জেলে পাঠানোর হুমকি

সমলিঙ্গে সম্পর্ক, পরিবারেই এখন একঘরে দ্যুতি চন্দ

কেন এত দিন এই সম্পর্ক ঘোষণা করেননি? দ্যুতি বলেন, ‘‘খুব ভয় করত। তা ছাড়া ও তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, সমলিঙ্গের সম্পর্ক কোনও অপরাধ নয়। তার পরেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের এই সম্পর্কের কথা জানাই।’’

Advertisement

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৯ ০৪:২৮
Share:

অকপট: বান্ধবীকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চান দ্যুতি।

ফের সংবাদ শিরোনামে দ্যুতি চন্দ। রবিবার ভারতের দ্রুততম এই মহিলা অ্যাথলিট নজিরবিহীন ভাবে জানিয়ে দিলেন, গত তিন বছর ধরে এক তরুণীর সঙ্গে সমলিঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে তাঁর। সেই সম্পর্কের দরুন নিজের পরিবার তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়। কিন্তু বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও এই সম্পর্ক ভাঙতে চান না দ্যুতি। সেই তরুণীকেই যে তিনি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চান, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন দেশের এই প্রথম সারির অ্যাথলিট। দ্যুতিই ভারতের প্রথম ক্রীড়াবিদ, যিনি সমলিঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন।

Advertisement

গত মাসেই দোহায় এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ১০০ মিটারে নিজের জাতীয় রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছেন ২৩ বছর বয়সি দ্যুতি। ২০০ মিটারে ফিরেছেন ব্রোঞ্জ নিয়ে। জুনে বিশ্ববিদ্যালয় গেমসে নামবেন বলে হায়দরাবাদে প্রস্তুতি চালাচ্ছেন দ্যুতি। রবিবার সেখান থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘ওই তরুণীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তিন বছরের। ওড়িশার জাজপুরে আমার গ্রামেই ওর বাড়ি। পারিবারিক দিক থেকে আত্মীয়তাও রয়েছে। ভুবনেশ্বরের একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে ও।’’

যদিও আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই তরুণীর নাম করেননি দ্যুতি। তবে কী ভাবে এই সম্পর্কের সূচনা, তা জানিয়েছেন বিস্তারিত ভাবে। দ্যুতির কথায়, ‘‘আমার গুণমুগ্ধ ছিল ও। প্রথমে প্রস্তাব দিয়ে ও বলেছিল, আমার সঙ্গে সারা জীবন থাকতে চায়। আমি তখন ওর বাবা-মায়ের মত জানতে চেয়েছিলাম। তাঁরা মত দেওয়ার পরে ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।’’

Advertisement

কেন এত দিন এই সম্পর্ক ঘোষণা করেননি? দ্যুতি বলেন, ‘‘খুব ভয় করত। তা ছাড়া ও তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। গত বছর সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, সমলিঙ্গের সম্পর্ক কোনও অপরাধ নয়। তার পরেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের এই সম্পর্কের কথা জানাই।’’ যোগ করেন, ‘‘আমরা দু’জনকে খুব বেশি সময় দিতে পারি না। জাতীয় শিবির, প্রতিযোগিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকি বলে। তবে ওড়িশা ফিরলে আমরা একসঙ্গে সময় কাটাই। ঘুরতেও যাই। দেশে-বিদেশে প্রতিযোগিতায় নামলে ও আমার সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে। এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আগামী দিনে ঘর বাঁধার ইচ্ছেও আছে ওর সঙ্গে,’’ বললেন দ্যুতি।

এই সম্পর্ক ঘিরে তাঁর পরিবারে যে অশান্তিও রয়েছে, তা গোপন করেননি দ্যুতি। বললেন, ‘‘আমার দিদি সরস্বতী এই সম্পর্কের বিরোধী। আসলে উনি খুব জটিল মানসিকতার মহিলা। আমার দাদা রবীন্দ্রের স্ত্রী ওঁর খারাপ ব্যবহারের জন্যই বাড়ি ছেড়েছে। এখন দিদি আমাকে বলছেন, এই সমলিঙ্গ সম্পর্ক রাখলে আমি ঘরে ঢুকতে পারব না। বাবা-মা আগে আমার পাশেই ছিলেন। যে-বাড়িতে দিদি ঢুকতে দিতে চাইছেন না, তা আমার অর্থে তৈরি। বাবা-মা আজ স্বাচ্ছন্দের জীবন পেয়েছেন আমার জন্যই। আর সেই বাড়ি, বাবা-মায়ের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে দিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন নিজের দিদি! আমাকে একঘরে করছেন। কিন্তু আমি এই সম্পর্ক ভাঙব না।’’ সেই সঙ্গে দ্যুতি জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘আপনাদের বাংলার অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিক এর আগে নিজের সম্পর্ক জানাতে চাননি। তাই পরবর্তী কালে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করে বিপদে ফেলা হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কে যাতে সেই সমস্যা না-আসে, তাই এই সমলিঙ্গের সম্পর্ক গোটা দেশকে জানিয়েছি।’’

দ্যুতির এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে পিঙ্কি বলছেন, ‘‘দ্যুতি নিজের ভাল লাগা, ভালবাসার কথা প্রকাশ্যে জানানোর সাহস দেখানোয় অভিনন্দন। কিন্তু আমার জীবনে যে-মহিলার কথা ও উল্লেখ করেছে, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না। সে আমার বাড়িতে আশ্রয় চেয়েছিল। তার পরে সুযোগ বুঝে আমাকে ফাঁসানোর মতলব আঁটে।’’

সম্পর্কের কথা জানিয়ে দ্যুতি মাঠে কোনও সমস্যায় পড়তে পারে কি না, তা জানতে চাওয়া হলে ক্রীড়া-অধিকার কর্মী পয়োষ্ণী মিত্র জানিয়ে দিয়েছেন, সমস্যার প্রশ্ন নেই। লন্ডনের বাসিন্দা এই বঙ্গকন্যা এর আগে লোজ়ানের ক্রীড়া আদালতে দ্যুতির হয়ে লড়ে তাঁকে জিতিয়েছিলেন। তিনি বলছেন, ‘‘নিজের ভালবাসার কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে অন্যদেরও সাহস দিয়েছে দ্যুতি। মাঠে নামতে ওর সমস্যা হবে কেন? গোটা বিশ্বে এই ধরনের ঘটনা প্রচুর। টেস্টোস্টেরন ওর শরীরে বেশি থাকলেও ১০০ ও ২০০ মিটারে নামার অধিকার ওকে দিয়েছে লোজ়ানের ক্রীড়া আদালত। ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কাজেই মাঠে ওর কোনও সমস্যাই নেই।’’ সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ও বলছেন, ‘‘ক্রীড়াজগতে এই সিদ্ধান্ত দুঃসাহসিক। ওর এই ঘোষণাকে সম্মান করছি।’’

গত দেড় দশক ধরে সমকামী-রূপান্তরকামীদের আইনি অধিকার নিয়ে লড়ছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত। তিনিও বলছেন, ‘‘৩৭৭ ধারায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সমলিঙ্গের কোনও সম্পর্কে আইনগত ভাবে বাধা নেই। আসল সমস্যা সমাজের মনে। বিষয়টি নিয়ে কেউ বাধা দিলে বা অশান্তি করলে সে বেআইনি কাজ করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন