হ্যারি কেন ও ক্যাসপার ডোলবার্গ
ইউক্রেনকে ৪-০ চূর্ণ করে ২৫ বছর পরে ইউরোর শেষ চারে ইংল্যান্ড ওঠার পরে দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। মনে বলছিল, এত দিনের অপেক্ষার অবসান এ বার হবে। কিন্তু সময় যত এগোচ্ছে, রক্তচাপও বাড়ছে।
১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে সব প্রতিযোগিতাতেই আমরা স্বপ্ন দেখতাম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। ৫৫ বছর ধরে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাতেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। ১৯৯৬ সালের ইউরো-তেও ইংল্যান্ডকে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দুর্দান্ত ছন্দে ছিল পল গ্যাসকোয়েন, অ্যালান শিয়ারার-রা। ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে ওঠার পরে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এ বার ট্রফি আসছেই। উৎসবের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি তখন লন্ডনেই থাকতাম। সেমিফাইনালে গ্যারেথ সাউথগেট টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ হওয়ায় জার্মানির বিরুদ্ধে হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এই কারণেই খুব একটা স্বস্তিতে নেই আমি। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়, আমার মতো ইংল্যান্ডের অধিকাংশ সমর্থকেরই এখন সে রকম অবস্থা।
ফিফা ক্রমতালিকায় ইংল্যান্ড চতুর্থ স্থানে। ডেনমার্ক রয়েছে দশ নম্বরে। কেউ কেউ বলছেন, জার্মানির মতো দলকে যখন হারিয়ে দিয়েছে হ্যারি কেন-রা, তখন ডেনমার্ককে নিয়ে চিন্তা করার কারণই নেই। ওয়েেম্বলিতে প্রতিপক্ষকে চূর্ণ করে ফাইনালে উঠবে ইংল্যান্ড। আমি এই যুক্তি মানি না। এই ইউরোয় ডেনমার্কের ফুটবলারেরা খেলছে আবেগ দিয়ে। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ঘটনা ওদের মানসিকতাই বদলে দিয়েছে। প্রিয় সতীর্থের জন্যই ক্যাসপার শ্মাইকেল, থোমাস ডোলানিরা নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে প্রতি ম্যাচে। ‘ডি’ গ্রুপে দু’টি ম্যাচ হারার পরেও সেমিফাইনালে উঠে ওরা তা প্রমাণ করেছে। দ্বিতীয়ত, ডেনমার্কের এই দলটার অনেকেই ইউরোপের সেরা লিগেগুলোয় অর্থাৎ, ইংল্যান্ড, ইটালি, স্পেন, ফ্রান্সে খেলে। তাই সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। শারীরিক ভাবেও দারুণ শক্তিশালী। আমার তো মনে হয়, ইংল্যান্ডকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হবে। ইউরোয় এ বার অসাধারণ খেলছে জন স্টোনস, কাইল ওয়াকাররা। গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ডও দুর্ভেদ্য। এখনও পর্যন্ত একটাও গোল খায়নি। ডেনমার্কের বিরুদ্ধে এই ছন্দ ধরে রাখতে হবে। কারণ, মার্টিন ব্রেথওয়েটদের লক্ষ্য থাকবে শুরুতেই গোল করে রক্ষণ মজবুত করে খেলা। সেটা করতে দেওয়া চলবে না। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগের ম্যাচে গোল করে এগিয়ে যাওয়ার পরে কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এর ফলে রক্ষণের উপরে চাপ পড়ে গিয়েছিল। ডেনমার্কের আক্রমণভাগ অনেক বেশি শক্তিশালী ইউক্রেনের চেয়ে। এই ভুল করা যাবে না। দ্বিতীয়ার্ধে ফের আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়াতেই খেলা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর দল। ডেনমার্কের বিরুদ্ধেও তাই সব সময় আক্রমণ করে যেতে হবে। তা হলেই চাপে থাকবে ওরা। ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি ছন্দে ফেরায় গোল পেতেও সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না। তৃতীয়ত, ডেনমার্ক শারীরিক ফুটবল খেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাহিম স্টার্লিং, কেভিন ফিলিপসদের লক্ষ্য হওয়া উচিত মাঝমাঠে বল যত বেশি সম্ভব, নিজেদের দখলে রাখা। সেই সঙ্গে দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করে প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করা।
ইংল্যান্ডের ফুটবলারদের সব চেয়ে বড় সুবিধে, খেলাটা হবে ওয়েম্বলিতে। শুনেছি এই ম্যাচে মোট ৬০ হাজার দর্শককে স্টেডিয়ামে খেলা দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ হাজারই ইংল্যান্ডের সমর্থক। ডেনমার্কের মাত্র পাঁচ হাজার সমর্থক থাকবেন মাঠে। হ্যারিরা যদি শুরুতেই গোল করে এগিয়ে যেতে পারে, ৫৫ হাজার ইংল্যান্ড সমর্থকের গর্জন উপেক্ষা করে ডেনমার্কের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। তা ছাড়া ওয়েম্বলি মানেই তো আবেগ।
১৯৬৬-তে বিশ্বসেরা হওয়া থেকে সম্প্রতি জার্মানির বিরুদ্ধে দুরন্ত জয়— অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই স্টেডিয়াম। তা ছাড়া ফুটবলজীবনে আমি বেশ কয়েকবার ওয়েম্বলিতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। গ্যালারি থেকে দু’বার এফএ কাপ ফাইনাল ও ইংল্যান্ডের একটা ম্যাচ দেখেছিলাম। স্টেডিয়ামে পা দিলেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। দর্শকদের গর্জন আরও উজ্জীবিত করে তোলে ফুটবলারদের। ইউরোর শেষ ষোলোয় ইংল্যান্ড বনাম জার্মানি ম্যাচেই তা দেখা গিয়েছে। খেলা শেষ হওয়ার পরে সাউথগেটও তা স্বীকার করেছিল। আমি নিশ্চিত, বুধবারও একই রকম আবহ তৈরি হবে। ইংল্যান্ড বনাম ডেনমার্ক ম্যাচ নিয়ে অবশ্য উন্মাদনা ইতিমধ্যেই তুঙ্গে। স্থানীয় সময় রাত আটটায় খেলা শুরু হওয়ার কথা। যদিও দুপুরের পর থেকেই ওয়েম্বলিতে ভিড় করবেন ইংল্যান্ডের সমর্থকেরা। যাঁরা টিকিট জোগাড় করতে পারবেন, না, তাঁরা স্টেডিয়ামের সামনে জড়ো হবেন।
অস্ট্রেলিয়ায় না থাকলে আমিও বুধবার ওয়েম্বলিতে হাজির হয়ে যেতাম। টিকিট না পেলেও। আমার একটাই প্রার্থনা— ইংল্যান্ড সমর্থকদের যেন এ বার আর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে ফিরতে না হয়।