বিতর্ক: শিলিগুড়িতে ডার্বির সেই ছবি। মোহনবাগান ফুটবলারদের হাতে আক্রান্ত রেফারি। —ফাইল চিত্র।
ম্যাচ হারলেই কাঠগড়ায় রেফারি!
কলকাতা ময়দানে যা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ রেফারির দিকে যাঁরা আঙুল তুলছেন, দলটা কিন্তু তাঁরাই গড়েছেন। হারের পর নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই যাবতীয় দায় চাপান রেফারির উপর।
শিলিগুড়িতে কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বি অসাধারণ খেলিয়েছেন রঞ্জিত বক্সী, কুণাল সরকার ও বিপ্লব পোদ্দার। প্রাক্তন ফিফা রেফারি হিসেবে আমি গর্বিত। অথচ দুর্দান্ত ম্যাচ পরিচালনার মধ্যেই মোহনবাগান অধিনায়ক কিংশুক দেবনাথের হাতে হেনস্তা হয়েছেন ওঁরা।
ইস্টবেঙ্গলকে ন্যায্য পেনাল্টি দেওয়া সত্ত্বেও রঞ্জিতের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। রিপ্লে-তে দেখলাম, রঞ্জিতের সামনেই ইস্টবেঙ্গলের লালডানমাওয়াইয়া রালতে-কে ফাউল করেছে মোহনবাগানের রেনিয়ার ফার্নান্দেজ। মুহূর্তের মধ্যে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রঞ্জিত। ওঁর মনে যদি কোনও সংশয় থাকত, তা হলে এত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না।
শিলিগুড়িতে ডার্বির মতো উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে দু’টো পেনাল্টি, দু’টো লাল কার্ড দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সাহস কিন্তু সকলের থাকে না। রেফারি হিসেবে রঞ্জিত দৃঢ়তার সঙ্গে সেটাই করে দেখিয়েছেন। অভিযোগ করার আগে কেউ ভাবেন না, ফুটবলারদের মতো আমরা রেফারিরাও ডার্বির দিকে তাকিয়ে থাকি। এটা হচ্ছে সেই ম্যাচ, যা জীবন বদলে দিতে পারে। ফলে প্রত্যেক রেফারি নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ডার্বিতে মাঠে নামেন। কেউ চান না, তাঁর কেরিয়ার কলঙ্কিত হোক।
আরও পড়ুন: খেতাব ইস্টবেঙ্গলের, রেফারি বিতর্কে বাগান
আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ফুটবলে দু’জনকে নিশানা করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে সহজ। প্রথম জন রেফারি। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন নিজের দলেরই কোচ। ৪৯ বছর আমি রেফারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। কখনও শুনলাম না, কোনও ক্লাবকর্তা বলছেন, আমরা ভাল দল গড়তে পারিনি বলেই হেরেছি। বা আমাদের দল খারাপ খেলেছে বলেই জিততে পারলাম না। তাঁরা প্রথমে দায়ী করেন রেফারিকে। তার পর কাঠগড়ায় তোলেন দলের কোচকে। বছরের পর বছর ধরে এটাই চলে আসছে।
ম্যাচের পর মোহনবাগান কর্তারা পেনাল্টির ক্লিপিংস ফিফায় পাঠাবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার, এ ভাবে সরাসরি কোনও ক্লিপিংস ফুটবলের নিয়ামক সংস্থার কাছে পাঠানো যায় না। ফিফার নিয়মে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, রেফারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মাঠে কোনও ভাবেই সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানানো যায় না। পরে প্রয়োজনীয় প্রমাণ-সহ আবেদন করা যেতে পারে। কিন্তু প্রথমে আবেদন করতে হবে স্থানীয় সংস্থায়। তাদের সিদ্ধান্তে আপত্তি থাকলে আবেদন করা যায় সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কাছে। তার পর এএফসি। সবার শেষে ফিফায়।
রেফারির সিদ্ধান্ত সকলের পছন্দ না-ই হতে পারে। কিন্তু তাঁকে নিগ্রহ করার অধিকার কারও নেই। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা, রেফারির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করা বা অঙ্গভঙ্গি করার জন্যও কড়া শাস্তি পেতে পারেন ফুটবলার-রা।
স্প্যানিশ কাপ ফাইনালের প্রথম পর্বে শুধু রেফারির শরীর স্পর্শ করার অপরাধে পাঁচ ম্যাচ নির্বাসিত করা হয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-কে। বিতর্কে জড়িয়েছেন লিওনেল মেসি-ও। রবিবার টিভিতেই দেখলাম, কিংশুক-সহ মোহনবাগানের বেশ কিছু ফুটবলার চড়াও হয়েছেন রেফারির উপর। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, রেফারিকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করলে ন্যূনতম ছয় মাস নির্বাসিত করা যায় অভিযুক্ত ফুটবলারকে। শাস্তি পান ক্লাব কর্তারাও। কলকাতা ময়দানেই এই দৃষ্টান্ত রয়েছে। আইএফএ-র সচিব তখন ছিলেন প্রয়াত প্রদ্যোৎ দত্ত। মোহনবাগান মাঠে আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিলেন আইএফএ সচিব। তিন বছর নির্বাসিত করেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ মোহনবাগানের ফুটবলারদের। যদিও পরে আবেদন করায় সুব্রতর শাস্তি কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ইস্টবেঙ্গলের প্রদীপ তালুকদারের সঙ্গে মোহনবাগানের সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সংঘর্ষ হয়েছিল। আমি পকেট থেকে হলুদ কার্ড বার করতেই মেজাজ হারান সত্যজিৎ। আমার হাত থেকে কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দেন। এমনিতে সত্যজিৎ খুব ভদ্র ফুটবলার। সে দিন কেন ওরকম করলেন, সেটা আজও আমার কাছে রহস্য। বাধ্য হয়েই ওঁকে লাল কার্ড দেখাই। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যুবভারতী। প্রায় ১৭-১৮ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল।
আরও একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেটাও ছিল ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ডার্বি। আমি তখন ম্যাচ কমিশনার। যুবভারতীতে ম্যাচ চলাকালীন চতুর্থ রেফারির উপর বারবার চাপ সৃষ্টি করছিলেন দুই প্রধানের দুই কর্তা। রিপোর্টে পুরো ঘটনাটা উল্লেখ করেছিলাম। যার জেরে দু’জনেরই জরিমানা ও নির্বাসন হয়। শিলিগুড়ির ডার্বিতে কিংশুক-রা শুধু রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েই থেমে থাকেননি, গায়ে হাতও তোলেন। এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে কলকাতা ফুটবল কলঙ্কিত হতেই থাকবে।
(লেখক প্রাক্তন ফিফা রেফারি। কলকাতা ময়দানে বহু স্মরণীয় ডার্বি পরিচালনা করেছেন।)