স্টপার
subhas bhowmik

Subhas Bhowmik Death: আগ্রাসন শিখিয়েছিল ভোম্বলদা

ভোম্বলদার এই দুঃসাহসিকতা, ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিক দৃঢ়তা, উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল অবিশ্বাস্য।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:০৭
Share:

স্মৃতি: বিপক্ষের রক্ষণকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এ ভাবেই এগিয়ে যেতেন সুভাষ। তাঁর এই বিধ্বংসী ফুটবলের ছবিই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ভক্তদের মনে। ফাইল চিত্র

ভারতীয় ফুটবলের হার-না-মানা এক বেপরোয়া যোদ্ধার পথচলা শেষ হল! শনিবার সকালে ভোম্বলদার(সুভাষ ভৌমিক) মৃত্যুর খবর শোনার পরে এই উপলব্ধিটাই হয়েছিল।

Advertisement

ভোম্বলদার উপস্থিতি দলের মধ্যে আলোড়ন ফেলে দিত সব সময়। শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে আমরা হয়তো সকলে কিছুটা গুটিয়ে রয়েছি আতঙ্কে। ব্যতিক্রম ভোম্বলদা। প্রতিপক্ষকে ভয় বা সমীহ করার ব্যাপারটাই ছিল না ওর মধ্যে। আমাদের থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখলেই বলত, ‘‘মাঠে চল। বিপক্ষকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তোরা শুধু রক্ষণ সামলা। বাকিটা আমার উপরে ছেড়ে দে।’’ এমনকি, কোনও ম্যাচে হেরে যাওয়ার পরেও ভোম্বলদার মধ্যে পরিবর্তন দেখিনি। বলত, ‘‘একটা ম্যাচে হেরেছি তো কী হয়েছে? পরের খেলায় আমাদের জিততেই হবে। মন খারাপ করে তোরা বসে থাকিস না।’’ কলকাতার বাইরে খেলতে গেলে টিম হোটেলে আমাদের ঘরে চলে আসত উজ্জীবিত করার জন্য। মুখে একটাই কথা লেগে থাকত, ‘‘কাউকে ভয় পাবি না।’’

ভোম্বলদার এই দুঃসাহসিকতা, ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিক দৃঢ়তা, উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল অবিশ্বাস্য। ও দলে থাকলে আমরা অনেক নিশ্চিন্ত মনে খেলতে পারতাম। আমরা যখনই এক দলে খেলেছি, ভোম্বলদা ম্যাচ শুরু হওয়ার সময় বলত, ‘‘বাবলু তুই ওদের দুই স্টপারের মাঝখানে বলটা শুধু ঠিকঠাক রাখ। বাকিটা আমি দেখে নেব। তোকে কিছু চিন্তা করতে হবে না।’’ সত্যিই ম্যাচে সেটাই হত। আমি ভোম্বলদার নির্দেশ অনুযায়ী বল দিতাম, ও তা ধরে সেন্টার করত। ওর পাস থেকে মহম্মদ হাবিব এবং আকবর যে কত গোল করেছে, তা গুনে শেষ করা যাবে না। এই কারণেই ভোম্বলদা বিপক্ষ দলে থাকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। শারীরিক ভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিল। কাঁধে করে বিপক্ষের দু’-তিন জনকে টেনে নিয়ে চলে যাওযার ক্ষমতা ছিল। বলের উপরেও দুর্ধর্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। এ ছাড়া প্রচণ্ড জোরালো শট তো ছিলই। আমরা তো মাঠে নেমে আগে দেখতাম, বিপক্ষের প্রথম একাদশে ভোম্বলদা আছে কি না। জানতাম, ওর পায়ে বল পড়লে আটকানো কঠিন। বুলডোজ়ারের মতো যাবতীয় প্রতিরোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে। ভোম্বলদার একটাই দুর্বলতা ছিল হেড। তাই আমাদের লক্ষ্য থাকত বিপক্ষকে উঁচু পাসে খেলতে বাধ্য করা। যাতে ভোম্বলদা বল ধরার আগেই হেড করে বল বিপন্মুক্ত করা যায়। শুরুর দিকে ধরতেই পারতাম না ওর খেলা। তাই বারবার আটকাতে ব্যর্থ হয়েছি।

Advertisement

১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে স্কোর বোর্ডে লেখা থাকবে ইস্টবেঙ্গল ৫ মোহনবাগান ০। আসলে ম্যাচটা আমরা হেরেছিলাম ভোম্বলদার কাছেই। নিজে গোল না করলেও একাই আমাদের চূর্ণ করেছিল। সে দিন ও যে রকম বিধ্বংসী মেজাজে ছিল, তাতে আরও বেশি গোল হলেও অবাক হওয়ার ছিল না। ভোম্বলদার ওরকম রুদ্রমূর্তি আমি আগে কখনও দেখেনি। মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ করতে নেমেছে। এখনও মনে আছে, ম্যাচ শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাদের একাধিক ফুটবলারকে কাটিয়ে ও বক্সে ঢুকে পড়েছিল। দুর্ভাগ্য যে, শেষ পর্যন্ত গোলটা করতে পারেনি। বেজি যেমন সাপকে নিয়ে খেলা করতে করতে শিকারে পরিণত করে, ভোম্বলদাও সে দিন আমাদের নিয়ে একই কাজ করেছিল।

এই আগ্রাসী মানসিকতার জন্যই ভোম্বলদা ছিল সকলের চেয়ে আলাদা। প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) তাই খুব ভালবাসতেন ওকে। ভোম্বলদা কাউকেই পরোয়া করত না। এমনকী, প্রদীপদাকেও না। যে ভাবে উনি এক জন ফুটবলারের সব কিছু মেনে নিতেন তা দেখে আমরা একটু অবাকই হতাম। প্রদীপদা বলতেন, ‘‘ভোম্বল হচ্ছে ছাইচাপা আগুনের মতো। কোচ হিসেবে আমার কর্তব্য সেই আগুনকে লেলিহান শিখায় পরিণত করা। এই কারণেই ভোম্বলের সব কিছু আমি মেনে নিই।’’ মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭৫ সালের সন্তোষ ট্রফির একটা ম্যাচ। অবিশ্বাস্য একটা গোল করেছিল ও। বাংলা সে বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভোম্বলদার সৌজন্যেই।

ভোম্বলদা ছিল অসম্ভব সৌখিন। বিদেশি পারফিউম ব্যবহার করত। দামি দামি জামা, প্যান্ট, জুতো পরত। আমাদের বলত, ‘‘শেখ কী ভাবে জীবনযাপন করতে হয়।’’

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। দিল্লি গিয়েছি ডুরান্ড কাপ খেলতে। ভোম্বলদা কোথাও বেরিয়েছিল। আমরা ওর ঘরে ঢুকে বিদেশি পারফিউম মেখেছিলাম লুকিয়ে। ওকে রাগাবার জন্য অন্যান্য জিনিস-পত্রও সরিয়ে রাখতাম। হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকেই রেগে আগুন ভোম্বলদা জিজ্ঞেস করত, ‘‘আমার ঘরে কে ঢুকেছিল? পারফিউম কে মেখেছে?’’ আমরা কোনও উত্তর দিতাম না। তাতে আরও ক্ষেপে যেত। আমরা উপভোগ করতাম।

কোচ হিসেবেও ভোম্বলদা ছিল একই রকম অকুতোভয়। সর্বক্ষণ ফুটবল নিয়ে ভাবত। পড়াশোনা করত। বিদেশি ফুটবল দেখত। বিভিন্ন রণকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও কখনও ভয় পায়নি। ফুটবলারদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে সব সময় অগ্রাধিকার দিত। তার জন্য ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে বহুবার বিবাদে জড়িয়েছে। ভোম্বলদার হাত ধরেই ময়দানে আধুনিকতা এসেছিল। সেই সময় জাকুজি, আলাদা ফিজ়িক্যাল ট্রেনার, খাবারে পাস্তা— এ সব কেউ ভাবতেই পারত না। অথচ এ রকম এক জন কোচকে কখনও জাতীয় দলের দায়িত্ব দেওয়া হল না।

ভারতীয় ফুটবলে ভোম্বলদার মূল্যায়নই হল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন