East Bengal

আমার বাবার নাম কখনও বদলে ফেলতে পারব? ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রেও তাই

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ক্লাব সম্পর্কিত খবর দেখে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

Advertisement

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২১ ০০:৫১
Share:

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। —ফাইল চিত্র

দেশ, রাজ্য, ক্লাব মিলিয়ে বহু বছর ফুটবল খেলেছি। খেলোয়াড় জীবনের প্রায় ৯০ ভাগ সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবেই দিয়েছি। ছোট থেকেই এই ক্লাবের সমর্থক ছিলাম। তাই স্বপ্ন ছিল, বড় ক্লাবে খেললে ইস্টবেঙ্গলেই খেলব। শুরুটা করেছিলাম বাবার প্রেরণায়। বাবার কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া বাবদ ১০ পয়সা নিয়ে সুধাদা-র ক্যাম্পে গিয়ে অনুশীলন শুরু করি। আজও সেদিনটা ভুলিনি।

Advertisement

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ক্লাব সম্পর্কিত খবর দেখে এবং পড়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আলোচনাও করছি আমাদের প্রাক্তনী মনা (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য), বিকাশ (পাঁজি), মিহির (বসু), চিন্ময় (চট্টোপাধ্যায়), অলোক (মুখোপাধ্যায়), রঞ্জিতদা (মুখোপাধ্যায়), এবং আরও অনেকের সঙ্গে।

জানলাম লগ্নিকারী সংস্থা নাকি আমাদের ক্লাবের নাম বদলে নতুন নাম দেবে। এটা কী করে সম্ভব? আমার বাবার নাম আমি কখনও বদলে ফেলতে পারব? এছাড়াও শুনলাম, লগ্নিকারী সংস্থা নাকি একতরফা বিচ্ছেদ চুক্তি করেছে। জানি না পৃথিবীতে এরকম কোথাও আছে কি না। এটাও শুনলাম, ১০০ বছর ধরে যে লোগোটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বুকে করে আঁকড়ে রেখেছে, সেটাও নাকি লগ্নিকারী সংস্থাকে দিয়ে দিতে হবে। ক্লাব যদি তাদের সামাজিক কাজে এই লোগো ব্যবহার করতে চায়, তখন নাকি লগ্নিকারী সংস্থার থেকে অনুমতি নিতে হবে। কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি। বাংলার আরো দুটো শতাব্দী প্রাচীন ক্লাবের লোগো পরিবর্তন হলেও, ইস্টবেঙ্গলের লোগো কিন্তু কখনও বদলায়নি। এই লোগো ক্লাবের অহংকার, গৌরব। দশকের পর দশক ধরে ক্লাবের উপর বহু ঝড়-ঝাপ্টা এসেছে। কিন্তু ক্লাব তাদের লোগোকে কোনও দিন পরিবর্তিত হতে দেয়নি। সেই লোগো ব্যবহার করতে এবার থেকে নাকি ক্লাবকেই অনুমতি নিতে হবে। এর থেকে যন্ত্রনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না।

Advertisement

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বরাবরই তাদের প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সম্মান করে, ভালবাসে। সেই জ্যোতিষ গুহর সময় থেকে শুরু করে এখন, আমাদের মতো প্রাক্তনরা সেই আবেগ থেকে সময় পেলেই ক্লাবে আসে, ক্লাবের সামাজিক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। মাঝে মধ্যে প্রাক্তনীদের ফুটবল ম্যাচও হয়। সংবামাধ্যমে জানতে পারলাম, এগুলো করতে গেলেও নাকি এখন থেকে লগ্নিকারী সংস্থার অনুমতি নিতে হবে। তাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের গন্ডিতে প্রাক্তনীদের আসা যাওয়া বেঁধে ফেলা হবে। আবেগ আর ভালবাসা কি সময়ের গন্ডিতে বেঁধে ফেলা যায়?

এই কিছুদিন আগেই ইউরোপের ১২ টা ক্লাব জোট বেঁধে একটা টুর্নামেন্ট করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সদস্য-সমর্থকদের বাধার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। সেখানে কিন্তু ইনভেস্টর একটা শব্দও ব্যবহার করতে পারেনি। ফিফাও ক্লাবগুলোকে সমর্থন করেছে, ইনভেস্টরকে নয়। হতেই পারে ইনভেস্টর ক্লাব পরিচালনা করছে, কিন্তু কোটি কোটি সমর্থকের কাছে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আগে। সেখানে প্রতিষ্ঠানের কোনও ক্ষতি হোক, সমর্থকরা কোনও দিনই মেনে নেবেন না। ঠিক একই রকম অবস্থা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ক্ষেত্রেও। এখানেও কোটি কোটি সমর্থক কোনও দিনই মেনে নেবে না, প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি হোক। লগ্নিকারী সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলি, যে গুটিকয়েক লোক দিনের পর দিন ক্লাবকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করছে, ক্লাবের বিরুদ্ধে নোংরা উক্তি করছে তারা কিন্তু স্বার্থান্বেষী।

এই ক্লাব একশো বছরের পুরনো বিরাট ওক প্রতিষ্ঠান। এখানে কোটি কোটি মানুষ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বকে যথেষ্ট সম্মান করে, আর সম্মান রাখতেও জানে। আপনারা যে বিভাজনের খেলায় মেতেছেন, তাতে কিন্তু কোনও লাভ হবে না। এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে যাতায়াত করি। জানি মানুষের চোখে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কতটা। যখন খেলতাম, একটু বৃষ্টি হলেই টেন্টের ছাদ থেকে জল চুইয়ে পড়ত, খেলতে নামার আগে একটা ছোট্ট জায়গায় গা ঘেসাগেসি করে পোশাক বদলাতে হত। এরকম আরো কত ‘নেই’ এর মধ্যে দিয়েই আমাদের খেলোয়াড় জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। আজ সেই ক্লাবেই অত্যাধুনিক টেন্ট, সুদৃশ্য ড্রেসিং রুম, উন্নত ক্যাফেটোরিয়া, আর্কাইভ, মাল্টি জিম, লিফ্ট, আরো কত কি। ভারতীয় ফুটবলের জন্য যা যা পরিকাঠামো দরকার, সবটাই আমাদের ক্লাবে আছে। আমরা প্রাক্তনীরা আজ আমাদের ক্লাবকে নিয়ে গর্ব বোধ করি। ক্লাবের সাথে আমাদের সম্পর্কটা আত্মিক, পারিবারিকও। ভাবলে শিহরিত হই, ক্লাবের গেটে আমাদের গর্বের ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নামের বদলে লেখা হয়েছে ‘শ্রী সিমেন্ট ইস্টবেঙ্গল ফাউন্ডেশন’।

যাঁরা আজকে লগ্নিকারী সংস্থার হয়ে ক্লাব বিরূদ্ধ কথা বলছে, তাঁদের অনুরোধ করব, নিজেদের বুদ্ধি, বিবেচনা কাজে লাগান। প্রতিষ্ঠান একবার চলে গেলে কিন্তু সেটা আর ফেরত আসবে না।

একটি সংবাদপত্রে দেখলাম, মি. বাঙ্গুর নিজেই বলেছেন, "৮০ ভাগ আমাদের থাকবে, আমরা আমাদের মতো করে কাউকে দিয়ে যাব"। না সাহেব, আপনি আমাদের লোগো, লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত দিয়ে তৈরি করা ভুবন, আপনার মতো করে কাউকে দিয়ে দিতে পারেন না। আপনারা অর্থ দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান প্লাটফর্ম দিয়েছে, আপনার অর্থ আপনার ক্যাপিটাল, প্রতিষ্ঠানের প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠানের ক্যাপিটাল। অর্থ দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু ইতিহাস তৈরি করা যায় না। আপনি ৮০ ভাগ শেয়ার নিয়েছেন, তার বাণিজ্যিক প্রচার, ব্যবসায়িক সুবিধা উপভোগ করুন। আপনি আপনার মতো করে ক্লাব চালান, ক্লাবের সাফল্য আনুন, কিন্তু যাওয়ার সময় দয়া করে ব্যাগটা এখানেই রেখে যাবেন। কখনওই আপনারা নিয়ে যেতে পারেন না।

সুস্থ সমাধানের দিকে তাকিয়ে আছি। দু’ পক্ষকেই আরও নমনীয় হতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন