ট্রেনের শৌচাগারের পাশে বসে পুণে গিয়েছিলেন পলি

জাতীয় ফুটবল দলে সিঙ্গুরের খেতমজুরের মেয়ে

সিঙ্গুরের গোপালনগরের এই বাড়িরই অন্যতম সদস্য এখন দেশের জাতীয় ফুটবল দলেরও সদস্য। গৃহকর্তা নির্মল কোলের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট পলির এখন পাখির চোখ— নিয়মিত ভাবে দেশের জার্সিতে মাঠে নামা। টোকিও অলিম্পিকে বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার জন্য গত এক মাস কটকে প্রস্তুতি শিবিরে ছিলেন তিনি।

Advertisement

প্রকাশ পাল

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:২৩
Share:

বাজিমাত: বল দখলের লড়াই পলির (রঙিন জার্সি)। ফাইল ছবি

পিচ রাস্তা ছেড়ে সরু গলি। কিছুটা ইট বিছানো। তার পরে মাটির। কিছুদূর গিয়ে একফালি উঠোনে দু’টি গরু বাঁধা। পাশে একতলা বাড়ি। সামনের অংশ রং করা। বাকি তিন দেওয়ালে প্লাস্টারও হয়নি। ভিতরে বারান্দা, দু’টো ঘর। বাড়ির পিছনে বাঁশগাছের ঝাড়।

Advertisement

সিঙ্গুরের গোপালনগরের এই বাড়িরই অন্যতম সদস্য এখন দেশের জাতীয় ফুটবল দলেরও সদস্য। গৃহকর্তা নির্মল কোলের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট পলির এখন পাখির চোখ— নিয়মিত ভাবে দেশের জার্সিতে মাঠে নামা। টোকিও অলিম্পিকে বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার জন্য গত এক মাস কটকে প্রস্তুতি শিবিরে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ২৫ জন যাচ্ছেন হংকংয়ে প্রস্ততি সফরে। সেই দলে জায়গা করে নিয়েছেন বঙ্গতনয়া এই ডিফেন্ডার।

বাড়ির লোকেরা জানান, পলি ছোটবেলায় গোপালনগর পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যা‌লয়ে পড়েছেন। সিঙ্গুরের গোলাপমোহিনী মল্লিক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। ছোট থেকেই খেলায় আগ্রহ। স্কুলের স্পোর্টসে পুরস্কার আসত। বছর দশ-এগারো বয়সে ফুটবলে হাতেখড়ি। প্রথমে পাড়ার মাঠে বলে পা। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে বকুনি শুনতে হয়েছে। পরে বাবা, দাদা-দিদি হাত ধরে মাঠে নিয়ে গিয়েছেন। খেলেছেন রাজ্য বিদ্যালয় ফুটবলে। ১৪ বছর বয়েসে হরিপালে শিবু মান্নার প্রশিক্ষণ শিবিরে অনুশীলন শুরু। সেখান থেকে কলকাতা ময়দান। তালতলা দীপ্তি সঙ্ঘ। তার পরে মেয়েদের আই লিগে খেলতে পুনে সিটি এফসিতে।

Advertisement

দিন কয়েক আগে দিল্লি থেকে হংকংয়ের ফ্লাইট ছিল। দুপুরে ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে বিমানে বসেই মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন সপ্রতিভ মেয়েটি। বলছিলেন‌, ‘‘শিবুস্যর, শুক্লা দত্ত, দোলা মুখোপাধ্যায়দের সাহায্য পেয়েছি। ২০১৭ সা‌লে শুক্লাদির পরামর্শে পুনে সিটিতে ট্রায়াল দিতে যাই। হাতে টাকা ছিল না। দাদার কাছ থেকে দু’হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। টিকিট রিজার্ভ না হওয়ায় ট্রেনে বাথরুমের পাশে বসেই গিয়েছিলাম পুণেতে।’’ ওই দলের হয়ে সব ম্যাচে প্রথম একাদশে জায়গা করে নেন। পল‌ির কথায়, ‘‘জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখতাম। সুযোগটা এ বার কাজে লাগাতে চাই।’’

দলের পাশাপাশি পরিবারের রক্ষণও সামলাতে চান মেয়েটি। তাঁর কথায়, ‘‘খেলা থেকে পাওয়া টাকা থেকে নিজের খরচ রেখে বাকিটা বাড়িতে দিই। খেলার নেশা আর আর্থিক অভাবের জন্য বেশিদূর পড়তে পারিনি। পরিবারে অভাব এখনও রয়েছে। দেশের হয়ে খেলে সব খেদ মুছে দিতে চাই।’’

নির্মলবাবু খেতমজুরি করতেন। এখন অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না। দাদা লাল্টু দিনমজুরি করেন। মা নমিতাদেবী এক সময় লোকের বড়িতে কাজ করতেন। অভাবকে সঙ্গী করেই কিন্তু সকলে পলিকে খেলাধুলোয় উৎসাহ জুগিয়েছেন। লাল্টুর কথায়, ‘‘বোন আরও উন্নতি করুক। নাম করুক।’’ নমিতাদেবীর কথায়, ‘‘পেটপুরে খেতে পেতাম না আমরা। মেয়েটা তার মধ্যেই খুব কষ্ট করে এই জায়গায় গিয়েছে। কখনও ফাঁকি দেয়নি।’’ পলিও জোর গলায় জানিয়ে দেন, চেষ্টার কসুর তিনি করবেন না।

এর মধ্যেই ফোন বন্ধ করার নির্দেশ আসে। কিছুক্ষণ পরেই বিমান ছুটতে থাকে ওড়ার জন্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন