অবিশ্বাস্য। র্যান্টির ফ্রি-কিক থেকে ২-০ হতে দিলেন না বাগান গোলকিপার।
উনচল্লিশ বছর আগের দুঃখের স্মৃতি মোহনবাগানে ফিরে আসতেই পারত।
১৯৭৭-এর ৯ জুলাই দিনটার হতাশা আর আফশোস ফিরতে পারত ২০১৬-র ২৩ জানুয়ারি।
ফিরতে দিলেন না উত্তরপাড়ার দেবজিৎ মজুমদার। র্যান্টি মার্টিন্সের নিখুঁত ফ্রি কিক আটকে দিয়ে মোহনবাগানকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন তার গোলকিপার। যা উনচল্লিশ বছর আগে পারেননি সে দিনের সবুজ-মেরুন কিপার বিশ্বজিৎ দাস।
অথচ শনিবাসরীয় ডার্বির মঞ্চটা একটা সময় হয়ে গিয়েছিল একেবারে সেই সাতাত্তরের শনিবারের কপি বুক!
সে বার সুব্রত-সুভাষ-হাবিব-আকবর-শ্যাম-গৌতম-প্রসূনসমৃদ্ধ বাগানের সামনে আন্ডারডগ ছিল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচের আগের দিন ক্লাবের গ্যালারিতে সবুজ আবির মেখে আগাম উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল মোহনবাগানে। কিন্তু ম্যাচের ফল হয়েছিল উল্টো। মিহির বসুর হাফভলির গোলের পর সমরেশ চৌধুরীর ফ্রি কিকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোষ্ঠপাল সরণির উপর দাঁড়িয়ে থাকা তাঁবু। নেমে এসেছিল নিকষ অন্ধকার।
এ বারও ডার্বির আগাম আবহ ঠিক ওই রকম ছিল। মোহনবাগান ছিল হট ফেভারিট। সনি-গ্লেন-কাতসুমি-প্রণয়দের বলা হচ্ছিল অশ্বমেধের ঘোড়া। প্রাক্তন ফুটবলারদের র্যান্ডম ভোট পড়েছিল সঞ্জয় সেনের টিমের দিকেই। ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলনে লাল-হলুদ কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যকে শুনতে হয়েছে, সনিদের আটকানোর মতো ডিফেন্স আপনার দলের আছে?
শনিবার ইস্টবেঙ্গলকে ১-০ এগিয়ে দেওয়ার পরে যখন ফ্রি কিক মারতে যাচ্ছিলেন র্যান্টি, তখন দমদম পার্কের বাড়িতে নাকি টেনশনে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন উনচল্লিশ বছর আগের ডার্বিতে বাগানে অন্ধকার নামিয়ে দেওয়ার নায়ক। ‘‘বিশ্বাস করুন র্যান্টি যখন ফ্রি কিকটা মারার জন্য তৈরি হচ্ছিল, আমার তখন মনে পড়ছিল সাতাত্তরের কথা। নিশ্চিত ছিলাম, আজ আবার হবে। আবার! কেমন যেন একটা অদ্ভুত উত্তেজনা হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। কিন্তু র্যান্টি বলটা ভুল জায়গায় রাখল। গোলকিপারের ঘাড় সমান বল কেউ রাখে ফ্রি কিকে? আমি কিন্তু এমন ভাবে মেপে বলটা রেখেছিলাম যে, সে দিনের ম্যাচে ওদের গোলকিপার বিশ্বজিৎ যাতে কোনও মতে নাগাল না পায়,’’ শনিবার রাতে ফোনে স্মৃতি রোমন্থনের সময়েও সমরেশ ওরফে পিন্টু চৌধুরী উত্তেজিত। ‘‘আরে ব্যাটা, এটাও জানস না যে, ওই জায়গায় ফ্রি কিক মারতে গেলে বলটা কিপারের নাগালের বাইরে রাখতে হয়!’’
বিশ্বাসই হচ্ছে না র্যান্টির। -শঙ্কর নাগ দাস
মাত্র মাসখানেক আগেও যাঁকে ছেঁটে ফেলার কথা ভাবা হচ্ছিল, প্রায় রোজই যাঁর সঙ্গে খটাখটি লাগত কোচের, সেই র্যান্টি এ দিন ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিয়ে বড় ম্যাচের সেরা হলেন বটে, কিন্তু নায়কের মর্যাদা পেলেন কই? সনি-কর্নেল যুগলবন্দির এক মুহূর্তের দুর্দান্ত মুভ লাল-হলুদ কর্তা-সমর্থকদের আফসোসের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেল।
যুবভারতীর গ্যালারিতে এ দিন প্রায় পঁয়ষট্টি হাজার দর্শক ছিলেন। কিন্তু তাঁরা যে ফুটবল দেখলেন তা সতর্কতার চাদরে মোড়া। চূড়ান্ত হিসেবি ফুটবল। বিপক্ষের উইং প্লে রোখো, অ্যাটাকিং থার্ডে পায়ের জঙ্গল তৈরি করো, মাঝমাঠে বল আটকাতে পা চালাও ইচ্ছে মতো— এগুলোই ছিল দুই প্রধানের কোচের স্ট্র্যাটেজি।
আই লিগের তিন নম্বর ম্যাচ। ট্রফি জেতার লম্বা হাইওয়ে পড়ে রয়েছে সামনে। এই স্ট্র্যাটেজি স্বাভাবিক। তাতে দর্শকরা আনন্দ না পান, বয়েই গেল সঞ্জয়-বিশ্বজিতের। চাকরি বাজি রেখে কেনই বা সমর্থক-মনোরঞ্জনের রাস্তায় হাঁটবেন পেশাদার কোচ? কিন্তু ড্র ম্যাচে লাভ হল কার, সেই প্রশ্নও কিন্তু থেকে গেল। বাগান কোচ সঞ্জয় সেনের দাবি, ‘‘লাভ আমাদেরই। ওদের চেয়ে আমরা দু’পয়েন্টে এগিয়ে রইলাম।’’ আর ইস্টবেঙ্গল কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের সরস মন্তব্য, ‘‘আগে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলুক ওরা, তখন বুঝবে!’’
ড্র ম্যাচেও অবশ্য গ্যালারি আলোকিত হল দু’বার। লাল-হলুদ গ্যালারিতে মশাল জ্বলে ওঠার চোদ্দো মিনিট পর সবুজ-মেরুনে তুবড়ির ছটা। ভিভিআইপি বক্সে বসে থাকা সনি নর্ডি আর ডংয়ের বান্ধবীরাও দু’বার লাফানোর সুযোগ পেলেন। সবই র্যান্টি আর গ্লেনের সৌজন্যে। দুই বিদেশির দু’টো গোলই মগজাস্ত্রের সফল প্রয়োগের ফসল। মনে রাখার মতো।
পাশাপাশি বহু বছর পর কলকাতা ডার্বিতে বঙ্গসন্তানদের আস্ফালন দেখা গেল। বালি, বেহালা, সোদপুর ব্যারাকপুরের মতো শহরতলি বা গাঁ গঞ্জের ফুটবলারের সংখ্যাটা ছিল দু’টো দলে পঞ্চাশ শতাংশ। প্রথম বাইশের মধ্যে এগারো। কৃশানু-বিকাশ জমানা চলে যাওয়ার পর কখনও এ রকম হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। এ দিনের ডার্বির বঙ্গসন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র মেহতাব হোসেন বলছিলেন, ‘‘আমি চোদ্দো বছর খেলছি। কখনও ডার্বিতে এত বাংলার ছেলে দেখিনি দু’টিমে।’’
গোল করার জন্য বিদেশিদের উপর আলো পড়লেও বাংলার ফুটবলাররা গণ-ফ্লপ করেননি। বালির দেবজিৎ মজুমদার বাগানকে বাঁচিয়েছেন। কর্নেল-সনিকে আক্রমণের ঢেউ তোলার প্রায় সুযোগই দেননি বেহালার অর্ণব মণ্ডল বা হিন্দমোটরের সৌমিক দে। মাঝমাঠে বিপক্ষের আক্রমণ সামাল দিতে কোবরা ট্যাকল ফিরেছে দু’দলের মেহতাব আর প্রণয় হালদারের পায়ে। যে ট্যাকলে এক সময় বিখ্যাত ছিলেন কৃষ্ণেন্দু রায়রা। নিউ ব্যারাকপুরের প্রণয়ের এটাই প্রথম ডার্বি। তাতেও কাঁপেননি। ‘নতুনের জয়গান গাও’-এর তালিকায় অবশ্য আরও দু’টো ছেলের নাম করতে হবে। ইস্টবেঙ্গলের বিকাশ জাইরু আর রাহুল ভেকে। সনির মতো বল প্লেয়ারকে সিকিম-মুম্বই জুটি যে ভাবে সামলেছেন তাতে এই ভারতীয় ফুটবলারদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে।
ম্যাচের পর সঞ্জয় এবং বিশ্বজিতকে দেখা গেল একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতে। ‘হারব না ভাই হারব না’ স্ট্র্যাটেজি সফল হওয়ার পর দু’জনের চোখেমুখেই স্বস্তি। দুই বঙ্গসন্তান কোচ-ই তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ম্যাচ থেকে কী ভাল করলাম খোঁজার চেষ্টায় মিডিয়ার সামনে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দু’দলের সদস্য-সমর্থকদের মুখে অবশ্য জিততে না পারার হা-হুতাশ।
দিনের শেষে সেটাই যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিল শনিবার যুবভারতীতে হয়ে গেল ইস্ট-মোহন ডার্বি!
বিশ্বাসই হচ্ছে না র্যান্টির। -শঙ্কর নাগ দাস
আমাদের টিমকে যাঁরা ছোট করেছিলেন, তাঁদের ধন্যবাদ। মুড়ি আর মিছরি যে এক নয় সেটা মাঠে প্রমাণ হল। ইস্টবেঙ্গল টিমকে কখনও ছোট করে দেখবেন না। তিন পয়েন্ট এল না এটাই আক্ষেপ!
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য
জিততে না পারলে হেরে ফিরিস না। ছেলেদের সেটা পইপই করে বলেছিলাম। তাই এক পয়েন্ট অবশ্যই প্রাপ্তি। তবে গোল খেয়ে শেষের দিকে আমরা যে ইস্টবেঙ্গলের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলাম সেটাও আমাদের পজিটিভ।
সঞ্জয় সেন