রিও প্যারালিম্পিক্সে পদকজয়ী দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া, মারিয়াপ্পন থঙ্গভেলু, দীপা মালিক ও বরুণ সিংহ ভাটিকে সোমবার মুম্বইয়ে ব্যক্তিগত সম্মান ও অর্থসাহায্য করলেন সচিন তেন্ডুলকর। পদকজয়ীদের প্রত্যেককে ১৫ লক্ষ টাকার চেক দেওয়া হয়। মোট এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা তোলা হয় সচিনের নেতৃত্বে স্পনসরশিপ থেকে। ছবি: পিটিআই
প্রশ্ন: একটু আগে সচিন তেন্ডুলকর-সহ সবাই যখন রিও প্যারালিম্পিক্সে পদকজয়ীদের সম্মানে দাঁড়িয়ে উঠলেন, তখন আপনার দুর্দশার মাপটা আরও ভাল করে বোঝা গেল। সম্মানের প্রত্যুত্তরে আপনার বাকি তিন পদকজয়ী বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। একমাত্র আপনি বসে থাকলেন। আপনার যেহেতু হুইল চেয়ার থেকে ওঠার সামর্থ্য নেই।
দীপা: হুঁ সে জন্যই বসে হাত নাড়লাম।
প্র: এ রকম মুহূর্তগুলোতে দুঃখ বুকে দমাদম ধাক্কা মারে না যে লোক এত বড় সম্মান দিচ্ছে অথচ আমি কি না উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না।
দীপা: আমি নিজেকে শেখাতে পেরেছি যা নেই তা নেই। সে সব বন্ধ দরজাগুলো খোলার চেষ্টা করে লাভ নেই। তার চেয়ে অর্ধেক ভর্তি গ্লাসকে ভর্তি গ্লাস হিসেবেই দেখা ভাল। আমার অর্ধেক ভর্তি গ্লাসই এত ভর্তি যে জল উপচে পড়ে।
প্র: সেটা কী করে হওয়া সম্ভব?
দীপা: কেন সম্ভব নয়? আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে। কিন্তু তা নিয়েও আমার আপ্রাণ লড়াই তো সবার সামনে স্বীকৃত। গোটা দেশ তাকিয়ে দেখছে যে এ সব সমস্যার তোয়াক্কা না করে প্রতিবন্ধীরা যে বিশ্বমঞ্চ থেকে পদক তুলে আনছে। মেয়েদের মধ্যে এই লড়াইয়ে আমিই পথিকৃৎ। তাই এক হিসেবে হয়ে গিয়েছি এজেন্ট অব চেঞ্জ। এই জায়গাটাই তো খুব গর্বের।
প্র: আপনি টাইগার পটৌডি বলে কারও কথা জানেন যিনি এক চোখ হারিয়েও সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলতেন?
দীপা: জানি। আর এই সব কাহিনিগুলোই তো আমার অনুপ্রেরণা। আমি ভীষণ ইন্সপায়ার্ড হই যখন দেখি আমার বন্ধু অ্যাথলিটরা কী ভাবে শারীরিক সীমাবদ্ধতা দূরে ফেলে কঠিন ট্রেনিং করছে।
প্র: কিছু মনে করবেন না এ রকম হুইল চেয়ারে বসে স্পোর্টস কী ভাবে সম্ভব? পদক জেতা তো ছেড়েই দিলাম।
দীপা: আমি তো গাড়ি চালাই। হ্যান্ড গিয়ারওয়ালা গাড়ি। বাইক চালাই। সাঁতার কাটি।
প্র: এত সমস্যা নিয়েও।
দীপা: ইয়েস আমার বুকের নীচ থেকে বাকি গোটা শরীর কোনও সাড় নেই। একটা কৃত্রিম শরীর। আমার ব্লাডার বলুন, বাওয়েল মুভমেন্ট বলুন সব কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সামান্য কিছু ঘটলেই আমার ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। বলা যেতে পারে আমার মধ্যে দুটো শরীর আছে। একটা আমার নিজের। একটা পুরো আর্টিফিশিয়াল। মোট একত্রিশটা সার্জারি হয়েছে আমার। খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক রাখাই শুধু নয়, জল কম বেশি খেলেও আমার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।
প্র: অবিশ্বাস্য লাগছে। ম্যানেজ করেন কী করে?
দীপা: করতেই হয়। বলে না শরীরের ওপর রাজত্ব করে মন। এটা ঠিক তাই।
প্র: টোকিও প্যারালিম্পিক্সের লক্ষ্য কী?
দীপা: গোল্ড। সিলভারের পরের স্টেশন তো গোল্ডই।
প্র: আশঙ্কা হয় না এই যে আপনাদের নিয়ে নাচানাচি হচ্ছে সেটা খুব সাময়িক? দ্রুত জনমানস থেকে আপনারা উধাও হয়ে যাবেন। এখন গরম গরম চলছে চলছে।
দীপা: মনে হয় না এই সময়টা ‘ফ্লেভার অব দ্য সিজন’ বলে। গোটা দেশ যে ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যে ভাবে আমাদের কদর করছেন। ভালবাসছেন। সেটা সম্মোহিত হওয়ার মতো। এই গভীরতা এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারে না।
প্র: তেন্ডুলকরের নিজে এসে ব্যক্তিগত সম্মান আর অর্থ সাহায্য করাটা আপনার চোখে কী রকম?
দীপা: তেন্ডুলকর হলেন গড অব ক্রিকেট। আর ক্রিকেট আমাদের দেশের কাছে ধর্মের মতো। সেই ধর্মের ঈশ্বর যদি নিজে কাছে আসেন তা হলে তো আমাদের পারফরম্যান্সে দ্বিগুণ প্রভাব হয়। ঈশ্বরের এত লাখ লাখ ভক্তও আমাদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
প্র: কারও কারও মনে হচ্ছে হঠাৎ করে এত প্রচার আর সংবর্ধনা পেয়ে প্যারালিম্পিক্স মেডেল উইনারদের মাথা ঘুরে যাবে না তো?
দীপা: যারা এত অধ্যবসায় আর মানসিক শৃঙ্খলা দেখিয়ে কষ্ট করে নিজেদের জন্য এই জায়গাটা তৈরি করেছে তারা কোন দুঃখে এটা ছুড়ে ফেলে দেবে? আমরা প্রতিকূলতার ওপরে যখন উঠতে পেরেছি প্রচারের ওপরেও উঠতে পারব।
প্র: জীবন পণ করে এমন মারাত্মক লড়াইয়ের রসদ কোথা থেকে পান?
দীপা: একে তো আমি জাঠনি। লড়াই আমরা সহজে ছাড়তে শিখিনি। তার উপর আমার টিনএজ জীবনের ভিত তৈরি কলকাতায়। ওই শহরটা আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে।
প্র: জানতাম না তো। কলকাতায় কবে থাকতেন?
দীপা: মোটামুটি ভাবে ১১-১৫ বছরের মধ্যে। যখন এক জন মানুষ তৈরি হয়। হেস্টিংস-য়ে থাকতাম। আর ফোর্ট উইলিয়াম কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়তাম। নাইন্টিন এইট্টি ফাইভ থেকে বেশ কয়েক বছর কলকাতায় কাটিয়েছি। কলকাতা আমাকে শিখিয়েছে বন্ধুবৎসল হবে। বন্ধুদের সঙ্গ সুখে-দুঃখে ছাড়বে না। আর যতই দুর্দশার মেঘে ঢেকে যাও মন খুলে হাসবে। কলকাতার সেই শিক্ষা আজও ভুলিনি।