ইস্টবেঙ্গল জিততে পারত, হারতেও

ইস্টবেঙ্গল টিম বাসের সামনে ম্যাচের পর শোনা গেল তীব্র তর্ক যুদ্ধে মেতেছেন দু’দল মশালধারী। এক পক্ষের দাবি, ‘ম্যাচটা জিততে পারতাম’, অন্য পক্ষের মন্তব্য ‘অভিজিৎ গোলে না থাকলে হেরে যেতাম।’ এলকো সতৌরির পাশে বসে ছিলেন র‌্যান্টি মার্টিন্স। প্রাক্তন কোচ আর্মান্দো কোলাসোকে ঠেস দিয়ে যাঁর মুখ থেকে বেরিয়েছে, “টিমটার মধ্যে আগে শৃঙ্খলা ছিল না। এখন সেটা ফিরেছে। তাই গোল পাচ্ছি।”

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

ইস্টবেঙ্গল তখন পিছিয়ে। মাঠেই কাগজ-পেন নিয়ে স্ট্র্যাটেজি বদলাতে বসে গেলেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। যার কিছু পরেই সমতা ফিরল র‌্যান্টির গোলে।

কিটচি (হংকং) ১ : ইস্টবেঙ্গল ১ (হুয়ান) (র‌্যান্টি)

Advertisement

ইস্টবেঙ্গল টিম বাসের সামনে ম্যাচের পর শোনা গেল তীব্র তর্ক যুদ্ধে মেতেছেন দু’দল মশালধারী।

Advertisement

এক পক্ষের দাবি, ‘ম্যাচটা জিততে পারতাম’, অন্য পক্ষের মন্তব্য ‘অভিজিৎ গোলে না থাকলে হেরে যেতাম।’

এলকো সতৌরির পাশে বসে ছিলেন র‌্যান্টি মার্টিন্স। প্রাক্তন কোচ আর্মান্দো কোলাসোকে ঠেস দিয়ে যাঁর মুখ থেকে বেরিয়েছে, “টিমটার মধ্যে আগে শৃঙ্খলা ছিল না। এখন সেটা ফিরেছে। তাই গোল পাচ্ছি।” এএফসি এবং আই লিগ—নয় ম্যাচে বারো গোল করে ফেললেন নাইজিরিয়ান গোল মেশিন। মরসুমের শুরুতে মরচে ধরা সেই মেশিনের এখনকার ‘উৎপাদন’ দেখে সত্যিই চমকে যেতে হয়। মনে হয়, সবুরে সত্যিই মেওয়া ফলে!

পেটে ব্যথা নিয়েও দলের স্ট্রাইকারের কথা শুনে বেরিয়ে আসা হাসিটা অনেক কষ্টে লুকোলেন লাল-হলুদের ডাচ কোচ। সেটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই প্রশ্ন হল, অভিজিৎ গোলগুলো না বাঁচালে ড্র-ও তো করতে পারতেন না? মেনে নিলেন এলকো। “এটা সত্যি। হ্যাঁ, আমাদের কিপার কয়েকটা দুর্দান্ত সেভ করেছে।”

আসলে চৌম্বকে মঙ্গলসন্ধ্যার এই ম্যাচটার নির্যাস— আন্তর্জাতিক ম্যাচটা ইস্টবেঙ্গল জিততেও পারত, হারতেও।

‘হংকংয়ের বার্সা’ বলে সে দেশে ডাকা হয় কিটচি এফ সি-কে। এ দিন হোসে মোলিনার দলকে দেখে মনে পড়ছিল চার বছর আগের স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের সময়ের কথা। সোশ্যাল নেটওয়াকির্ং সাইটে লাল-হলুদের অত্যুৎসাহী সমর্থকরা তখন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে স্পেনকে মিলিয়েছিলেন—জার্সির রং এক বলে। কিটচির সমর্থকরাও অত্যুৎসাহী হয়ে নিজেদের টিমকে বার্সেলোনার সঙ্গে তুলনা করে বসে আছেন। স্প্যানিশ কোচের হাতে পড়ে টিমটা প্রচুর পাস খেলা শিখেছে ঠিকই বার্সেলোনাকে আদর্শ করে। তবে তাঁদের দলে একজন এমন ফুটবলারও নেই যিনি জাভি, ইনিয়েস্তার একশো মাইলের মধ্যে থাকতে পারেন।

কুয়েত এফ সি, সেমেন পাদাং, ইয়াঙ্গন ইউনাইটেড --এ এফ সি কাপে বহু ভাল ক্লাবের সঙ্গে খেলেছে ইস্টবেঙ্গল। ক্যানসারজয়ী বিশ্বকাপার কোচের কিটচি তাদের তুলনায় অতি সাধারণ মানের। তাই ম্যাচের আগে তাদের নিয়ে যত গর্জন হয়েছিল তত বর্ষন হল না।

আগের দিন রাত থেকেই পেটে ব্যথা শুরু হওয়ায় সকালেই হাসপাতালে ছুটেছিলেন এলকো। গল ব্লাডারে স্টোন ধরা পড়েছে তাঁর। সঙ্গে নাকি আরও অনেক রোগ। ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্তও হাসপাতালে ছিলেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। সে জন্যই সম্ভবত ম্যাচের সময় মাঝেমধ্যে হাঁট গেড়ে বসেও পড়ছিলেন টেকনিক্যাল জোনে। টিম নামানোর সময় অবশ্য কোনও ঝুঁকি নেননি তিনি। আলট্রা ডিফেন্সিভ ফুটবল যাঁকে বলে, সেটাই আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি। সুযোগ পেলেই পাল্টা আক্রমণে যচ্ছিলেন ডুডু-র‌্যান্টিরা। ৪-৪-২ ফর্মেশনে নামলেও লাল-হলুদ জার্সি কার্যত ষাট মিনিট খেলল ৫-৫ ফর্মেশনে।

ফানেলের মতো ফর্মেশন তৈরি করে, মাঠ ছোট করে হংকংয়ের ঐতিহ্যশালী টিমকে থামাতে চেয়েছিলেন সুসাক-রাজুরা। কিন্তু পাল্টা স্ট্র্যাটেজিতে তাদের নাড়িয়ে দিচ্ছিল কিটচি। উইং ব্যবহার করে মাঠ বড় করে তারা সফলও হল একটা সময়। কিটচির স্প্যানিশ স্ট্রাইকার হুয়ান যখন হেডে গোলটা করলেন তখন পুরো ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ স্থবির। সিনেমাহলের দর্শক। হংকং প্রিমিয়ার লিগে একশো শতাংশেরও বেশি সাফল্য আছে হুয়ানের। ১৮ ম্যাচে গোল করেছেন ২০টি। সেই অর্থে তারকা না হলেও এ দিন হ্যাটট্রিক করতে পারতেন তিনি। সুসাক-মেহতাবদের সামনে হুয়ানের দাপাদাপি দেখে মনে হচ্ছিল মালয়েশিয়ার আগের ম্যাচের ফলের না পুনরাবৃত্তি হয়! চোট সারিয়ে ফেরা লাল-হলুদ কিপার অভিজিৎ মণ্ডল তা হতে দেননি শেষ পর্যন্ত। ওই সময় জর্ডির আগুনে শট পোস্টে লেগে না ফিরলে ম্যাচের ফল কিন্তু অন্য রকম হতেই পারত।

শুরুতেই র‌্যান্টির ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায় সুযোগ নষ্টের পর ইস্টবেঙ্গল টিমটা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল। ভুল পাস, ব্যাক পাস আর বল উড়িয়ে দেওয়ার এক মারণ খেলায় যেন হঠাৎ নেমে পড়েছিলেন তুলুঙ্গা-আব্রাঞ্চেজরা। বহু বছর পর যদি কোনও ফুটবল-ইতিহাসবিদ এই ম্যাচটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসেন তবে তাঁর জন্য একটা চমকপ্রদ তথ্য দেওয়া যেতেই পারে। তা হল, ইস্টবেঙ্গল প্রথম কর্নার পায় আটান্ন মিনিটে। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি পর্যন্ত যে-টিমটা ছিল স্রেফ রুগ্ন—কোন জাদুকাঠিতে তা সজীব হল ম্যাচের শেষ দিকে?

ইস্টবেঙ্গল কোচ দাবি করলেন, “আমি জানতাম কোনাকুনি বল তুললেই ওদের রক্ষণ ভেঙে পড়বে। বিরতিতে সেটা বলে দিয়েছিলাম।” এলকোর মন্তব্যকে অতিশয়োক্তি বলে মনে হচ্ছে না। তবে সঙ্গে আরও কয়েকটা শব্দ জুড়তে হচ্ছে। টিমটার মধ্যে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎই হাজির হয়েছিল জেদ। অদম্য ইচ্ছাশক্তি। যা না থাকলে কোচের স্ট্র্যাটেজি মাঠে মারা যেত। তবে ডুডু-র‌্যান্টির যুগলবন্দিতে ইস্টবেঙ্গল ১-১ করার পর লাল-হলুদ জার্সিকে বেশ ঝকঝকে লাগল। তীব্র চাপে কিটচি তখন দিশাহারা। র‌্যান্টির শট গোললাইন থেকে ফেরালেন হংকং-এর ডিফেন্ডার ও অধিনায়ক লো। হা-হুতাশ নেমে আসে গ্যালারিতে।

প্রথম একাদশের চার ফুটবলার জাতীয় দলে। দলের ফিটনেস লেভেল বেশ খারাপ। কোচ বদল হয়েছে মাঝপথে। ক্লাবে আরও নানা ডামাডোল। তা সত্ত্বেও এ দিনের পিছিয়ে থেকেও সমতায় ফেরা-- বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের পরম্পরা রক্ষার সোনালি ফিতেতে হয়তো তেমন গুরুত্ব পাবে না। তবে এটা লেখা যেতেই পারে, এই এক পয়েন্ট অনেকখানি আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনবেই ইস্টবেঙ্গলে। অন্তত আই লিগের জন্য।

প্রিয় টিমের সেই আত্মবিশ্বাস আর শৃঙ্খলা ফিরে আসা দেখতে এ দিন মাঠে কত দর্শক এসেছিলেন? মাত্র তিন হাজার। টিকিট বিক্রি হয়েছে বারো হাজার টাকার। ভাবা যায়!

‘জাগো গ্রাহক জাগো’র মতো ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের এ বার হয়তো বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় হয়ে গেল—‘জাগো লাল-হলুদ জাগো’!

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, দীপক, রাজু, সুসাক, রবার্ট, তুলুঙ্গা (বার্তোস), মেহতাব (সুখবিন্দার), রফিক, জোয়াকিম (বলজিৎ), ডুডু, র‌্যান্টি।

ছবি: উৎপল সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন