল, ২৫০ রানের মধ্যে অল আউট হয়ে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করল। লড়াই করলেন একা মিলার। লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে হাজার কয়েক দর্শক চাক্ষুষ করলেন ৬৭ বলে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংস।
নিউ জ়িল্যান্ডের যে ম্যাট হেনরি, কাইল জেমিসন, উইলিয়াম ও’রোর্কদের খেলতে সমস্যা হচ্ছিল টেম্বা বাভুমা, এডেন মার্করামদের, সেই পেসারদেরই তুলে তুলে মারলেন মিলার। মাঠের কোনও দিক বাদ গেল না। হার নিশ্চিত জেনেও লড়াই ছাড়েননি। শুধু চেয়েছিলেন সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিতে। মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে। সেই প্রচেষ্টায় তিনি ১০০-য় ২০০ পাবেন। দলের নিশ্চিত হার জেনেও ১০টি চার ও চারটি ছক্কা মারা মিলারের উপর ক্রিকেট দেবতা অপ্রসন্ন থাকতে পারেননি। তাই দলের হারের কাটা ঘায়ে মলমের কাজ করেছে মিলারের শতরান।
হারের পর নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ডেভিড মিলার। ছবি: পিটিআই।
ম্যাচের শেষ বলে দু’রান নিয়ে শতরানে পৌঁছেছেন মিলার। এই শতরানের ইনিংসে বহু নজির গড়েছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে দ্রুততম শতরান এটি। সপ্তম ক্রিকেটার হিসাবে আইসিসি প্রতিযোগিতার নক আউটে দু’টি শতরান করলেন। আইসিসি প্রতিযোগিতায় ব্যাটিং তালিকায় ছয় বা তার নীচে নেমে মিলারই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি শতরান করলেন। তা-ও আবার একটি নয়, দু’টি। বিশ্বের দ্বিতীয় বয়স্কতম ক্রিকেটার হিসাবে (বয়স্কতম অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিং) আইসিসি প্রতিযোগিতার নকআউটে শতরান করলেন ৩৫ বছরের মিলার।
কিন্তু এ সব তো শুধুই পরিসংখ্যান। সেখানে লেখা থাকবে দলের হার। যা লেখা থাকবে না তা হল এক জন ক্রিকেটারের আবেগ, প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেওয়ার দুঃখ। লেখা থাকবে না মিলারের লড়াইয়ের গল্প। যে গল্পের শেষে মিলার বরাবরই এক পরাজিত যোদ্ধা। যিনি নিজের সবটা দিয়ে লড়াই করেও পরাজয়ের কাঁটা মাথায় পরে ফেরেন। মিলারই সেই নায়ক যাঁর তূণে সব অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও মেদিনী বার বার তাঁর রথচক্র গ্রাস করেছে। ফলে নামের পাশে বার বার লেখা হয়েছে পরাজয়, হার, হতাশা।
মিলারকে দেখলে বোঝার উপায় থাকে না যে তাঁর মনের মধ্যে কী চলছে। জিতলেও যেমন বিরাট কোনও উচ্ছ্বাস করেন না, হারলেও মুখের অভিব্যক্তিতে সেই যন্ত্রণা ধরা পড়ে না। অনেকটা মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো। মিলারের বাবা অ্যান্ড্রু এক বার বলেছিলেন, “ওর মুখ দেখলে বুঝতে পারি না যে শতরান করেছে, না শূন্য রানে আউট হয়েছে। আসলে সাফল্য, ব্যর্থতা দুটো বিষয়কেই জীবনের অঙ্গ ভেবে ও এগিয়ে যেতে চায়।”
কিন্তু এই মিলারও হতাশ হয়েছিলেন। এতটাই যে সাজঘরে ফেরার সময় নিজের ব্যাট দিয়ে হেলমেটে বাড়ি মেরেছিলেন। ১৬ নভেম্বর, ২০২৩। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। এক দিনের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া, যাদের কাছে আগেও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে স্টিভ ওয়ের সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন হার্শেল গিবস। স্টিভ মজা করে গিবসকে বলেছিলেন, “তুমি ক্যাচ নয়, ট্রফিটাই ফেলে দিলে।” সেই ম্যাচেই শেষ বলে অ্যালান ডোনাল্ডের ‘ব্রেনফেড’ হয়ে রান আউট হারিয়ে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ‘চোকার্স’ তকমা লেগে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গায়ে। বড় ম্যাচে যারা বার বার হেরে যায়। সেই তকমা ঘোচানোর দায়িত্ব একার কাঁধে নিয়েছিলেন মিলার। ইডেন সাক্ষী ছিল সেই ইনিংসের।
মেঘলা আবহাওয়ায় প্রথমে ব্যাট করতে নেমে একটা সময় ২৪ রানে ৪ উইকেট পড়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্ক, জশ হেজ়লউডদের সুইং ব্যাটারদের নাচাচ্ছিল। সেই অবস্থা থেকে দলের হাল ধরেছিলেন মিলার। শুরুটা কঠিন ছিল। আউট হওয়ার কয়েকটি সুযোগও দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছিল, নিজের বিধ্বংসী রূপ দেখিয়েছিলেন মিলার। ছোটবেলায় বাবার কিনে দেওয়া বেসবল ব্যাটে একের পর এক বল পেটাতেন মিলার। সেই সব বল উড়ে যেত বাবার মাথার উপর দিয়ে। ফলে একটি স্বাভাবিক ব্যাট সুইং রয়েছে তাঁর। অ্যান্ড্রু মজা করে বলেছিলেন, “যদি মিলারের আর্কে (ব্যাটের কাছে) বল পড়ে তা হলে তা পার্কের (মাঠের) বাইরে যাবে।” সেটাই দেখেছিল ইডেন। ১১৬ বলে ১০১ রান করেছিলেন মিলার। মেরেছিলেন আটটি চার ও পাঁচটি ছক্কা। অপর প্রান্তে পর পর উইকেট পড়ায় দৌড়ে রান নেওয়ার সুযোগ কমছিল। তাই সম্বল শুধু ছিল নিজের বড় শট। অপেক্ষা করেছিলেন খারাপ বলের। কিন্তু শতরানের পরে আবার একই শট মারতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন। শট মারার সময় ব্যাট থেকে একটি হাত সরে গিয়েছিল মিলারের। ফলে বেশি জোরে মারতে পারেননি। বাউন্ডারিতে বল ধরেছিলেন ট্রেভিস হেড। মিলারের সেই উইকেট থমকে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ২১৩ রান তাড়া করে ফাইনালে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া। মিলার যখন আউট হয়েছিলেন তখনও ইনিংসের ১৬টি বল বাকি। তিনি শেষ পর্যন্ত থাকলে হয়তো আরও ৩০ রান হত। সেই সময় নিজের শতরান বা ব্যক্তিগত মাইলফলকের কথা মাথায় ছিল না তাঁর। ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচাতে না পারার দুঃখ কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে। সেই কারণেই হয়তো নিজের হেলমেটে বাড়ি মেরেছিলেন মিলার।
লাহোরে শতরানের পর ডেভিড মিলার। ছবি: এএফপি।
বুধবার লাহোরে শতরানের পরও হাসি দেখা যায়নি মিলারের মুখে। এক বার ব্যাট তোলেন তিনি। মিলারকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সেটাও দর্শকদের হাততালির জবাবে তাঁকে তুলতে হয়েছে। নইলে হয়তো সেটাও করতেন না। কারণ, তখন আরও এক বার ব্যর্থতার জ্বালা তাঁর বুকে। আরও এক বার আইসিসি প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেওয়ার হতাশা তাঁর মনে। ম্যাচ শেষে নিজের হতাশা চাপতে পারেননি আপাতশান্ত মিলার। তিনি দায় চাপিয়েছেন আইসিসির সূচির ওপর। গ্রুপ পর্বে ভারত-নিউ জ়িল্যান্ড ম্যাচের উপর নির্ভর করছিল সেমিফাইনালের সূচি। তাই গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচের পর দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া দু’দলকেই দুবাই যেতে হয়েছিল। সেমিফাইনালে ভারতের সামনে অস্ট্রেলিয়া পড়ায় সেখান থেকে ফিরে আসতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এই যাতায়াতের ধকল তাঁদের শরীরের উপর প্রভাব ফেলেছিল বলে জানিয়েছেন মিলার।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বিদায় নেওয়ার পর মিলার বলেন, “এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের বিমানযাত্রা ছিল। শনিবার আমাদের খেলা ছিল। তার পর দিন দুবাই যেতে হয়েছিল। রবিবার বিকাল ৪টেয় ওখানে পৌঁছেছিলাম। আবার সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় ওখান থেকে রওনা দিতে হয়েছিল। সেমিফাইনালের আগে দু’বার বিমানযাত্রা করতে হয়েছিল। ফলে আগের ম্যাচের ধকল কাটিয়ে পরের ম্যাচের জন্য তৈরি হওয়ার সময় সে রকম পাইনি। এতে আমাদের সমস্যা হয়েছে। আইসিসির এটা ভাবা উচিত ছিল।” তিনি যে রকম ক্রিকেটার তাতে কারও উপর খুব একটা দোষ চাপান না। কিন্তু বার বার হারতে হারতে তিনিও মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মিলারই একমাত্র ব্যাটার যিনি আইসিসি প্রতিযোগিতার নকআউটে দু’টি শতরান করেও দলকে জেতাতে পারেননি। হারের জ্বালা সহ্য করতে হয়েছে। শুধুই কি এই জোড়া শতরান? না। দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস কম খেলেননি তিনি। কিন্তু কোনও বারই জিততে পারেননি। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬৩ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। সেখান থেকে ৫১ বলে অপরাজিত ৫৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মিলার। দলকে কোনও রকমে ১৭৬ রান পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড সহজেই সেই ম্যাচ জিতেছিল। ২০১৫ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মাত্র ১৮ বলে ৪৯ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেছিলেন মিলার। তার পরেও ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে ম্যাচ জিতেছিল নিউ জ়িল্যান্ড। সেই নিউ জ়িল্যান্ডের কাছেই আরও এক বার স্বপ্নভঙ্গ হল মিলার তথা দক্ষিণ আফ্রিকার।
গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে মিলারের কাছে সুযোগ ছিল নায়ক হয়ে ওঠার। ম্যাচের শেষ দিকে ভারতীয় বোলারদের দাপটে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার একের পর এক উইকেট পড়ছে তখনও মিলার ক্রিজ়ে ছিলেন। তিনি জানতেন, ম্যাচ জিততে হলে শেষ পর্যন্ত খেলতে হবে তাঁকে। যত ক্ষণ মিলার ছিলেন তত ক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা শিবির। তাঁর উপর ভরসা ছিল দলের। শেষ ওভারে জিততে দরকার ছিল ১৬ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন মিলার। হার্দিক পাণ্ড্য প্রথম বলটি ফুলটস করেন। সোজা বোলারের মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে দেন মিলার। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল, বল গিয়ে পড়বে গ্যালারিতে। কিন্তু হয়নি। বাউন্ডারির বাইরে যাওয়ার আগেই ক্রিকেট রূপকথায় জায়গা করে নেওয়া সেই ক্যাচ নিয়েছিলেন সূর্যকুমার যাদব। হতাশ হয়ে ক্রিজ়েই কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েছিলেন মিলার। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জায়ান্ট স্ক্রিনে বার বার রিপ্লে দেখছিলেন। একটাই আশায়। সূর্যের পা কোনও ভাবে বাউন্ডারির দড়িতে যদি লেগে যায়! লাগেনি। ফিরতে হয়েছিল মিলারকে। হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। মিলারের সেই বলটি যদি ছক্কা হত তা হলে হয়তো মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে ট্রফি নিয়ে উৎসব করা হত না রোহিত শর্মার দলের। তা হয়নি। এ বারও হল না। আরও এক বার শেষ মুহূর্তে মেদিনী গ্রাস করল মিলারের রথের চাকা। আরও এক বার পরাজিত বীরের তকমা পেলেন তিনি। আরও এক বার হারের কাঁটা মাথায় পরে ফিরতে হচ্ছে মিলারকে।
২০১৩, ২০১৫, ২০২৩, ২০২৪, ২০২৫। শুধু বছর বদলেছে। প্রতিযোগিতা বদলেছে। প্রতিপক্ষ বদলেছে। বদলায়নি পরিস্থিতি। বদলায়নি মিলারের একার কাঁধে দলকে টানার লড়াই। বদলায়নি খেলার ফল। আর বদলায়নি মিলারের ট্র্যাজিক নায়ক থেকে যাওয়া। যেখানে ভাল ইনিংস খেলেও আনন্দ নেই। শতরান করেও উচ্ছ্বাস নেই। আছে শুধু হারের যন্ত্রণা। বার বার।